13.4 C
Toronto
শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪

শোক প্রকাশ করছি

শোক প্রকাশ করছি
ডাঃ জাফারুল্লাহর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কার্যকলাপের আমি অন্ধ সমর্থক নই

একজন অতি সাধারন জীবনযাপনকারী ’৭১ এর একজন মুক্তিযোদ্ধার তিরোধানে আমি শোক প্রকাশ করছি। কিন্ত ডাঃ জাফারুল্লাহর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কার্যকলাপের আমি অন্ধ সমর্থক নই।

ইংরেজী বাক্য থেকে ধার নিয়ে বলছি Spadeকে Spade বলার নামই সততা। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের শোকাবহ দিনের পর ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কালো দিবস। ঐদিন থেকে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ’৭১ সালে ঘটনাক্রমে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করলেই মুক্তিযুদ্ধা হওয়া যায় না। যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে জাফারুল্লাহ চৌধুরীর কার্যকলাপের দিকে নজর দিলেই সেটা পরিস্কার হবে।
মুক্তিযুদ্ধ একটা আদর্শ, একটা চলমান প্রক্রিয়া, যার জন্য যুদ্ধ এখনো চলছে। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা তথা আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেছিল বলেই ‘মিনি পাকিস্তান’ বানানোর প্রক্রিয়া রোধ করে আজকে বিশ্ব দরবারে বাঙ্গালী এক গর্বিত জাতি।

- Advertisement -

কামাল হোসেনের জামাতা ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যানের সাজায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ‘অবমাননাকর’ বিবৃতি দেওয়ায় জাফর উল্লাহ চৌধুরীকে সাজা দিয়েছিল আন্তর্জাতিক আদালত। শাস্তি হিসাবে তাকে এক ঘণ্টা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়েছে এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে মন্তব্য করার জন্য বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এই জাফরুল্লাহ। ইনি সে জাফরুল্লাহ যিনি বলেছিলেন “এ কাদের মোল্লা সে কাদের মোল্লা নয়”। হাঁ, এই সেই জাফরুল্লাহ যিনি কামারুজ্জামানকে ২০ মিনিট ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলিয়ে রাখাতে মনে আঘাত পেয়েছিলেন এবং সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছিলেন কামারুজ্জামানের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার। ইনি সেই জাফরুল্লাহ সাকা চৌ এর ফাঁসীর আদেশ হলে বলেছিলেন, “সাকা ন্যায় বিচার পায়নি”।

৯৩ হাজার ‘মুসলমান’ সৈনিকের আত্মসমর্পণের স্মৃতি মুছে দেয়ার মানসে যিনি রেসকোর্সে শিশুপার্ক নির্মাণ করেন (প্রয়াত গিয়াস কামাল চৌধুরীর স্মৃতি কথায় বিস্তারিত বিবরন লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং পরবরতীতে হাইকোর্টের রুলিং এ সেটা বলা হয়েছে) তিনি সত্যিই কোন পক্ষের ছিলেন সেটা বুঝার জন্য কি কোন ইতিহাসবিদের বিশ্লেষনের প্রয়োজন আছে? ইতিহাস যদি তাঁকে চিহ্নিত করতে কার্পণ্য করে তবে সেটা হবে ইতিহাসের চরম ব্যর্থতা। বিএনপি নামক দলটি যতদিন জিয়া পরিবারের নেতৃত্ব মুক্ত না হবে ততদিন ঐ দলটি ক্ষমতায় আসলে আবার ‘মিনি পাকিস্তান’ বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে। তাই প্রকৃত বাঙ্গালীর রক্ত যাদের ধমনীতে প্রবাহিত তাদেরকে বলছি, “সাধু সাবধান”।

বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে জাতির বিবেকেরা কথা বলবেন, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু তারা যদি শুধুমাত্র একটি সরকার ক্ষমতায় এলেই মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার হন, অন্য সময় যদি মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন তাহলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম একটি বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছিলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ১৫ই আগস্ট আর ২১শে আগস্ট ভয়াবহতার দিক থেকে একইরকম। ২১শে আগস্টের ঘটনা ছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, রাষ্ট্রীয় মদদে এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে। সেই গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর কোথায় ছিল আমাদের সুশীল সমাজ? ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম এটাকে জালিয়ানওায়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সাথে তুলনা করেছিলেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলাকালে আদালতের ভেতরে অবস্থান নিয়েছিলেন ডা. জাফরল্লাহ চৌধুরী, যুদ্ধাপরাধীদের লবিস্ট ডেভিড বার্গম্যানসহ বিচারপ্রক্রিয়া বানচাল করতে রাজাকার মীর কাশিম আলীর অর্থায়নপুষ্ট আরো অনেকেই। বিচার চলাকালে তারা আদালত অবমাননাকর বক্তব্য দিচ্ছিলেন, বার্গম্যান তার ব্লগে রাজাকারদের মানবাধিকার নিয়ে বিতর্কিত লেখা লিখছিলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী আদালতের ভেতরেই বিচারকের সরাসরি সমালোচনা করে কথা বলছিলেন। তাদের সাথে সেসময় উপরোক্ত তালিকার মানবাধিকার কর্মীদের অনেকেই ছিলেন।

এর প্রেক্ষিতে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয় তাদের ওপর। তাদেরকে সাজাও দেওয়া হয়। এই সাজার প্রেক্ষিতে সেসময় অর্ধশতাধিক তথাকথিত মানবাধিকারের দোকানদার সাক্ষর করে যুদ্ধাপরাীদের বিচারকে সমালোচনা করে বিবৃতি দেন। একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের গণহত্যা, ৬-৮ লাখ নারীর সম্ভ্রম হারানো, লাখো শিশুহত্যা, সমগ্র দেশ মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ মানবাতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ চলছে, আর সেই বিচার বাধাগ্রস্ত করে তাকে মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান বলে দাবি করছে এই রাক্ষসরা! ভেবে দেখুন তো একবার?
সেসময় আদালতের বক্তব্যের একটি অংশ এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি। তাহলে বোঝা যাবে, এদের মানবাধিকারের দৌড় আসলে কতটা।

ট্রাইবুনাল-২ এ পিনপতন নিরবতা। বিজ্ঞ আদালত বিনয়ের সাথে ডাকলেন অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, আলী আহমেদ জিয়া উদ্দিন, রাহনুমা আহমেদ এবং শিরিন হককে। আদালত প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, “ডেভিড বার্গম্যান তার ব্লগে কী কী লিখেছেন বা লিখেন এসব আপনারা পড়েছেন? এসব ভালো করে পড়ে কি আপনারা বিবৃতি দিয়েছিলেন?”
আহ্বানকৃত ব্যাক্তিদের ভেতর তখন অস্বস্তি শুরু হয়েছে। একজন ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করতে যাচ্ছিলেন, বিজ্ঞ আদালত তাঁর প্রশ্নে স্থির থাকলেন, “শুধু বলেন পড়েছেন নাকি পড়েননি?” উত্তর এলো, “না, পড়ে দেখিনি।” মাননীয় আদালত তখন দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন তাদের, “ডেভিড বার্গম্যানের আদালত অবমাননার মামলার পুরো রায়টা কি পড়ে দেখেছিলেন বিবৃতি দেবার আগে?” এবার আদালতে কবরের নিস্তব্ধতা। আনু মোহাম্মদ একটা ব্যখ্যা দিতে চেষ্টা করলেন।

আদালত তখন খুব আক্ষেপের সাথে বললেন, ডেভিডের ব্লগ পড়েননি, ডেভিড কী লিখেছেন তাও জানেন না, তার বিরুদ্ধে আসা রায়টাও পড়েননি আর চট করে একটা বিবৃতি দিয়ে দিলেন ৪৯ জন মিলে? দুম করে বলে দিলেন দেশে বাক স্বাধীনতা নাই? আদালতে তখনও কবরের গাঢ় নীরবতা বিরাজ করছিলো।

লক্ষ্য করুন, এরা সরকারকে বিতর্কিত করতে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতে, মুক্তিযুদ্ধ এবং গণহত্যাকে অস্বীকার করতে সবসময় সোচ্চার। মুখে এরা প্রগতির কথা বলে, আদর্শের কথা বলে, কিন্তু তাদের কার্যকলাপ পাকিস্থানের এজেন্ডার সাথে একসূত্রে গাঁথা। উপরোক্ত ২৭ জনের ১/২ জন বাদ প্রত্যেকেই বার্গম্যানের সাজার প্রতিবাদে তার অপরাধ এবং রায় সম্পর্কে না জেনেই গণহারে সাক্ষর করে দিলেন, কাণ এখানে সরকারবিরোধিতার একটা স্কোপ রয়েছে, সেটা বুঝতে পেরেই।

মাঝে মাঝে উদ্ভট বক্তব্য দিলেও ডা. জাফরুল্লাহর মূল এজেন্ডা দেশে জামায়াত-শিবির এবং হেফাজতের উগ্রবাদী নেতাদেরকে ক্ষমতায় বসানো। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় হেন কোনো চেষ্টা বাদ দেননি তিনি। আদালত অবমাননার দায়ে তাকে জরিমানাও করেছিল মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনাল। সেসময় জরিমানা না দিয়ে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার সাজা গ্রহণ করেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী জঙ্গিবাদের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থনও প্রকাশ করেছেন অনেক বছর ধরে। সরকার যখন জঙ্গি দমনে কঠোর হয়েছিল, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জঙ্গিদের আটক, তাদের আস্তানা গুড়িয়ে দেওয়া এবং জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল, তখন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে সুর মিলিয়ে জাফরুল্লাহও সরকারের সমালোচনা করে দাবি করেছিলেন, সরকার নাকি জঙ্গি নাটক করছে, সবই সাজানো কর্মকাণ্ড। চিহ্নিত জঙ্গিদের আটক করার পরেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা না করে, বুঝিয়ে-শুনিয়ে ভালো পথে আসার আহ্বান দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার মত দাবি করেছিলেন। জঙ্গি অভিযানে নিহত জঙ্গিরা কেন মারা পড়ল- এ নিয়েও মায়াকান্না করেছেন এই দেশদ্রোহী ভণ্ড চিকিৎসক।

জিয়াউর রহমানের দুই নিকটতম ঘনিস্ঠজন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্ক কি বলেনঃ

তাঁর স্ত্রীর খালেদা জিয়ার বক্তব্যঃ

“মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। বলা হয়, এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে, আসলে কত শহীদ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, এটা নিয়েও বিতর্ক আছে।শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না”।

তাঁর ছোট ভাই প্রয়াত আহমেদ কামালের বক্তব্যঃ

“৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং প্রায় তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলে গেলে চলবে না। এটাকে সামনে রেখে জাতিকে এগিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী দালালদের দ্বারা অনেক মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা, নিরীহ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীকে তারা হত্যা করেছে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাংলাদেশের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়ে গেছেন।”
বহু মুক্তিযুদ্ধা রাজাকার হয়েছেন, কিন্ত কোন রাজাকার মুক্তিযুদ্ধা হয়নি’ জাফারুল্লাহ তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

ম্যাল্টন, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles