10.5 C
Toronto
শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪

কমন-সেন্সের বাইরে…

কমন-সেন্সের বাইরে...
মুহম্মদ জাফর ইকবাল

এক

আমি আমার দীর্ঘ জীবনে যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখেছি, এর মধ্যে একটি হচ্ছে পৃথিবীর যে কোনো জটিল বিষয় এলে কমন-সেন্স দিয়ে মোটামুটি বুঝে ফেলা যায়। একেবারে পুরোটা বোঝার জন্য হয়তো বড় বড় বিশেষজ্ঞ দরকার হয়। কিন্তু কাজ চালানোর মতো বোঝার জন্য কমন-সেন্সই যথেষ্ট- বিষয়টি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই হোক আর আমাদের ইভিএম মেশিনই হোক। তাই হঠাৎ করে যখন কোনো একটি বিষয় আমরা কমন-সেন্স দিয়ে বুঝতে পারি না, তখন খুব অসহায় বোধ করি। আমার হঠাৎ করে এ রকম একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলি।

- Advertisement -

আমার ধারণা, মাধ্যমিক পর্যায়ের ৮০-৯০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই এমপিওভুক্ত ও রেজিস্টার্ড বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় পড়াশোনা করে। আমাদের ওই স্কুলগুলোয় শিক্ষকের বিশাল ঘাটতি আছে। সংখ্যাটি কত হতে পারে, এর সঠিক হিসাব আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু পত্রপত্রিকায় ৮০ থেকে ৮৫ হাজার- এ রকম একটি সংখ্যা দেখেছি। খুব স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকের ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, একবারে ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে

শিক্ষক নেওয়ার প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট মানসম্মত। ¯œাতক-মাস্টার্স করা তরুণ-তরুণীরা নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে ‘নিবন্ধন সনদ’ অর্জন করেছেন এবং শিক্ষক হিসেবে শুধু তাদেরই নিয়োগ দেওয়া হবে। কাজেই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কাজটি এখন খুবই স্বচ্ছ ও সহজ হওয়ার কথা। যাদের সনদ আছে, তাদের থেকে ক্রমানুসারে ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলে শিক্ষক ঘাটতির একটি বড় অংশ পূরণ হয়ে যেত। এর চেয়ে বড় কথা, এ দেশের অসংখ্য যোগ্য মানুষ এই চাকরির জন্য বসে আছে। তাদের জীবনে একটি নিশ্চয়তা আসত। প্রধানমন্ত্রী বলেও রেখেছেন মুজিববর্ষে কেউ বেকার থাকবে না। তবে মোটামুটি হতবাক হয়ে সবাই আবিষ্কার করল ৫৪ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নতুন শিক্ষক নেওয়া হলো মাত্র ১৪ হাজার। অথচ নিয়োগ দেওয়ার মতো প্রার্থীর কোনো অভাব নেই। তারা রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে ‘নিবন্ধন সনদ’ অর্জন করে অনেক বছর থেকে অপেক্ষা করে বসে আছেন।

ব্যাপারটি এখানে শেষ হলে একটি কথা ছিল। এর সঙ্গে যেটি হয়েছে, সেটি রীতিমতো হৃদয়বিদারক! ৫৪ হাজার পদের ভেতর আরও ২২ হাজার পদে কাগজ-কলমে নিয়োগ দেওয়া হলো। কিন্তু তারা সবাই আগে থেকে চাকরি পেয়ে বসে আছেন। তারা আসলে এক জায়গা থেকে তাদের পছন্দসই অন্য জায়গায় বদলি হয়েছেন। এখানেই শেষ নয়। বাকি যারা আছেন, তাদের নিয়োগ দেওয়া গেল না। কারণ ‘উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যায়নি।’ যারা এ বিষয়ের প্রক্রিয়াটি তদারক করেন (এনটিআরসিএ), তাদের কাছে নিশ্চয়ই এর কোনো এক ধরনের ব্যাখ্যা আছে। তবে আমি আমার কমন-সেন্স দিয়ে সেটি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। স্কুলের শিক্ষকের প্রয়োজন, শিক্ষক হওয়ার যোগ্য তালিকাভুক্ত প্রার্থী এরই মধ্যে পরীক্ষা নিয়ে খুঁজে বের করে রাখা হয়েছে, শিক্ষকের অসংখ্য শূন্যপদও আছে। অথচ নিয়োগ দেওয়ার বিশাল দজ্ঞ-যজ্ঞ করার পরও পদগুলো খালি রয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষকপ্রার্থীরা এই ধরনের বেশকিছু নির্মম রসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে শাহবাগের কাঠফাটা রোদে বসে গণঅনশন করছেন। কিন্তু কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এ দেশে সবচেয়ে নির্যাতিত প্রজাতি হচ্ছে শিক্ষকরা। তাদের থেকেও হতভাগা যদি কেউ থাকেন, তা হলে তারা হচ্ছেন শিক্ষক হওয়ার যোগ্য সনদ পাওয়া এই প্রার্থীরা। বিষয়টি যথেষ্ট নির্মম। আমি সেটি জানতে পেরেছি এই প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে (আমি তাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। নিজেদের দুঃখ ও বঞ্চনার কথা বলে গিয়ে অনেকেই চোখের পানি ফেলেছে)। কোনো একটি অত্যন্ত বিচিত্র কারণে চাকরির জন্য প্রার্থীদের আলাদা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে হয়। তবে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে, তারা একবার আবেদন করবেন। ওই আবেদনের ভিত্তিতে একটি তালিকা করে রাখা হবে এবং যখন যেখানে ফাঁকা হবে, তখন সেখানে এই তালিকা থেকে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। কম্পিউটারের এই যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশ- যেখানে সব মানুষের বায়োমেট্রিক এনআইডি আছে, সেখানে পানির মতো সহজ এ কাজটি করা হয় না। সব প্রার্থীকে সব স্কুলে আবেদন করতে হয়। কাজেই অনেক শিক্ষক পদে প্রার্থীরা চাকরি পাওয়ার জন্য নিজেদের জমি বিক্রি করে একটি নয়, দুটি নয়- এক হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেন! প্রতিটি আবেদনের জন্য যদি ১৫০ টাকা খরচ হয়, তা হলে প্রার্থীর কত টাকা খরচ হয়- কেউ সেটি হিসাব করে দেখেছেন? একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কমন-সেন্সের অভাবে চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ে এই নির্মম রসিকতা করা হচ্ছে, নাকি ইচ্ছা করে-চিন্তাভাবনা করে তাদের এভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে- সেটি কে আমাকে বুঝিয়ে দেবেন?

স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হচ্ছে। একেকবার একেকটি পরীক্ষায় প্রার্থীরা একেক নম্বর পায়। পদ্ধতির পরিবর্তন হলে মূল্যায়নের সবকিছুই ওলট-পালট হয়ে যায়। তাই যদি সবাইকে নিয়ে মেধা তালিকা করা হয়, তা হলে কোনো কোনো ব্যাচ লাভবান হবে এবং কোনো কোনো ব্যাচের একেবারে বিনা কারণে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এগুলো সমন্বয় করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও আছে। সেগুলো প্রয়োগ না করে চাকরিপ্রার্থীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হলে সেটি হবে চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা।

আমি আরও একটি বিষয় এখনো পুরোপুরি জানতে পারিনি। সেটি হচ্ছে শিক্ষকের চাকরির জন্য সব নিবন্ধন পরীক্ষা মিলিয়ে সনদ পাওয়া প্রার্থীর প্রকৃত সংখ্যা কত? যেহেতু একজন এক হাজার স্কুলে আবেদন করে ফেলেন আবার অনেকেই একাধিক সনদ অর্জন করতে পারেন, অনেকেই অন্য কোথাও চাকরি পেয়ে চলে গেছেন, অনেকে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন- সেহেতু আবেদনের সংখ্যা থেকে প্রকৃত সংখ্যা বের করা কঠিন (ডিজিটাল বাংলাদেশে সেটি বের করা পানির মতো সোজা হওয়ার কথা। কিন্তু কেন এটি গোপন রাখা হচ্ছে, সেটি একটা রহস্য)।

দুই

যারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন, তাদের ধারণা- প্রার্থীর সংখ্যা বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকের যে কয়টি পদ ফাঁকা আছে, ওই সংখ্যা থেকে খুব বেশি হবে না। এর অর্থ, ঠিকভাবে এ প্রক্রিয়াটি শেষ করা হলে এটি একটি জাতীয় হতাশা ও ক্ষোভের ব্যাপার না হয়ে স্কুলে স্কুলে নতুন শিক্ষক পাওয়া এবং অসংখ্য তরুণ-তরুণীর চাকরি পাওয়ার মতো আনন্দময় একটি ব্যাপার হতে পারত! সরকারের বিড়ম্বনাময় ব্যর্থ ইতিহাস না হয়ে এটি সরকারের সাফল্যগাথা হতে পারত। তবে সেটি নাও হতে পারে। এর কারণ আমাকে বলা হয়েছে। এনটিআরসিএ নিজেই জানিয়েছে, দেশে নাকি ৬০ হাজার ‘জাল নিবন্ধন সনদধারী’ আছে। তাদের মধ্যে এক হাজারের বেশি জাল সনদধারী চাকরি পাওয়া শিক্ষককে তাদের বেতনের টাকা ফেরত দিতে আদেশ দেওয়া হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশে- যেখানে সবার বায়োমেট্রিক এনআইডি আছে, সেখানে জাল সনদ বের করা রীতিমতো অসম্ভব একটি কাজ। এর পরও দুর্বৃত্তদের যে বিশাল প্রতিভাবান দল সবাইকে নিয়ে অসম্ভব একটি চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে এই অসাধ্য সাধন করেছেন, তাদের ‘অভিনন্দন!’ তবে যে শিক্ষকরা জাল সনদ নিয়ে ছাত্রছাত্রীকে পড়াচ্ছেন, তারা ক্লাসে চুরি-ডাকাতি-প্রতারণা করানোর বাইরে আর কী পড়ান- এটি আমার জানার খুব কৌতূহল।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles