13.4 C
Toronto
শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪

প্রবাসে থেকেও মনে হয় আছি স্বদেশে

প্রবাসে থেকেও মনে হয় আছি স্বদেশে
শেখর গোমেজ

আজ থেকে ২১ বছর আগে সপরিবারে স্থায়ী আবাস গড়তে কানাডায় যখন আসি নিজেকে মনে হয়েছিলো শেকড় উপড়ে ফেলা বৃক্ষের মতো। প্রিয় স্বদেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভাষার এই পরিবেশে নিজেদের কি ক’রে খাপ খাওয়াবো সেই চিন্তায় তখন ভীষণ বিষণ্ণ। টরন্টো শহরের যে এলাকায় প্রথমে আস্তানা গেড়েছিলাম সেখানে বাঙ্গালির দেখা মিলতো না। এই কারণে হোমসিকনেস এত তীব্র হয়েছিলো। তারপর একসময় যখন বাংলাদেশের বাঙ্গালি অধ্যুষিত ড্যানফোর্থের খোঁজ পেলাম দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো। ড্যানফোর্থে গিয়ে দেখি সারিবদ্ধ দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁর বেশিরভাগই বাংলাদেশীদের মালিকানাধীন। সাইনবোর্ডগুলো বাংলায় লেখা। এখানে লোকজন একে অপরের সাথে বাংলায় কথা বলছে। ড্যানফোর্থকে মনে হোলো যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। মাঝে মাঝে তাই ড্যানফোর্থে যেতাম স্বদেশের স্বাদ নিতে। ড্যানফোর্থে সেসময় দু’টো সাপ্তাহিক পত্রিকার অফিস ছিলো। পত্রিকা দু’টোর নাম বাংলা কাগজ ও বাংলা রিপোর্টার। একসময় পত্রিকার এই অফিস দু’টোতে যাতায়াত শুরু হোলো। সপ্তাহান্তের ছুটিতে সেখানে সন্ধ্যার পর তুমুল আড্ডায় মেতে উঠতাম। বাংলা রিপোর্টার পত্রিকার সম্পাদক সুমন রহমানের অনুপ্রেরণায় একসময় বাংলা রিপোর্টারে লিখতেও শুরু করলাম। চলচ্চিত্র বিষয়ক আমার অনেক লেখা এই পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো। প্রবাসে বসে বাংলায় লিখছি, তা আবার এখানেই বাংলা পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে – এই বিষয়টি ছিলো আমার জন্যে এক পরম প্রাপ্তি। ড্যানফোর্থের অমোঘ আকর্ষণে অবশেষে ডাউনটাউনে বসবাসের সমাপ্তি টেনে চলে এলাম ড্যানফোর্থের সন্নিকটে এলসওয়ার্থে।

এলসওয়ার্থে আসার পর পরিচয় হোলো টরন্টোর প্রথম বাংলা পত্রিকা দেশে বিদেশের সম্পাদক নজরুল ইসলাম মিন্টোর সাথে। তিনি তখন থাকতেন আমাদের আবাসস্থল থেকে অনতিদূরে, একেবারে হাঁটার দূরত্বে। প্রায়ই সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে যাই, আড্ডা হয়। তাঁর পত্রিকায় আমার দু’একটি লেখাও তিনি ছাপালেন। একদিন তিনি তাঁর পত্রিকার সংস্কৃতি পাতার দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব দিলেন। আমি লুফে নিলাম। এরকম একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলাম। বাংলা রিপোর্টার ও দেশে বিদেশে পত্রিকার সাথে জড়িত থাকার সুবাদে পরিচয় হোলো টরন্টোর বহু গুণীজনের সাথে। আমি একটু আধটু অভিনয় করি জেনে টরন্টোর নন্দিত নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক আকতার হোসেন একদিন তাঁর নাটকের একটি স্ক্রিপ্ট হাতে দিয়ে বললেন, পড়ুন, পরে কথা হবে। তারপর একদিন ফোন ক’রে বললেন, এই নাটকে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার ভূমিকায় আপনাকে ভেবেছি। আমার সাথে কি কাজ করবেন? আমি রাজি হয়ে গেলাম। টরন্টোয় বাংলা নাটকে সেই আমার প্রথম অভিনয়। নাটকের নাম ‘চারদেয়ালের জীবন’। পরে আকতার হোসেন রচিত ও নির্দেশিত ‘এক্কা দোক্কা মন’ নাটকেও অভিনয় করেছি।

- Advertisement -

‘চার দেয়ালের জীবন’ নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে পরিচয় হোলো গুণী নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী অরুণা হায়দারের সাথে। অরুণার সাথে অভিনয় করতে গিয়ে বুঝলাম সে শুধু একজন নৃত্যপটীয়সী নয়, অত্যন্ত উঁচুমানের একজন অভিনেত্রীও বটে। ওই নাটক করতে গিয়ে আরেক গুণীজনের সাথে আমার সখ্য গড়ে উঠে। তাঁর নাম আহমেদ হোসেন। আহমেদকে বাংলাদেশে মঞ্চে ও টেলিভিশনে অভিনয় করতে দেখেছি। টরন্টো এসে তাঁর দেখা মিলবে ভাবিনি। অরুণা ও আহমেদের সাথে টরন্টোর বিভিন্ন মঞ্চে ও টেলিভিশনে নাটক ও আবৃত্তির অনুষ্ঠানসহ বহু অনুষ্ঠান করেছি। এই করতে করতে সম্বোধন কখন আপনি থেকে তুইতুকারিতে ঠেকেছে বুঝতেও পারিনি। আহমেদ হোসেনের পরিচালনায় ‘বিবিধ বিধান’ নাটকটি করতে গিয়ে বুঝেছি সে কতটা সুদক্ষ ও প্রশিক্ষিত নাট্যপরিচালক। এরপর আহমেদের উদ্যোগে ‘মুক্তমনঃ সত্য, সুন্দর, আনন্দ, কল্যাণ’ নামে একটি আবৃত্তি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। এই আবৃত্তি সংগঠনের সদস্য তিন জন। আহমেদ, আমি ও শান্ত নামের একজন আবৃত্তিশিল্পী। তখন আমাদের নিজস্ব আয়োজন ছাড়াও টরন্টোর প্রায় সব অনুষ্ঠানেই আমাদের ডাক পড়তো। শান্ত পাকাপাকিভাবে বাংলাদশে চলে যাবার পর ‘মুক্তমন’ নিয়ে আর এগিয়ে যাবার ইচ্ছে হয়নি আমার, আহমেদের দু’জনেরই।

একবার টরন্টো এলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী, নৃত্যের শিক্ষক ও অভিনেত্রী লায়লা হাসান। তিনি সেবার আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে টরন্টো শহরের সব নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে একটি নৃত্যানুষ্ঠান করার প্রস্তাব দিলেন। সেই লক্ষ্যে গঠন করলেন একটি কমিটি এবং আমাকে দিলেন সেই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব। অরুণা হায়দার এবং নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যের শিক্ষক বিপ্লব করসহ টরন্টোর বেশ কয়েকজন নৃত্যশিল্পী ছিলেন সেই কমিটিতে। আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের দিন সেই কমিটি আয়োজন করেছিলো বিশাল এক নৃত্যানুষ্ঠানের। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি দেশের শতাধিক নৃত্যশিল্পী নৃত্যের সেই মহাআয়োজনে নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। টরন্টোর বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসে সেই আয়োজনটি এইটি মাইলফলক হয়ে আছে।

আজ থেকে প্রায় ১১ বছর আগে এই টরন্টো শহরে ‘বাংলা মেইল’ নামের একটি সাপ্তাহিক পুর্ণ প্রত্যয়ে যাত্রা শুরু করে। শহিদুল ইসলাম মিন্টু সম্পাদিত এই পত্রিকার সূচনালগ্নে সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্যও হয়। পত্রিকাটির প্রকাশের কাল থেকে আজ অবধি আমার সাথে গ্রন্থিবন্ধনটি অটুট আছে।

এই টরন্টো শহরে ২০১৬ সালে গঠিত হয় বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি) নামে বাঙ্গালি লেখক-কবিদের একটি সংগঠন। লেখক-গবেষক সুব্রত কুমার দাসের উদ্যোগে গঠিত বিএলআরসি ওই বছরই ছয় জন প্রবাসী লেখকের গ্রন্থ প্রকাশ করে এবং মহাসমারোহে আয়োজন করে এই গ্রন্থগুলোর প্রকাশনা উৎসব। এই গ্রন্থগুলোর মধ্যে আমার কাব্যগ্রন্থ ‘মনকল্প’ একটি। কোনোদিন আমার কোনো বই প্রকাশিত হবে ভাবিনি। প্রবাসে গঠিত সাহিত্য সংগঠন বিএলআরসি আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের জন্য উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে এসে আমাকে অবাক ক’রে দেয়।

টরন্টোর বাংলা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত কয়েকজন বন্ধু মিলে একবার সিদ্ধান্ত নিলাম এই শহরে যাত্রা করবো। টরন্টোয় নাটক, সঙ্গীতানুষ্ঠান, আবৃত্তির অনুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠানসহ নানা ধরণের অনুষ্ঠান হয়; কিন্তু সে যাবৎ বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালার মঞ্চায়ন হয়নি। শুরু করলাম ‘সিরাজউদ্দৌলা’ যাত্রাপালার মহড়া। প্রায় চার মাস টানা মহড়া শেষে দু’দিন মহাসমারোহে মঞ্চায়িত হোলো ‘সিরাজউদ্দৌলা’। অভিনয়শিল্পী মানিক চন্দ এবং নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক সুব্রত পুরুর যৌথ পরিচালনায় ওই যাত্রাপালায় অভিনয় করেছিলাম গোলাম হোসেনের চরিত্রে। মঞ্চায়নের উভয় দিনই মিলনায়তন ছিলো কানায় কানায় পূর্ণ।

‘সিরাজউদ্দৌলা’ যাত্রাপালা মঞ্চায়নের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে পরে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে গঠন করি নাট্যসংগঠন ‘নাট্যসঙ্ঘ, কানাডা’। সুব্রত পুরু রচিত ও নির্দেশিত ‘তিন মাতালের কান্ড’ মঞ্চায়নের মাধ্যমে নাট্যসঙ্ঘ, কানাডার যাত্রা শুরু। এই নাটকে এক মাতাল ও নুরু চোরা – এই দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করি। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, নাটকের মতো একটি বিশাল আয়োজনকে প্রবাসের নানান সীমাবদ্ধতায় সার্থক ক’রে তোলা অত্যন্ত কঠিন। প্রথমতঃ নাটকের চরিত্র অনুযায়ী কুশীলব নির্বাচনে হ’তে হয় গলদ্ঘর্ম মঞ্চাভিনয়ে দক্ষ অভিনেতা অভিনেত্রীর স্বল্পতার কারণে। তারপর আসে মহড়ার বিষয়টি। কুশীলবদের রুটিরুজির দিন ও সময়কে মেনে নির্ধারণ করতে হয় মহড়ার দিনক্ষণ। সপ্তাহে এক বা বড়জোর দু’দিন ছাড়া মহড়া সম্ভব নয়। এই কারণে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে নাটক মঞ্চায়নে লেগে যায় দীর্ঘ সময়। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এখানে নাটকের মঞ্চায়ন হ’চ্ছে ‘নাট্যসঙ্ঘ, কানাডা’, ‘অন্য থিয়েটার’ ‘বাংলাদেশ থিয়েটার’ ও ‘ইতিহাস দেশ সমাজ’-এর মতো কিছু নাট্যসংগঠনের উদ্যোগে। এই নাট্যসংগঠনগুলির নিবেদিতপ্রাণ নাট্যকর্মীদের নিরলস শ্রমে ও ত্যাগে নাটক মঞ্চস্থ হ’চ্ছে যা দর্শকরা দর্শনীর বিনিময়ে দেখছেন। নাটকের প্রদর্শনীগুলিতে হল থাকে কানায় কানায় পূর্ণ। এই প্রবাসে নাটকের প্রতি দর্শকদের মমত্ববোধ ও আগ্রহ দেখে রীতিমতো অবাক হ’তে হয়।এখানে যে নাটকগুলি মঞ্চস্থ হ’চ্ছে তার অধিকাংশই মৌলিক। স্বদেশের সমাজ-বাস্তবতা এবং প্রবাসী জীবনের নানা টানাপোড়েন নিয়ে প্রবাসী নাট্যকারদের রচিত নাটকগুলির মঞ্চায়নই হ’চ্ছে বেশি।

কানাডার বাংলা টেলিভিশন প্রতিষ্ঠান দেশী টেলিভিশনের প্রযোজনায় টেলিফিল্মও নির্মিত হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘রাক্ষুসী’ গল্প অবলম্বনে নির্মিত ওই টেলিফিল্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ হয়েছিলো। ছবিটির বেশিরভাগ শুটিং হয়েছিলো আউটডোরে। লোকেশনগুলো এমনভাবে নির্বাচন করা হয়েছিলো যাতে বাংলাদেশের প্রকৃতির আবহ থাকে। ছবিটিতে কাজ করার স্মৃতি এখনো চিত্তবোধে আনন্দ জাগায়।ডঃ মঞ্জুর পারভেজ পরিচালিত ছবিটির প্রিমিয়ার হয় ২০১৪ সালে টরন্টোয় অনুষ্ঠিত নজরুল সম্মেলনে। পরে বাংলাদেশের আরটিভিতে তা প্রদর্শিত হয়। এছাড়াও দেশী টেলিভিশন ও সাজ্জাদ আলী পরিচালিত বাংলা টেলিভিশনের বিভিন্ন প্রযোজনায় একসময় অংশগ্রহণ করেছি প্রায় নিয়মিত। আর এখন টরন্টোর বাংলা মিডিয়া জগতের প্রিয়মুখ শহিদুল ইসলাম মিন্টুর এনআরবি টিভি’র বিশেষ আয়োজনগুলোতে বাংলা কবিতা উচ্চারণের সৌভাগ্য হচ্ছে মাঝে মাঝে।

টরন্টো শহরে বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলি পালিত হয় যথাযোগ্য মর্যাদায়। শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানগুলিতে নামে মানুষের ঢল। পহেলা বৈশাখে এখানে মঙ্গল শোভাযাত্রাও হয়। এখানে আছে শহীদ মিনার। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং সেইসাথে সেখানে বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজনে হয় অনুষ্ঠান একুশে ফেব্রুয়ারির মহান দিনটিতে। রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীও পালিত হয় মহাসমারোহে। আর প্রতি বছর গ্রীষ্মে থাকে বইমেলার আয়োজন। বাংলা সংস্কৃতির সবকিছুরই সরব উপস্থিতি এই টরন্টো শহরে। এইসব আয়োজনে প্রবাসের শত কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও চেষ্টা করি উপস্থিত থাকতে কখনো অংশগ্রহণকারী, কখনোবা স্রেফ দর্শক হিসেবে। প্রবাসে এইসব সাংস্কৃতিক আয়োজনের সাথে নিবিড় সখ্যই দেশে না থাকার বেদনাকে ভুলিয়ে দেয়। মনে হয় আছি আমার প্রিয় স্বদেশেই।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles