10.8 C
Toronto
রবিবার, মে ৫, ২০২৪

পপি ফুল এবং একটি কবিতা

পপি ফুল এবং একটি কবিতা
ফাইল ছবি

প্রতি বছর কানাডাতে ১১ নভেম্বর রিমেমব্রান্স ডে হিসেবে পালিত হয়। ওই দিন সারা কানাডা জুড়ে কোটি কোটি মানুষ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ বুকের বাম পাশে পপি ফুল ধারণ করেন। সকাল ১১টায় দুই মিনিটের জন্যে নীরবতা পালন করেন। শহীদদের উদ্দেশে নিবেদিত বেদীগুলোতে ফুল-মাল্য দান করেন। পাঠ করেন ১৯১৫ সালে রচিত এক কানাডীয় কবি ও সেনা কর্মকর্তার লেখা কবিতা। সেই কবির নাম জন ম্যাক রে (১৮৭২-১৯১৮)। আর বিশ্ববিখ্যাত সেই যুদ্ধকবিতাটির নাম ‘ইন দ্য ফ্লান্ডারস ফিল্ডস’।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৯১৮ সালের এই দিনটিতে। হিসেবটি অনেকটা এমন, ১১তম মাসের ১১তম দিনের ১১তম ঘণ্টা। পরের বছর থেকে দিনটিকে উদযাপন করা শুরু হয়। শুরুতে দিনটির নাম ছিল ‘আরমিসটিস ডে’। ব্রিটিশ কমনওয়েথের সবকটি দেশেই দিনটি পালন করা হতো গভীর শ্রদ্ধায়। ১৯৩১ সাল থেকে কানাডাতে দিনটিকে রিমেমব্রান্স ডে হিসেবে অভিহিত করা হয়।

- Advertisement -

এই দিনে বুকের উপর হৃদয়ের খুব কাছাকাছি পপি ফুল ধারণের যে ঐতিহ্য সেটি শুরু হয়েছিল ১৯১৮ সালে। নিউইয়র্কে ওভারসিজ ওয়াইএমসিএ-তে তখন কর্মরত ছিলেন মনিকা মিশেল (১৮৬৯-১৯৪৪)। সদ্যসমাপ্ত যুদ্ধকে মনিকা দেখেছিলেন অনেক কাছ থেকে। ১৯১৭ সালে মনিকা জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হন। সে-কাজে ছুটি নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিলেন ওয়াইএমসিএ-তে। ১৯১৮ সালের ৯ নভেম্বর নিহত বীরদের সম্মানে তিনি একাকী পাঠ করেন জন ম্যাক রে রচিত বিখ্যাত কবিতা ‘ইন দ্য ফ্লান্ডারস ফিল্ডস’। প্রবল আবেগে একটি পপিফুলকে বুকে লাগিয়ে রাখেন। নিজেও রচনা করেন একটি কবিতা ‘উই শ্যাল কিপ দ্য ফেইথ’। যুদ্ধ শেষ হলে মনিকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান। যুদ্ধে পঙ্গু সৈনিকদের সাহায্যার্থে তিনি সিল্ক দিয়ে বানানো পপি বিক্রি করতে শুরু করেন। এরপর ক্রমে ক্রমে রিমেমব্রান্স ডে-তে বুকের উপর পপিফুল ধারণ একটি প্রচলন হয়ে দাঁড়ায় পুরো উত্তর আমেরিকাজুড়ে।

যুদ্ধ শেষ হবার আগেই কিন্তু ম্যাক রে যথেষ্ট পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিলেন কবি হিসেবে। কানাডীয় সেনাবাহিনির মেজর পদাধিকারী জন মাঝে মধ্যেই কবিতা লিখতেন বলে জানা যায়। ১৯১৫ সালে সার্জন হিসেবে জন কর্মরত ছিলেন বেলজিয়ামে। ২ মে তারিখে যুদ্ধরত অবস্থায় তাঁর চোখের সামনে মারা যান জনের বন্ধু অ্যালেক্সিস হেলমার। বন্ধুর শেষকৃত্যের দায়িত্বও পালন করতে হয় তাঁকে। চোখের জলে শেষ বিদায় জানান বন্ধুকে। অন্যান্য অনেক নিহত সৈনিক এবং বন্ধু অ্যালেক্সিসের সেই কবরস্থান পপি ফুলের কার্পেটে ঢেকে দেওয়া হয়। পরদিন অ্যাম্বুলেনেসের পেছনে বসে ওই পপি-ছাওয়া কবরস্থান দেখে জন রচনা করেন ‘ইন দ্য ফ্লান্ডারস ফিল্ড’ নামের কবিতাটি। মাত্র কুড়ি মিনিটে সেটি রচনা করেন জন (পৃ. ৪৬, ‘জন ম্যাক রে’, জন বাসেট, ফিটজারনি অ্যান্ড হোয়াইটসাইড লি., মারকহাম, ১৯৮৪)।
পূর্ণ কবিতাটি হলো:

In Flanders fields the poppies blow
Between the crosses, row on row,
That mark our place; and in the sky
The larks, still bravely singing, fly
Scarce heard amid the guns below.

We are the Dead. Short days ago
We lived, felt dawn, saw sunset glow,
Loved and were loved, and now we lie,
In Flanders fields.

Take up our quarrel with the foe:
To you from failing hands we throw
The torch; be yours to hold it high.
If ye break faith with us who die
We shall not sleep, though poppies grow
In Flanders fields.

পনেরো পঙ্ক্তির ওই কবিতায় যেন মৃত সৈনিকদের কণ্ঠ শুনতে পাওয়া যায়। জীবিত-জনদের প্রতি তাঁদের প্রত্যাশার কথা, আকাক্সক্ষার কথা। আমরা জীবিতেরা যেন দেশের জন্যে প্রাণবলিদানকরা ওই মানুষদের বিশ্বাস ভঙ্গ না করি, যেন তাঁদের কথা ভুলে না যাই।

বন্ধুমহলে কবিতাটি অনেক আলোচনা ও প্রশংসা পেতে থাকে। ওই বছরের ৮ ডিসেম্বর সেটি প্রকাশিত হয় ‘পাঞ্চ’ নামের এক পত্রিকায়। প্রথম প্রকাশে কবির নাম ছিল না। পরবর্তী কালে কবিতা আরও বহু পত্রিকাতে মুদ্রিত হয়। নতুন নতুন মুদ্রণে সেটিতে কবির নাম উল্লেখও করা হয়। ক্রমে কোটি কোটি মানুষের প্রিয় কবিতা হয়ে দাঁড়ায় জন ম্যাক রে রচিত ওই কবিতা। যুদ্ধবিরোধী একটি অনন্য কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি জোটে।

অনেক বেদনার যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগেই জনের মৃত্যু হয়। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি কবি জন ম্যাক রে মারা যান। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘ইন দ্য ফ্লান্ডারস ফিল্ডস অ্যান্ড আদার পোয়েমস’। মোট ঊনত্রিশটি কবিতার সংকলন। পত্রিকায় প্রকাশের কালানুক্রম দেখলে বোঝা যায় তরুণ বয়স থেকেই জন কবিতা লেখার চর্চা করে যাচ্ছিলেন। ১৮৯৪ সালে বাইশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম ছিল ‘দ্য হোপ অব মাই হার্ট’। ‘ইন দ্য ফ্লান্ডারস ফিল্ডস’-এর পরে একমাত্র যে কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল সেটি হলো ‘দ্য অ্যাংশাচ ডেড’।
২০১৫ সালে টরন্টোর ডানডার্ন থেকে প্রকাশিত ‘ইন দ্য ফ্লান্ডারস ফিল্ডস অ্যান্ড আদার পোয়েমস’-ও সংস্করণে জন ম্যাক রে-র লেখা ডায়েরির অনেকগুলো পাতা মুদ্রিত আছে। ২ মে তারিখে বন্ধু অ্যালেক্সিস মারা যাবার কথাও আছে সেখানে (পৃ. ৮৩)।

ওই কবিতাটি প্রকাশের শতবর্ষ পূর্তিতে ২০১৫ সালে টরন্টো থেকে প্রকাশিত হয়েছিল মূল্যবান একটি গ্রন্থ ‘ইন দ্য ফ্লান্ডারস ফিল্ডস: ১০০ ইয়ারস’। প্যাট্রিক লেইন, মার্গারেট অ্যাটউড, ফ্রান্সিস ইতানি, জর্জ ইলিয়ট ক্লার্ক, জোশেফ বয়ডন প্রমুখ খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকেরা সেখানে লিখেছেন ওই কবিতা নিয়ে, কবিতাটির কবিকে নিয়ে, যুদ্ধ নিয়ে, যুদ্ধ-বিষয়ক কবিতা নিয়ে।

জন ম্যাক রে-র একটি প্রামাণ্য জীবনী প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। শিরোনাম ‘অ্যা ক্রাউন অব লাইফ: দ্য ওয়ার্ল্ড অব জন ম্যাক রে’। লেখক ছিলেন ডায়ান গ্রেভস। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল আরেকটি জীবনীগ্রন্থ- ‘জন ম্যাক রে: বেয়ন্ড ফ্লান্ডার্স ফিল্ডস’। সেটির লেখক হলেন সুজান রাবি-ডান। উল্লেখ করা উচিত হবে যে, সুজান ২০১২ সালে জনের গল্প নিয়ে প্রথম বই লেখেন। সেটির শিরোনাম ছিল ‘বনফায়ার: দ্য চেস্টনাট জেনটেলম্যান’। ২০১৮ সালে সুজান আরেকটি উপন্যাসিকা রচনা করেছেন জনের যুদ্ধদিনের কথা নিয়ে।

মনিকা মিশেল ১৯৪১ সালে একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। শিরোনাম ছিল ‘দ্য মিরাক্যাল ফ্লাওয়ার: দ্য স্টোরি অব দ্য ফ্লান্ডারস ফিল্ডস মেমোরিয়াল পপি’। ওই গ্রন্থে বিস্তারে লিখেছেন মনিকা কীভাবে পপি হয়ে উঠলো উত্তর আমেরিকার জাতিয় ঐতিহ্যের প্রতীক। জানা যায় জন ম্যাক রে-র কবিতা পড়ে মনিকা নিজেও আরেকটি কবিতা লিখেছিলেন যেটির শিরোনাম ছিল ‘উই শ্যাল নট ¯স্লিপ’। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে মনিকা-রচিত কবিতাটি আমরা নিচে উপস্থাপন করলাম:

In Flanders fields the poppies blow
Between the crosses, row on row,
That mark our place; and in the sky
The larks, still bravely singing, fly
Scarce heard amid the guns below.

We are the Dead. Short days ago
We lived, felt dawn, saw sunset glow,
Loved and were loved, and now we lie,
In Flanders fields.

Take up our quarrel with the foe:
To you from failing hands we throw
The torch; be yours to hold it high.
If ye break faith with us who die
We shall not sleep, though poppies grow
In Flanders fields.

‘দ্য ফ্লান্ডারস ফিল্ডস’ কবিতা রচনার শতবর্ষে ২০১৫ সালে কবির জন্মস্থান গুয়েল্ফ শহরের সিভিক সেন্টারের সামনে জন ম্যাক রে-র একটি ব্রোঞ্জমূর্তি স্থাপন করা হয়। সে-অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কানাডার তৎকালিন গভর্নর জেনারেল ডেভিড জনস্টন।

ইষ্টইয়র্ক, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles