13.2 C
Toronto
রবিবার, মে ৫, ২০২৪

খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন দিবস

খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন দিবস - the Bengali Times
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল ছিল বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল ছিল বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ২৮৯ দিন বন্দি থাকার পর পাকিস্তান কারাগার থেকে বেরিয়ে এই দিনে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। বর্তমান প্রজন্মের অনেককেই জানে না কেমন ছিল সেদিনের সেই দিনটি। অথবা কী ঘটেছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি? ইতিহাস সাক্ষী দেয়, অনেক খল রাজনীতি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাসের পাতা ও বাঙালির মন থেকে মুছে দিতে। কিন্তু আজ বাংলাদেশের নাগরিক মাত্রই জানে যে মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানের পর যে দুটি শ্লোগান সকলের বুকে শক্তি যোগাতো তা ছিল ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’। সেই শেখ মুজিব বন্দী দশা থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলার মাটিতে ফিরে আসাতেই বিজয়ের আনন্দ শতভাগ পূর্ণ হয়ে যায়।

পাকিস্তানের পি আই এ’র একটি বিশেষ বিমান রাওয়ালপিন্ডি থেকে উড্ডয়নের সাথে সাথে পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেছিল ‘পাখিটি উড়ে গেছে’। স্মরণ করা যেতে পারে বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের পর পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী তাদের প্রেসিডেন্টের কাছে সংকেত পাঠিয়েছিল ‘বড় পাখিটাকে খাঁচায় বন্দী করা হয়েছে’। ভুট্টোর এই উক্তি ৮ জানুয়ারি প্রচার হতেই দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসতে শুরু করে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের দিকে। মাত্র দুটো দিনই ছিল যথেষ্ট। প্রতিটি জেলা মহকুমা গ্রাম থেকে লোক নেমে এসেছিল শ্লোগান দিতে দিতে। সেদিন ঢাকার রাজপথে যারা নেমে এসেছিল তারা কোনদিন ভুলতে পারবে না তাদের জীবনের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। দিনটি ছিল সোমবার। রৌদ্রজ্জ্বল এই দিনটি সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য একটি বিশেষ দিন হওয়ায় সেদিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল।

- Advertisement -

পাকিস্তান কারাগার থকে মুক্তি দিয়ে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। প্রথমে ভুট্টো বলেছিল তেহরান যাবার কথা কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাজি না হওয়াতে পরে লন্ডনের নাম বলা হলে বঙ্গবন্ধু তাতে সম্মতি দেন। ৯ জানুয়ারি সকাল আটটা ত্রিশ মিনিটে তিনি হিথরো বিমান বন্দরে নামেন। বিমানবন্দরে ফরেন অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসে বলেন ব্রিটিশ সরকার আপনাকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছে তাই আপনাকে ভি আই পি লাউঞ্জ থেকে ক্লারিজেস হোটেলে (Claridge’s Hotel) নিয়ে যাওয়া হবে। এই হোটেলের বল রুমে বসেই রাষ্ট্রপতি হিসাবে বঙ্গবন্ধু জীবনের প্রথম প্রেস কনফারেন্সে যোগ দেন। এখানে তিনি বলেন, আমি আজ মুক্ত অবস্থায় আমার দেশবাসীর সাথে সীমাহীন স্বাধীনতার আনন্দ ভাগ করতে চাই। তিনি আরো বলেন মুক্তির মহা কাব্যিক সংগ্রাম শেষে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি এবং অবশ্যই এখনেই তিনি সর্বপ্রথম বিশ্বের কাছে সাহায্য সহযোগিতা কামনা করেন।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ এই অকস্মাৎ ভিজিটের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ছিলেন লন্ডনের বাইরে। পরবর্তীতে (১৯ জানুয়ারি) এক তারবার্তায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিকসনকে লিখেছিলেন, শেখ মুজিবকে বহনকারী বিমানটি অবতরণের এক ঘণ্টা আগে আমরা জানতে পারি যে তাঁকে লন্ডনে নিয়ে আসা হচ্ছে। ব্যাপারটা এতোই গোপনীয় ছিল। তাতে কি, ইতিমধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা যিনি পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সেই হেরল্ড উইলসন এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে গিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে দেখা মাত্র তিনি বলেছিলেন ‘গুড মর্নিং মিস্টার প্রেসিডেন্ট’। অথচ তখনো ইংল্যান্ড বাংলাদেশকে নতুন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয় নি। বাস্তবতা হল শুধু ভারত এবং ভুটান ছাড়া অন্য কোন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে তখনো স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসে নাই। এদিকে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী বাদ দিয়েই প্রধানমন্ত্রী হিথ তাঁর নিবাস ও কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। তিনি তাঁর অফিসের বাইরে এসে নিজ হাতে গাড়ির দরজা খুলে দেন। এমন কাণ্ড সচরাচর দেখা যায় না। এর জন্য তাঁকে পার্লামেন্টে প্রশ্ন করা হয়েছিল। এভাবেই শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশ সরকারের সাথে অন্যদেশের রাষ্ট্র ও সরকারের আনুষ্ঠানিকতা।

ব্রিটিশ সরকার ভালো করেই জানতো যে বিদেশের মাটিতে অবস্থানরত প্রবাসী সরকারের সিদ্ধান্তেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছিলেন। এ সত্যটুকু জানা স্বত্বেও পাকিস্তান, আমেরিকা সহ মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সাথে বিরাজমান সম্পর্ক অটুট রেখেও বাংলাদেশের এই মহান নেতাকে তারা পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে দ্বিধা করে নাই। এর থেকেই আন্দাজ করা যায় বিশ্ব অপেক্ষা করছিল ভারত অঞ্চলে একজন নতুন নেতার জন্য। ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গবন্ধু অনুরোধ করেছিলেন যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে যেন বাংলাদেশে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও তাঁকে বহন করার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ৭০৭ বিশেষ বিমান হিথরোতে অপেক্ষা করছিল তবু তিনি ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর কমেট জেটে করে দেশের পথে রওনা দেন।

ডঃ কামাল হোসেন এবং তাঁর পরিবারকে সাথে নিয়ে (তিনিও পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়) বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে দিল্লি বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালে সেখানেও বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও লাল গালিচা সম্বর্ধনা দেয়া হয়। তাঁর সম্মানে গান স্যালুট দেয়া হয়। সেই প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধানকে বিদেশী রাষ্ট্র সম্মান জানালো। একটি দেশের রাষ্ট্র প্রধান (ভি ভি গিরি) সরকার প্রধান (ইন্দিরা গান্ধী) সেই দেশের মন্ত্রী পরিষদ, তিন বাহিনীর প্রধানদের দ্বারা স্যালুট গ্রহণ, শত শত দেশি বিদেশী সাংবাদিক এবং ৩২ টি দেশের কূটনীতিকদের উপস্থিতি বাংলাদেশের পক্ষে দৃশ্যমান স্বীকৃতির প্রকাশ পেল দিল্লি বিমানবন্দরে। দিল্লি বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধু বলেন, কারো প্রতি কোন ঘৃণা না রেখেই আমি ফিরে যাচ্ছি আমার দেশে।

দিল্লি বিমানবন্দরের সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিকতার পর মোটর শোভাযাত্রা করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লি প্যারেড গ্রাউন্ডে একটি পাবলিক মিটিং এ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর যখন বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ ইংরেজিতে শুরু করেন তখন জনতার সারী থেকে জোর দাবী উঠে বাংলায় ভাষণ দেয়ার জন্য। তিনি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর দিকে তাকালে ইন্দিরা গান্ধীও একই অনুরোধ করেন। খুশিতে প্রাণখোলা একটি হাসি দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দিতে শুরু করেন এই বলে, ‘আমার ভাই ও বোনেরা’। সাথে সাথে উল্লাস ও করতালিতে সেই ভাষণকে স্বাগত জানায় উপস্থিত জনসাধারণ। রাষ্ট্রীয় ভাবে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের এটাই ছিল সর্বপ্রথম জন সমাবেশে ভাষণ। এই ভাষণে তিনি বলেন আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য ও সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছে চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না… আমাকে প্রশ্ন করা হয় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির সাথে আপনার আদর্শের এত মিল কেন? আমি বলি এটা আদর্শের মিল, এটা নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল এটা বিশ্ব শান্তির মিল। পাবলিক মিটিং শেষ করে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলো নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে ভারতের সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি। তারপর সেখান থেকে আবারো বিমানবন্দর। ভারত সরকার একটা লম্বা বিরতি যাত্রা প্রস্তুত করে রেখেছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেগুলো সংক্ষিপ্ত করে আড়াই ঘণ্টা পরই দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির পত্রিকাগুলোর শিরোনাম ছিল চোখে পড়ার মত। প্রতিটি পত্রিকার শিরোনাম, সম্পাদকীয়, সংবাদ ছিল কাব্যিক উপমায় ভরা। দেখে মনে হয়েছিল যেন একজন কবিকে বরণ করতে যাচ্ছে জাতি। বহুল প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাক শিরোনাম ছিল ‘ওই মহামানব আসে দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে’। দৈনিক পূর্বদেশ লিখেছিল ‘ভেঙেছে দুয়ার এসেছে জ্যোতির্ময়’। সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর প্রতীক্ষায় ঢাকা নগরী”। বাংলাদেশ টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করেছে তাঁর আগমন দৃশ্য। কোলকাতার আকাশবাণী ধারাবিবরণী দিয়েছে। বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসও বিশেষ বুলেটিন প্রচার করেছিল। বাংলাদেশ বেতার থেকেও ধারাবিবরণী দেয়া হচ্ছিল। হেলিকপ্টারে উড়ে উড়ে ছবি তুলেছিল সাংবাদিকেরা। বাদ্যযন্ত্র আর জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে মুখরিত ছিল আকাশ বাতাস।

তেজগাঁও বিমান বন্দরে সিকিউরিটি দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল বাংলাদেশে সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ সহ ভারতীয় সেনাবাহিনী। এরপরও লোকের ভিড় ঠেকানো তাদের জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। খুব সংক্ষিপ্ত গার্ড অব অনার পর্ব শেষ করে একটি খোলা ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছান। তাতে সময় লেগে যায় দুই ঘণ্টারও বেশি। লক্ষাধিক লোকের স্রোত বয়ে গেছে সেদিনের তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ঢাকার রাজপথে। স্বাধীনতার বিজয় আনন্দ এই দিনেই পূর্ণতা লাভ করে। অতীতের সব জন-সমাবেশ ১০ জানুয়ারির জনস্রোতের কাছে ম্লান হয়ে যায়। তখনো অনেকে নফল রোজা করে যাচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আশায়। তাদের সেই নফল রোজার সমাপ্তি ঘটে এই দিনে। এই দিন বাংলার মানুষ নতুন করে বাঁচতে শেখে।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিনটিতে অনেক কেঁদেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিমানের সিঁড়ি থেকে শুরু করে রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেয়ার মুহূর্তেও তিনি সাদা রুমাল দিয়ে ঘন ঘন চোখ মুছেছেন। রাষ্ট্রনায়কত্ব দূরদৃষ্টি এবং ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা ভরা একই ব্যক্তির পরপর দুটি অলিখিত ভাষণ আছে, এমনটি পাওয়া খুবই বিরল। ৭ মার্চ ১৯৭১ পর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ একই স্থানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেই দুটি ভাষণই আজ ঐতিহাসিক ভাষণ। সম্ভবত এই দুর্লভ সৌভাগ্য আর অন্য কোন রাজনৈতিক নেতার কপালে জুটে নাই। শব্দ চয়ন, দর্শন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মানবিক দিক, রাজনৈতিক লক্ষ্য সব দিক দিয়ে বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ব্যাক টু ব্যাক ভাষণ আমাদের অনেক বড় সম্পদ। আজ হতে শত বছর পর যদি কেউ বঙ্গবন্ধুকে জানতে ইচ্ছে পোষণ করে তবে তাঁর এই দুটি ভাষণ সে ইচ্ছে পূরণে অনেকখানি কাজ করে দিবে। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠন ও টিকিয়ে রাখার যে চ্যালেঞ্জ জাতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল খোকাবাবুর (বঙ্গবন্ধুর ডাক নাম ছিল খোকা) প্রত্যাবর্তনের দিন থেকেই বাঙালি জাতি সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আশার আলো খুঁজে পায়।

সাদা রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করলেন ‘ভাই ও বোনেরা’… তারপর প্রায় ৪০ মিনিটের বক্তৃতার মাঝে মাঝে অনেকবার সেই সাদা রুমাল দিয়ে চোখ মুছেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন মুগ্ধ ভক্ত হয়েও বাঙালি জাতির সাহস ও ত্যাগের মহিমায় গর্বিত হয়ে তিনি তাঁর প্রিয় কবিকে এই দিনে আক্রমণ করে বসেন। কবির বানীকে খণ্ডন করে তিনি বলেছিলেন “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন সাত কোটি বাঙালিরে হে বঙ্গ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি, কবিগুরুর মিথ্যা কথা প্রমাণ হয়ে গেছে। ‘আমার বাঙালি’ আজ মানুষ”। অর্থাৎ যে বাঙালি এতদিন কবিগুরুর আশ্রয়ে বেঁচে ছিল বঙ্গবন্ধু সেই বাঙালিকে কবিগুরুর কাছ থেকে তুলে এনে বীর বাঙালির মর্যাদা দিয়ে নিজ দলভুক্ত করে নিয়ে বললেন ‘আমার বাঙালি’।

এছাড়াও সেদিন তিনি শক্রকে বলেছিলেন তোমাদের প্রতি আমার আক্রোশ নেই এবং এরই সাথে স্বদেশী মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং চিরদিন স্বাধীন থাকবে। বাংলাদেশকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সেদিনের সেই ভাষণের প্রতিটি কথা ভাব সম্প্রসারণ করে আমাদের ভাবনা জগতকে আরো ধারালো করতে হবে। আমাদের ভাবনাকে করতে হবে প্রসারিত। সেজন্য জানা দরকার তাঁর ভাষণ সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা। যারা অবহেলা করবে, তাঁকে অবজ্ঞা করবে তারা অনেক কিছু জানা থেকে বঞ্চিত হবে।

দশ মাস আগে পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে তেজগাঁও বিমানবন্দর দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গিয়েছিল। দশ মাস পর সেই একই বিমানবন্দরে তিনি রাষ্ট্রপতি পদ মর্যাদায় বাংলার মাটি স্পর্শ করেন। উল্লেখযোগ্য যে, রাষ্ট্রপতির শপথ না নিয়েও দেশে ফিরে আসার পথে বিদেশী রাষ্ট্র এবং সরকার প্রধান দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে সেদিন তাঁকে গান স্যালুট দেয়া হয়। বিমানবন্দর থেকে পরিবারের আপনজনের কাছে কিংবা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসায় অথবা রাষ্ট্রপতি ভবনে না গিয়ে জনতার নেতা সেদিন সরাসরি চলে গিয়েছিলেন জনতার কাতারে। এসবের মধ্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন নিজস্ব জীবন কিংবা পরিবারের আপনজন থেকেও তাঁর কাছে আপন ছিল বাংলার জনসাধারণ। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো জনতার সামনে তিনি আর একবার পরিষ্কার ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন ‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা। বাঙালি আমার জাতি। বাঙলা আমার ভাষা। বাংলার মাটি আমার স্থান’।

আজ এতো বছর পর ভাবতে বসেছি, একটি প্রত্যাবর্তন ১৯৭২ সালে কতগুলো রেকর্ড গড়েছিল? তাছাড়া এমন একজন নেতা যে আমাদের ছিল সে কথা কি আমরা সবাই জানি?

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles