2.6 C
Toronto
শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪

মহাদেব চক্রবর্তী : টরন্টোর বাঙালি সমাজের শ্রদ্ধা

মহাদেব চক্রবর্তী : টরন্টোর বাঙালি সমাজের শ্রদ্ধা - the Bengali Times
টরন্টোতে বাংলা ভাষার চর্চা নিয়ে জানতে হলে জানতে হবে ড মহাদেব চক্রবর্তীকে

(টরন্টোতে বাংলা ভাষার চর্চা নিয়ে জানতে হলে, জানতে হবে ড. মহাদেব চক্রবর্তীকে। গত ২৫ ডিসেম্বর ছিল ড. চক্রবর্তীর ৯৪তম জন্মবার্ষিকী। ২০১৯ সালে কানাডায় অবস্থানরত কৃতী এই বাঙালি শিক্ষাবিদের জন্মদিনকে সামনে রেখে একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ হয় আমার। যে বন্ধুরা আগে পড়েননি তাঁদের জন্যে সাক্ষাৎকারটি আবার ফেসবুকে দিলাম।)

টরন্টোর বাঙালি সমাজে মহাদেব চক্রবর্তী গভীর শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত একটি নাম। ঠাকুমার মৃত্যুকালে বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে বাবা পরিবার নিয়ে চলে যান ভারতের বেনারসে। পরে আর দেশে ফিরে আসা হয়নি পরিবারটির। বেনারসেই জন্ম নেন আজকের অবসরপ্রাপ্ত কৃতী অধ্যাপক ড. মহাদেব চক্রবর্তী। বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পদার্থ বিজ্ঞানে এমএসসি পাশ করেন তিনি। পরে পারমানবিক পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি ডিগ্রি নেন তিনি।

- Advertisement -

পশ্চিমবঙ্গের একটি কলেজে অধ্যাপনার সময়ে কর্তৃপক্ষের সাথে বনিবনা না হওয়ায় চাকরি হারান মহাদেব। ১৯৬৩ সালে ভাগ্যান্বেষণে উড়াল দেন কানাডার উইনিপেগ শহরের উদ্দেশে। পরে চাকরি পরিবর্তন করে চলে আসেন অন্টারিওর সাদবেরি শহরের কেমব্রিয়ান কলেজ অব টেকনোলজিতে। দীর্ঘ সাতাশ বছর এই কলেজেই পাঠদান করেছেন মহাদেব।

অবসর গ্রহণের পর স্থায়ী আবাস গাড়েন টরন্টো শহরের বাঙালি অধ্যুষিত ড্যানফোর্থ-ভিক্টোরিয়া এলাকায়। ১৯৯৯ সালে তাঁর উদ্যোগেই টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় বাংলা ভাষার কোর্স। ১২ বছর চলার পর সে-কোর্স একসময় বন্ধও হয়ে যায় অর্থাভাবে।

আড়াই দশক ধরে বাঙালিদের সাথেই ড. চক্রবর্তীর ওঠাবসা। কৌতুকপ্রবণ এই নবতিবর্ষ অতিক্রান্ত মানুষটির কথায় শ্লেষও বেশ লক্ষ করা যায়। সারাদিন ঘরে বন্দি বিজ্ঞানী এই অধ্যাপকের প্রধান কাজ গ্রন্থপাঠ। আগ্রহের বিষয় ধর্মের ইতিহাস, ভারত নামের দেশটির সুদূর অতীত এবং বাংলা সংস্কৃতি। বছর পাঁচেক আগে হঠাৎ করেই কোমড় অকেজো হয়ে যায় তাঁর। এখন সার্বক্ষণিক সঙ্গী হুইল চেয়ার। আগে কমিউনিটির সকল অনুষ্ঠানে নিয়মিত যাওয়া-আসা করলেও ইদানিং বের হওয়া কম হয় মহাদেবের। বেরনোর প্রধান প্রতিবন্ধকতা অনুষ্ঠানের ভেন্যুগুলো হুইল চেয়ার নিয়ে প্রবেশের উপযোগী না হওয়া। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে রয়েছে গ্রন্থের বিশাল এক সংগ্রহ। দিনে-রাতে জেগে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত এখনও কাটে বইয়ের সাথে। নিত্যদিনের চিন্তার বিষয় প্রবাসে বাঙালিদের জন্যে স্থায়ী কিছু উদ্যোগ। ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর মহাদেব চক্রবর্তীর বাসস্থলে তাঁর সাথে কথা বলার সুযোগ হয় আমার। পাঠকদের জন্যে এই রচনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ড. মহাদেব চক্রবর্তীকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

সুব্রত কুমার দাস: দাদা, নমস্কার।
মহাদেব চক্রবর্তী: নমস্কার। বোসো। বলো, কী বলবে?
সুব্রত: একটু গল্প করতে এলাম আর কী। তা, কেমন আছেন?
মহাদেব: আছি আর কী! হুইল চেয়ারে আটকে আছি পাঁচ বছর হলো। এখন ডাকের অপেক্ষা।
সুব্রত: মৃত্যুভয় তাড়িত করে?
মহাদেব: নাহ! ভাবি না। কবি বলেছেন না, “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে…।” বলো, কী বলতে এসেছ?
সুব্রত: বলতে আসিনি। শুনতে এসেছি।
মহাদেব: কী শুনবে! আমার কথা কেউ শোনে না।
সুব্রত: জ্ঞানের কথা শুনবো।
মহাদেব: কী যে বলো! আমিই তো জ্ঞানের পেছনে ছুটছি।
সুব্রত: তাহলে কিছু জ্ঞানের কথা শুনাই?

মহাদেব: তুমি আমাকে জ্ঞান দেবে? কিন্তু, আমি যে জ্ঞানের ভারে নুব্জ হয়ে আছি গো!
সুব্রত: তাহলে বলুন কানাডাতে কতো সালে এসেছিলেন?
মহাদেব: ১৯৬৩ সালে।
সুব্রত: কানাডার কোন শহর আপনার ডেস্টিনেশন ছিল তখন?
মহাদেব: উইনিপেগ। ৯ সেপ্টেম্বর ফ্লাই করি। ১০ তারিখ রাত ১২ বারোটায় টরন্টোতে ল্যান্ড করি। পকেটে ছিল ৮ ডলার ৫ সেন্ট।
সুব্রত: মানে কী! এতো টাকা? আচ্ছা মহাদেবদা, আমি কি একটু কাগজ-কলম বের করতে পারি?
মহাদেব: কাগজ-কলম বের করবে? তারপর আমাকে নিয়ে এদিক-সেদিক উল্টাপাল্টা লিখবে?
সুব্রত: কানাডায় পাড়ি জমানোর সময় বয়স কতো হয়েছিল আপনার?
মহাদেব: পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে আর কি!
সুব্রত: জন্ম কতো সালে হয়েছিল?
মহাদেব: ১৯২৭।
সুব্রত: জন্ম কি রাজশাহীতেই হয়েছিল?
মহাদেব: না। ঠাকুমার মৃত্যুকালে তাঁর আত্মার শিবলোক প্রাপ্তির আশাতেই সবাইকে নিয়ে বাবা বেনারস যান। সেখানেই আমার জন্ম।

সুব্রত: বেনারস থেকে ফিরে এলেন কবে?
মহাদেব: আর ফেরা হয়নি। বাবারও তো বয়স হচ্ছিল। তিনিও শিবলোক প্রত্যাশা করেছিলেন। কিছুতেই বেনারসের বাইরে যেতে চাননি বাবা। আর তাই বেনারসই আমার নতুন ঠিকানা হয়ে যায়।
সুব্রত: শিবলোক কী জিনিস?
মহাদেব: হিন্দুরা তো আত্মার পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। তারা মনে করে বেনারসে মৃত্যু হলে আত্মার আর জন্ম হবে না। সেখানে শুধু বাঙালিরা না, ভারতের বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী এবং জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা বেনারস যান, দল বেঁধে একসাথে থাকেন।
সুব্রত: তাই! আচ্ছা, ওখানেই পড়াশোনা?
মহাদেব: হুম। এমএসসি।
সুব্রত: কোন বিষয়ে?
মহাদেব: পদার্থবিদ্যা। পরে ডক্টরেট করি।
সুব্রত: বিয়ে করলেন কবে?
মহাদেব: ১৯৫৮ সালের জানুয়ারিতে। পরের বছর জুলাই মাসে ছেলে হয়।
সুব্রত: চাকরি কোথায় শুরু করলেন?

মহাদেব: প্রথমে এটমিক এনার্জি কমিশনে। পরে কলেজে।
সুব্রত: কোন কলেজ?
মহাদেব: পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুর রিজিনওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। লেকচারার হিসেবে।
সুব্রত: তারপর?
মহাদেব: চাকরি চলে গেল। কলেজের প্রিন্সিপ্যালের সাথে বনিবনা হচ্ছিল না। তিনি ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায়ের জামাই। সবকাজে তার কথাই ফাইনাল। চেয়ারম্যানের কিছু করার ছিল না।
সুব্রত: আবার চাকরি খুঁজতে শুরু করলেন?
মহাদেব: চাকরিটা চলে যাবার পর থেকেই মনটা বিদেশমুখী হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল দেশে কিছু হবে না আর। তখন সবাই জার্মানিতে যাচ্ছিল। কারণ সেখানে সারভাইবাল জবের খুব সুযোগ ছিল। কিন্তু আমি চাইছিলাম নিজের লাইনের একটা চাকরি। ততদিনে দুই-তিনটা দরখাস্তও জমা দিয়ে ফেলেছি। কানাডার ইউনিভার্সিটিগুলোতে। মধ্যিখানে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢুকে পড়লাম আবার। কিন্তু মন বারবার ‘বিদেশ বিদেশ’ করছিল।
সুব্রত: তো, বিদেশের কী হলো?
মহাদেব: দুটো অফার পেলাম। কিন্তু যাবো কীভাবে? তখন তো আমি গরীব। ভাড়া নেই।
সুব্রত: কতো ভাড়া ছিল তখন?

মহাদেব: জাহাজে দু হাজার টাকা, আর প্লেনে তিন হাজার টাকা।
সুব্রত: শেষমেষ টাকাটা কীভাবে যোগাড় হলো?
মহাদেব: হলো না। ততোদিনে বিমান কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে কয়েকটা চিঠি এসেছে। মানে হলো, ওরা অফার পাঠাচ্ছে, যদি ওদের বিমানে আসি তাহলে এই সুযোগ, ওই সুযোগ, এই আর কী!
সুব্রত: কাদের টিকিট কিনলেন?
মহাদেব: কিনবো কীভাবে? টাকা থাকতে হবে না? আমি ওদেরকে চিঠি লিখলাম ধারে টিকিট দিলে যেতে পারি।
সুব্রত: ধারে টিকিট? মানে কি?
মহাদেব: মানে কানাডা গিয়ে চাকরি করে পরে টাকা পরিশোধ করবো।
সুব্রত: ধার দিল কেউ?
মহাদেব: এসএএস নামের একটা বিমান পরিবহন সংস্থা চিঠির উত্তর দিল। অন্য একজনের সাথে ওরা যোগাযোগ করতে বললো যিনি কানাডা থেকে ফিরছিলেন। দেখা করলাম। আমাকে ধারে টিকিট দেওয়া হলো।
সুব্রত: শেষে চলে এলেন?
মহাদেব: হ্যাঁ। টরন্টোতে নামার পর দেখি ভারতীয় ছাত্রদের সাহায্য করার একটি বুথ রয়েছে। ওদেরকে বলতেই উইনিপেগে ওরা ফোন করে দিলেন। রাত দুইটায় সেখানে নেমে দেখি দুই ছাত্র আমাকে নেবার জন্যে দাড়িয়ে আছে। তখন আমার পকেটে আট ডলার পাঁচ সেন্ট। পরের দিন গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি। কিন্তু যে অধ্যাপকের অধীনে আমি যুক্ত হলাম তাঁর দৃঢ় ধারণা জন্মালো যে, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। শুধু আমাকে নিয়ে নয়, তাঁর অধিনস্ত সকলকে নিয়ে ওঁর এমন ধারণা ছিল। আমার পরে একজন চিনা শিক্ষক যোগ দিয়েছিলেন। অধ্যাপকের আচরণে ভদ্রলোক তো পাগলই হয়ে গিয়েছিলেন।
সুব্রত: কী করলেন এমন পরিস্থিতিতে?
মহাদেব: কী আর করবো! চাকরি চলে গেল। সামারে ম্যানিটোবা ক্যান্সার রিসার্স ইন্সটিটিউটে যোগ দিলাম। ইতোমধ্যে জুটে গেল মেয়েদের একটি প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুলের চাকরি। খুব ভালো বেতন ছিল সেখানে। থাকা-খাওয়াও ফ্রি ছিল।
সুব্রত: কতো বছর সেখানে ছিলেন?
মহাদেব: বেশি দিন না। আমি চাইছিলাম অন্টারিওতে চলে আসতে। দরখাস্তও করছিলাম দু’চার খানা। ১৯৬৬ সালে কল পেলাম অন্টারিও-র কলেজ অব টেকনোলোজির প্রধানের কাছ থেকে। কাজ হলো সাদবেরি শহরের কেমব্রিয়ান কলেজ অব টেকনোজিতে। খুব ভালো অফার ছিল ওদের। সে সময় বছরে ওরা আমাকে দিত এগারো হাজার ডলার।
সুব্রত: বৌদিকে কানাডাতে কবে আনলেন?
মহাদেব: তিনি আসবেন কীভাবে!
সুব্রত: মানে!

মহাদেব: তখন তো চলছিল নেহেরু সাহেবের জ্বালা। আইন হয়েছে, যারা বিদেশে থাকে, তাদেরকে প্রমাণ দিতে হবে যে তারা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেননি। তারপরেই তারা স্ত্রীকে বিদেশে নিতে পারবেন। এমন কাগজ কীভাবে দিব? কাকে বোঝাবো যে, পরিত্যাগ করতে চাইনি বলেই তো নিয়ে আসতে চাইছি। কিন্তু তাদের দাবি, প্রমাণপ্রত্র দিতে হবে। কী যে অশান্তি! ওদিকে দিল্লীর কানাডিয়ান হাইকমিশনে যখন তোমার বৌদি গেলেন কর্মকর্তারা তাকে ভিসাও দিতে চাননি। তিনি একটু নার্ভাস ছিলেন। কর্তারা বোধহয় তাঁকে আমার স্ত্রী হিসেবে ঠিক বিশ্বাস করেননি।
সুব্রত: এরপর কী হলো?
মহাদেব: কী আর হবে! সাদবেরিতে একদিন বিকেলে বসে আছি। এক মহিলা এসে একটা কাগজ ধরিয়ে বললেন, সই দিতে। কী বিষয়! তিনি একটি পিটিশন দিচ্ছেন। সই দিয়ে বললাম, তোমার পিটিশনে তো আমি সই দিলাম, কিন্তু আমার জন্যে কে সই করবে? বললেন, তোমার আবার কী সমস্য? খুলে বলতেই বললেন, আমি আজকেই আমার স্বামীকে বলবো। তিনি ওখানকার এমপি। এরপর এমপি সাহেব বিষয়টি অটোয়াতে ইমিগ্রেশন মন্ত্রীকে বলেন। মন্ত্রী দিল্লী অফিসকে বলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি এলেন সাদবেরিতে।
সুব্রত: বৌদির কথা আরও কিছু বলুন।
মহাদেব: কী আর বলবো! তিনি তো আমাকে একা রেখে চলে গেলেন।
(বলেই মহাদেব চক্রবর্তী হুইল চেয়ারটি ঘুরিয়ে উল্টোদিকের দেয়ালে লাইটের সুইচ অন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। মনে হলো সারা ঘরের অন্ধকার তাড়াতে আলোকবর্তিকাসম মানুষটি বড়ো ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন।)
সুব্রত: সেটা কতো সাল?
মহাদেব: ১৯৯১।
সুব্রত: বৌদির নাম কী ছিল?
মহাদেব: দিপ্তী চক্রবর্তী। পরে তার নামে আমি একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করি। সেই ফাউন্ডেশন থেকে কিছু কাজ করার ইচ্ছে মনে জাগে। এমন সময়ে আমি পত্রিকায় দেখতে পাই ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সংগঠন সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেসকারকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দিচ্ছে। আমি ওদের সাথে যোগাযোগ করি।
সুব্রত: তখন কি আপনি টরন্টোতে চলে এসেছেন?
মহাদেব: না, আমি চাকরি থেকে অবসর নেই ১৯৯৩ সালে। আরও একবছর চাকরি ছিল। কিন্তু কিছুতেই যেন পেরে উঠছিলাম না। এদিক-সেদিক কয়েক বছর ঘোরাঘুরি করে ১৯৯৯ সালে টরেন্টাতে চলে আসি। সাদবেরির সব কিছু বিক্রি করে এখানে চলে এলাম।
সুব্রত: তারপর ওই ফাউন্ডেশনের কী হলো?
মহাদেব: আমি ইয়র্কে যোগাযোগ করেছি জেনে, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর এক ভদ্রমহিলা আমার সাথে যোগাযোগ করলেন। তাঁর নাম পলিন। তিনি জন্মসূত্রে স্কটিশ। তাঁর স্বামী বাঙালি অধ্যাপক দীপক মজুমদার। তিনি জানালেন তাঁরা অনেকদিন ধরে বাংলা কোর্স চালুর চেষ্টা করে চলেছেন। বাংলা ভাষার কোর্স চালু করতে তাঁদের আগ্রহ দেখে উৎসাহিত হলাম। যুক্ত হলাম ওঁদের সাথে। শুরু হলো দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার কোর্স। ফাউন্ডেশন থেকে প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের জন্যে বৃত্তির ব্যবস্থা করা হলো। বাংলা ভাষা কোর্সের শিক্ষার্থীদের ‘বারসারি’ দেবার উদ্যোগ নেওয়া হলো।
সুব্রত: কোর্সটি কেমন চলেছিল?
মহাদেব: কোর্সটি এমন করে পরিকল্পনা করা হয় যাতে কানাডায় বেড়ে ওঠা বাঙালিরা যারা বাংলা ভাষা শিখতে পারছে না, তারা শিখতে পারে। সাথে সাথে অবাঙালি কেউ চাইলেও যেন বাংলা ভাষাটা শেখা তার জন্যে সহজসাধ্য হয়। চলেছিল ১৯৯৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। শুরুতে ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী পাওয়া যেত। পরের দিকে কমে দশ-পনেরো জনে নেমে আসে।
সুব্রত: কোর্সটি বন্ধ হয়ে গেল কেন?
মহাদেব: অর্থাভাবে। ২০০৫-৬ সাল থেকে মজুমদার দম্পতি আর টাকা দিতে পারছিলেন না।
সুব্রত: চালু রাখার জন্যে আপনি নিজে কি অর্থ জোগাড়ের চেষ্টা করেছিলেন?
মহাদেব: করেছি। ওঁরা টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পর আমিই তো টাকাটা দিচ্ছিলাম। ২০০৯ সাল থেকে গোলমাল শুরু হলো। আমি নিজেও আর টাকা দিতে পারছিলাম না। ততদিনে আমি নিজেও চোখে কম দেখা শুরু করেছি। শেষে অর্থ জোগাড়ের আশাতে আমি বাঙালিদের সব অনুষ্ঠানে অনুদান বাক্স নিয়ে হাজির হতাম। সবার কাছে এক ডলার করে ভিক্ষে চাইতাম। অনেকে বিরক্ত হতেন। অনেকে আমার নামে অনেক কিছু বলতে শুরু করলেন।

সুব্রত: সাড়া পান নাই?
মহাদেব: পাইনি তা তো বলবো না। প্রতি সিমেস্টারে লাগতো হাজার তিনেক ডলার। প্রথম দিকে সেটা যোগাড় করতে পারতাম। পরের দিকে আর পারছিলাম না। আমি মনে করি, টরন্টোর প্রতিটি বাঙালি যদি বছরে এক ডলার করে দিতেন, তাহলেও কোর্সটি চালু রাখতে অসুবিধে হতো না।
সুব্রত: আমার তো মনে হয়, আপনার আহ্বানটি ঠিক মতো কমিউনিটিতে পৌঁছয়নি। পৌঁছানো গেলে এমনটি হবার কথা তো নয়।
মহাদেব: হতে পারে। কিন্তু যাদের কাছে পৌঁছেছিল তারাও তো দেননি!
সুব্রত: কোর্সের সর্বশেষ অবস্থা কী?
মহাদেব: আমি তো চেয়েছি কোর্সটা চালু থাকুক। কিন্তু কিছুই তো করতে পারি না। কিছুই তো হচ্ছে না।
সুব্রত: এরপর কী হলো?
মহাদেব: কী হবে? বাঙালিরা শুধু ইয়ার্কি মারে? জিজ্ঞেস করে, আপনার বাংলা কোর্সের কী হলো? সবাই মনে করে যে ওই একটা লোকেরই দায় এটি। তাঁরা ভাবে, লোকটা পারলো না, লোকটাকে টিটকারী দাও।
সুব্রত: কেউ এগিয়ে আসেননি?
মহাদেব: দেখ, বাঙালির একটা বৈশিষ্ট্য আছে। টিটকারী দিতে পারে। কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে বলে না, দেখি আমরা কী করতে পারি।

সুব্রত: এরপর কী হলো?
মহাদেব: বহু বছর চলে গেল। ২০১৪-১৫ সালের দিকে হঠাৎ একদিন দেখি, আমি হাঁটতে পারি না। কিছুই না। রাতে ঘুম ভেঙেছে, দেখি উঠতে পারছি না। ওয়াশরুম যেতে পারছি না। এরপর থেকেই তো হুইলচেয়ার একমাত্র ভরসা।
সুব্রত: একটা কথা, বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে কিছু মানুষ তো প্রবাসেও কাজ করেন, তাই না?
মহাদেব: তা হয়তো করেন। কিন্তু বাঙালিরা এগিয়ে এলেন কোথায়?
সুব্রত: দীপক-পলিন মজুমদারদের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া হয়নি আর?
মহাদেব: হয়েছে। ওঁদের তো অনেক টাকা। দীপক মারা যাবার আগে উইল করে গেছেন। তাঁদের সব টাকা যাবে এই বাংলা কোর্সে। ওঁরা যদিও ওটাকে ঠিক বাংলা কোর্সে সীমাবদ্ধ রাখেননি। উইলে আছে টাকা যাবে বেঙ্গল কোর্সে। শুধু ভাষা নয়, ইতিহাস-সংস্কৃতি সবকিছু। ভাষা সেই কোর্সের একটি অংশ হবে। তবে উল্লেখ করে রাখা দরকার, টাকাটা আসবে পলিন মজুমদারের মৃত্যুর পরে। সেটা তো আরও সময়ের ব্যাপার। সেটা তো ভবিষ্যতের ব্যাপার। ততদিনে তো আমিও তো থাকবো না। জানি না, তখন কী হবে!
সুব্রত: এতদিন পরে এসে বাঙালিদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
মহাদেব: প্রত্যাশা নেই। কিন্তু অনেক আশা ছিল। কানাডায় গত ছাপ্পান্ন বছরে অন্য অনেক কমিউনিটির সাথে আমি মেশার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু ওদের মধ্যে চিন্তার ওই দৈন্যটা দেখিনি যেটা বাঙালিদের মধ্যে দেখতে পাই।
সুব্রত: আরেকটু স্পষ্ট করে বলবেন?
মহাদেব: দেখো, যখন একজন বিদেশি আমাদের অনুষ্ঠানে এসে বাংলা ভাষায় কিছু বলেন, তখন আমরা উল্লাস প্রকাশ করি। কিন্তু যারা আনন্দিত হচ্ছেন, তাদের পরিবারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখ, তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েরা বাংলা শেখেনি। কানাডায় অন্য ভাষার ছোটোছোটো কমিউনিটিতেও যদি তুমি খোঁজ নাও, দেখতে পাবে তারা তাদের সন্তানদের নিজেদের শেখানোর ব্যাপারে কতোটা দায়িত্বশীল। আমাদের কি উচিত না আমাদের মায়ের ভাষাটাকে ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে যাওয়া?
সুব্রত: খুব ঠিক বলেছেন। দাদা, তিন ঘন্টা ধরে কথা বলছি। ক্লান্ত লাগছে?
মহাদেব: তা তো খানিক লাগছেই।
সুব্রত: আনন্দ লাগছে না?
মহাদেব: সেটাও লাগছে।
সুব্রত: নমস্কার। ভালো থাকবেন। আসছি।
মহাদেব: নমস্কার।
(বিদায় জানিয়ে দড়জার কাছে এসে জুতো পরা শুরু করতেই তিনি ডাকলেন। বললেন, শোনো, তোমাকে একটা বই দেখাই। এবং এরপর আমাদের শুরু হলো নতুন এক সাক্ষাৎকার। আবার ঘণ্টা পেরোতে শুরু করলো।)

ইস্টইয়র্ক, টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles