15.7 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, মে ১৬, ২০২৪

সভা সমাবেশে ভাড়াটে কর্মী রেট পুরুষ ৪০০ নারী ৬০০

সভা সমাবেশে ভাড়াটে কর্মী রেট পুরুষ ৪০০ নারী ৬০০
<br >ছবি সংগৃহীত

জনা দশেক যুবককে সঙ্গে নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলছেন এক ব্যক্তি। তিনি বলছেন, ‘আবার বিজয়ী হবে ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল…’। হঠাৎ পেছনে থাকা কয়েকজন যুবক ‘জয় বাংলা’ বলে স্লোগান দিতে শুরু করলেন। কথক ব্যক্তি এমন স্লোগানে বিচলিত হয়ে তাদের থামাতে চেষ্টা করলেন। সঙ্গের যুবকদের ‘জয় বাংলা’ বলে স্লোগান না দিয়ে ‘জিয়ার সৈনিক’ বলে স্লোগান দিতে বলেন তিনি।

ভাড়াটে লোক আনলে এমনই হয়। তারা কখন কোন স্লোগান দিতে হবে তা মনে রাখতে পারে না বা একটা বলতে গিয়ে আরেকটা বলে। ‘জিয়ার সৈনিকের জয় বাংলা স্লোগান’ শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে।

- Advertisement -

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ৯ সেকেন্ডের ওই ভিডিও নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলো ভাড়াটে কর্মী নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে। ভাড়ায় ‘রাজনৈতিক কর্মী’ পাওয়া যায় কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দেশ রূপান্তরের এ প্রতিবেদক। পরিচয় গোপন রেখে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে আন্দোলনের জন্য কর্মী ভাড়ার প্রমাণও মেলে। পাওয়া গেছে ভাড়ায় বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নেওয়া যুবকদের সন্ধান।

জানা গেছে, ওই যুবকরা আন্দোলন, প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধন, সেমিনার প্রভৃতি সাংগঠনিক ও সামাজিক আয়োজনে অংশ নেয় টাকার বিনিময়ে।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে রাজধানীর পল্টন এলাকায় কথা হয় এক তরুণের সঙ্গে। তার নাম আহসান হাবিব (ছদ্মনাম); রাজধানীর একটি কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। চাকরির জন্য বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিয়েছেন। অভিজ্ঞতা আর সুপারিশের অভাবে ভাড়াটে আন্দোলনকারীর রেট পুরুষ ৪০০ নারী ৬০০

চাকরি হয়নি বলে অভিযোগ তার। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের চাকরির জন্যও পরীক্ষা দিচ্ছেন। পরিবার আর খরচ চালাতে না পারায় ঢাকায় থেকে চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মেসের এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে টাকা পাওয়া যায়। এরপর পল্টন-প্রেস ক্লাবকেন্দ্রিক একটি গ্রুপের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে এ কাজে অংশ নেন তিনি।

আহসান হাবিব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাধ্য হয়ে এ কাজ করছি। এমন নয় যে এখানে খুব আয় করা যায়। কোনো দিন ৭০০ টাকা পাই, আবার কোনো দিন ১৫০ টাকাও পাই। এসে বসে থাকলে কাজ পাওয়া যায় না। লোক লাগলে বিভিন্ন লিংকে যোগাযোগ করে নেতারা। পরে বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে আমার মতো অনেককে ফোন করে হাজিরার স্থান ও টাইম জানিয়ে দেওয়া হয়। তখন আমরা সেখানে যাই। চেষ্টা করি রাজনৈতিক প্রোগ্রামে না যেতে, কারণ ওতে গ্যাঞ্জামের ঝুঁকি থাকে।’

পরিচয় গোপন রেখে কথা বলেন আরও এক যুবক। তার নাম সাইফুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘আমি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানে খন্ডকালীন কাজ করি। সবসময় কাজ থাকে না ওখানে। তাই পরিচিত এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রোগ্রামে আসি। সবসময় কাজ থাকে না যদিও। তবে যা টাকা পাই তা মন্দ না।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর পল্টন, প্রেস ক্লাব ও গুলিস্তান এলাকায় আহসান হাবিবের মতো অসংখ্য তরুণ এমন কাজে অংশ নেওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। তাদের ঘিরে সক্রিয় রয়েছে আরেকটি চক্র; যারা হাবিবের মতো তরুণদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে। বিনিময়ে তারা জনপ্রতি এক থেকে দেড়শো টাকা হাতিয়ে নেয়। এই গ্রুপগুলোতে নারীদেরও অংশগ্রহণ রয়েছে। বিভিন্ন কর্মসূচিতে নারীদের চাহিদা বেশি থাকে, জনপ্রতি বাড়তি টাকা দিয়ে ভাড়া করতে হয় তাদের।

ছদ্মবেশে রাজধানীর প্রেস ক্লাব এলাকায় ঘুরে পাওয়া যায় এক দালালের সন্ধান। তার নাম মো. হেলাল। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকার ভাড়াটে কর্মীদের নিয়ন্ত্রকদের একজন। মধ্যবয়সী এ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এ কাজে যুক্ত আছেন। এ প্রতিবেদককে হেলাল জানান, এক থেকে দেড় ঘণ্টার প্রোগ্রামের জন্য দিতে হয় ১৫০ টাকা। দিনব্যাপী হলে সর্বনিম্ন ৪০০ টাকা দিতে হয় জনপ্রতি। নারীদের চাহিদা বেশি, তাই তাদের ৬০০ টাকা দিতে হয়। এ টাকার একটি অংশ তিনি পান। এখন নির্বাচন কেন্দ্র করে লোকের চাহিদা বেড়েছে। তবে টাকা বাড়িয়ে দিলে প্রচুর লোক পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘১৫০-২০০ লোক জোগাড় করতে পারি অনায়াসে। বেশি লাগলেও পারব, তবে সময় আর লোকের সংখ্যা জানাতে হবে।’

জানা গেছে, মৌখিক চুক্তিতে এরকম কর্মী ভাড়া দেওয়ার অন্তত পাঁচটি চক্র সক্রিয় আছে শুধু জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকাতেই। এই এলাকায় বছর জুড়ে রাজনৈতিক, সামাজিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা আয়োজন থাকে। ফলে এখানে তাদের চাহিদা অন্য এলাকার চেয়ে অনেক বেশি। কারও সাজানো কর্মী দরকার হলে তারা এখানে এসে খোঁজ করেন। কর্মী ভাড়ার সংস্কৃতিটা এই এলাকা থেকেই গড়ে উঠেছে বলা যায়। আর দালালদের মাধ্যমে ভাড়া খাটার কাজে যোগ দেয় বেকার যুবক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন খ-কালীন কাজে যুক্ত তরুণরা। আবার অনেকে এটাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। অনেক মাদকসেবীও ভাড়ায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে থাকে।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘আদর্শহীনতার চর্চা যতক্ষণ চলবে, ততক্ষণ এ ধরনের চর্চা হতে থাকবে। এটা দেশের জন্য, জাতির জন্য, সমাজের জন্য মঙ্গলজনক নয়। রাজনীতি এখন দুর্বৃত্তদের দখলে, রাজনীতিতে আদর্শের জায়গাটা দুর্বল। এমন অবস্থায় এ ধরনের ঘটনা ঘটবে কিন্তু এমনটা হওয়া উচিত নয়।’

ভাড়াটে কর্মীদের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন ব্যবহারকারীরা। গৌরাঙ্গ রায় নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘যারা বলে আওয়ামী লীগ লোক ভাড়া করে সম্মেলন করে, তারা (বিএনপি) নিজেরাও অনুরূপ ঘটনা ঘটায়।’ জাফিরুল জাফির লিখেছেন, ‘লোকটার চোখ-মুখের ভাষা নিশ্চিত করে সে ভাড়াটিয়া।’

তবে ভাড়াটেদের লুক্কায়িত বেদনার কথা বলা হয় খুব কমই। কাদের বা কোন রাজনৈতিক কারণে তাদের এ অবস্থা তা অনুল্লিখিতই থেকে যায়Ñ কদাচিৎ জানা গেলেও। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর ব্যক্তির পরিচয় সে কারণেই নিশ্চিত হওয়া যায় না। যায় না বলেই তার মতামত জানাও সম্ভব হয় না। সূত্র: দেশ রূপান্তর

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles