11.8 C
Toronto
রবিবার, মে ৫, ২০২৪

ভালো কিছু পেতে গেলেতো কিছু হারাতে হয়

ভালো কিছু পেতে গেলেতো কিছু হারাতে হয়

যে বাড়ীতে আমার জন্ম হয় তার একটা ঝুল বারান্দা ছিলো। বারান্দায় একটা বেঞ্চ ছিলো আমি ওটার উপর দাঁড়িয়ে দুনিয়াটাকে দেখার চেষ্টা করতাম।ঝুল বারান্দা থেকে দেখা যেত রেল লাইন আর পুরা প্লাটফর্মটাকে।রেল গাড়ী আসা যাওয়া আর অসংখ্য মানুষের আনাগোনা দেখতে দেখতে শৈশবের দিন কাটতে লাগলো।আব্বার হাত ধরে প্লাট ফর্মে গিয়ে দাঁড়াতাম তারই সাথে।

- Advertisement -

রেল ষ্টেশন মাষ্টার যারাই আসতেন তারাই আব্বার বন্ধু হয়ে যেতেন।সেই সুবাদেই আব্বা গিয়ে দাঁড়াতেন প্রতিদিন অন্তত একবার সকালে আর তার সাথে আমিও।খুলনা-শিয়ালদহ ট্রেন চলতো।ট্রেন টানতো কয়লার ইন্জিন। আমি আঙ্গুর আপেল খেতে পচ্ছন্দ করতাম যা সেই সময় অবৈধ পথেই ভারত থেকে আসতো সীমান্তের এপারে এবং শুধুমাত্র শীতের সময় তাই আব্বা ষ্টেশন মাষ্টারের হাত দিয়ে রেলের গার্ডের হাতে টাকা দিয়ে দিতেন যেন তিনি শিয়ালদহ থেকে ফেরার পথে কিছু ফল কিনে আনেন। রাতে ফেরার পথে ষ্টেশন মাষ্টারের হাতে সেগুলো নামিয়ে দিতেন গার্ড সাহেব। ট্রেনের অপেক্ষায় আমি অনেক সময় নির্ঘুম চোখে বসে থাকতাম, অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল।এরপর দুই যুগেরও বেশী সময় এ লাইনে আর ট্রেন চলেনি।লাইন দুটিকে মনে হতো কোন মৃত সরীসৃপ। আমরা ওর উপর দিয়ে নির্ভয়ে হেটে স্কুলে যেতাম আসতাম।এ এলাকার মানুষ ভুলে গেল ট্রেন কি।ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়াতে কার কি হয়েছিলো তা হয়তো বলতে পারবো না তবে আমার মন খারাপ হয়ে থাকতো কারন সকালের ঘুম ভা্ঙ্গার পর যা আমি দেখতে চাইতাম তা আর পেতাম না।

১৯৯৬ সালে আমি বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের স্বাস্থ্য উইংয়ে গবেষণা কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করতাম। পাশেই ছিলো যোগাযোগ উইং।সমবয়সী সব অফিসারের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠলো।তাদের কাছ থেকেই আমি শুনতাম রেল লাইনটি পরিত্যক্ত ঘোষনার চিন্তা ভাবনার কথা যা আমি কখনও চাইতাম না।আমার এলাকার দরদী ব্যক্তিরা অনেকবার স্বাক্ষর নিয়ে তা পাঠিয়ে দিয়েছেন উপরে যাতে আর্জি ছিলো যেন এই লাইনে রেল চলে।রাজনীতির উর্দ্ধে থেকেই এই মহাপ্রান ব্যক্তিরাই তা করেছেন।একদিন যোগাযোগ উইং এর এক সহকর্মী বন্ধু বললেন-আযম ভাই আপনার বাড়ী ঝিকরগাছাতে না?।তিনি বললেন-আমরা গত সপ্তাহে সেখানে গিয়েছিলাম একটি সমীক্ষা করতে।মন্ত্রীর বেয়াই বাড়ীর পাশে একটি মাঠে(কির্ত্তিপুর) স্থানীয় কিছু ব্যক্তির সাথে কথা হলো কিন্ত্ত এরা কেউই রেল চলাচলের পক্ষে নয়।সে আমাকে আরো বললো এদের অনেকেই পরিবহন ব্যবসার সাথে জড়িত।জানলাম রেল লাইন পরিত্যক্ত ঘোষনা করে উঠিয়ে নিতে যে খরচ রেল চালাতেও সেই খরচ তাই কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছেনা।

বেনাপোল থেকে যশোর পর্যন্ত সড়কটি আগের থেকে অনেক সরু মনে হয়। রাস্তা যে সরু হচ্ছে তা নয় বরং গাড়ীগুলির কলেবর বড় হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের পরিবহন ব্যবসা গড়ে উঠেছে এই এলাকায় কিন্ত্ত রাস্তার মান তেমন নয়। গাছ রাস্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে ঠিকই কিন্ত্ত সেই সাথে বৃষ্টির পরেই গাছের ছায়ায় রাস্তা দ্রুত না শুকানোর ফলেই রাস্তায় বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয় প্রতিবছরই ফলে লেগে থাকে দূর্ঘটনা এবং হতাহত হয় প্রতি বছরই।জীবনের রিক্স নিয়ে ভাঙ্গাচোরা রাস্তা দিয়ে চলা ফেরা করে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি তাই এর যে উন্নয়ন করা যায় সেটা আমরা কখনও ভাবিনা।

উন্নয়নের জোয়ার ছিটেফোটা হলেও এ এলাকাতে তার ছোয়া লেগেছে। ঝিকরগাছা পৌরসভাতে উন্নীত হয়েছে। স্থানীয় পৌরসভার রাস্তাঘাট মেরামত হয়েছে। অপ্রতুল জীবিকার কারণে তেমন প্রাণ ফিরে আসেনি মানুষের জীবন প্রবাহে। কৃষিকাজ আর ব্যবসা বানিজ্য ছাড়া তেমন কিছু এখানে গড়ে ওঠেনি।এখানে এক সময় মিল কলকারখানা ছিলো সেগুলি এখন নেই।তাই বেকার মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আজ যদি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকতো তাহলে এখানেও গড়ে উঠতো আধুনিক কলকারখানা।কর্মী মানুষের ভীড়ে জেগে উঠতো এ তল্লাট। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মূলেই রয়েছে উন্নত ও সুপরিসর সড়ক।

দু’তিন মাস পূর্বে চালু হয়েছে খুলনা-শিয়ালদহ রেল “বন্ধন এক্সপ্রেস” যা ছিলো আমার স্বপ্নের চাওয়া।দৈনিক ট্রেন যাওয়া আসা করে। এটুকু ভেবে শান্তি পাই যে ট্রেন লাইনটি চালু আছে।অনেকদিন ধরে জেনে আসছি যে যশোর-বেনাপোল সড়কটি বড় করা হবে, কাটা হবে গাছ।সড়ক বড় করতে গাছকাটা ছাড়া উপায় নেই।গাছ কাটা নিয়ে অনেক কিছুই হয়েছে জেনেছি সংবাদে। পক্ষ বিপক্ষ তৈরী হয়েছে।অনেক লেখালেখি হয়েছে, হচ্ছে।পক্ষ-বিপক্ষের কারনে দীর্ঘসূত্রিতা হচ্ছে। আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি কাঙ্খিত উন্নয়নের ছোয়া থেকে।গরীব এ জনপদ গরীবই থেকে যাচ্ছে।

যশোরের মহামান্য আদালতের আদেশে গাছ কাটার উপর ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা জারী রয়েছে।আশা করি আদালত এবং সংশ্লিষ্টরাই একটি পথ বের করতে পারবেন।একটা ছোট কথা মনে পড়লো তাই দিয়েই শেষ করবো এই লেখাটি।আমার এক আত্বীয়া তার ছেলের বিয়ের দাওয়াত দিতে ছেলে সহ পরিকল্পণা কমিশনের অফিসে এলেন।ছেলেটিকে আমি ছোট দেখেছি।

এখন সে সদ্য বিলেত ফেরা পিএইচডি ধারী।মাথায় একটিও চুল নেই।প্রথম দেখায় কষ্ট পেলাম কারন তার বংশে এ রকম কাউকে দেখিনি।আমার সেই ভাতিজাকে যখন বললাম তোমার মাথার চুল তো সব চলে গেছে। মুখটা ওর শুকিয়ে গেল কথা শুনে।সাথে সাথেই ওর মা বললো-আহা ও কত বড় ডিগ্রিটা করেছে তা দেখলে না? ভালো কিছু পেতে গেলেতো কিছু হারাতে হয়।সে যেন কিছুটা শ্বান্তনা খুঁজে পেল।আমাদেরকে ভাবতে হবে আগে-এলাকার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন না গাছ? যশোর-ঝিকরগাছা-নাভারণ-শার্শা-বেনাপোলের উন্নয়নের জন্য আমাদেরকে হয়তো প্রিয় এই গাছগুলির কিছু অংশের মায়া ছেড়ে দিতে হবে।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles