9.3 C
Toronto
সোমবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৪

জর্জ মারা গেছে রে…

জর্জ মারা গেছে রে...
ফাইল ছবি

টরন্টো গিয়েছিলাম কাজে।

সন্ধ্যা হয়ে আসলো, ইফতারী করা দরকার। চিশতীর বাসা একমাত্র ভরসা। তার বাসার সামনে বিরাট লাক্সারিয়াস ক্যাডিলাক এসইউভি ইলেকট্রিক গাড়িটা দেখে স্বস্তি পেলাম, তারমানে সে বাসায়। নক করতেই সে বিষন্ন মনে দরজা খুলে আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে চলে গেল, একটা কথাও বলল না। মিনিট বিশেক পরে এসে পাশে বসে মাথা নিচু করে শুধু আস্তে উচ্চারণ করল, জর্জ মারা গেছে রে..
– কোন জর্জ? পাশের বাসার!
– হু
– ইশ!
.
খুবই কষ্টের কথা।
তীব্র ক্ষুধায় মৃত্যুর খবরও ম্লান হয়ে আসে। ওদিকে আমার দুশ্চিন্তা; তার ইফতারীর কোনো আয়োজন আছে বলে মনে হচ্ছে না। আর আধা ঘন্টাও বাকি নাই, এই অবস্থায় ‘আজকে উঠি’ বলাটাও খারাপ দেখাবে। আবার রাতেও থাকা দরকার। জর্জ এর সাথে তার সখ্যতা আট বছরের। এ পরিস্থিতিতে সে নিশ্চয়ই আমাকে আদর করে ইফতারী/সেহেরীও বানিয়ে খাওয়াবে না? রাগ লাগলো জর্জের ওপর; ব্যাটা আর মরার সময় পাইলি না?
.
সে আবার ভেতরের ঘরে যেতেই আমি চট করে রান্নাঘরে এসে এক চক্কর দিয়ে, ফ্রিজ খুলে চেক করে দেখে নিলাম। কিচ্ছু নাই, যেন সাহারা মরুভুমি। রাইস কুকার পর্যন্ত শূন্য। শুধু কিছু খেজুর আর এক হালি কলা রাখা ডাইনিং টেবিলে।
.
কিছু জিজ্ঞেস করাটাও অশোভন, বলবে একজন মারা গেছে, আর তোর চিন্তা খাওয়া নিয়ে? তুই মানুষ না হায়েনা? যা আছে কপালে, কলা খেজুর খেয়ে ‘কাজ আছে’ বলে বাইরে বেরিয়ে টিম হর্টন্স এর কফি আর হাবিজাবি খেয়ে আসতে হবে। তাছাড়া বাঁচবো না।
.
সে আবার এসে বলা শুরু করল, মৃত্যু হলো পরম সত্য রে রিপন..। কার কপালে কখন কী আছে আমরা কেউ জানি?
– না
– আমি এখন বাইরে গিয়ে আর ফিরবো কি না, সেটার কোনো গ্যারান্টি আছে?
– নাই
– অথচ দেখ, আমরা সেগুলা রিয়ালাইজ করি না। নিশ্চিন্তে খাই, ঘুমাই। কেউ মারা গেলে তখন হুঁশ হয়, তাও কয়েক মিনিটের জন্য। এই ছোট্ট জীবনে খামোখা আমরাঅন্যের সাথে গন্ডগোল, ঝগড়া, ফ্যাসাদে লিপ্ত হই। মানুষের স্বভাবে সবচাইতে খারাপ আর ক্ষতিকর আচরণ কী বলতো?
– মিথ্যা বলা?
– ওটাও অবশ্য খারাপ, কিন্তু সবচাইতে খারাপ হলো রাগ কন্ট্রোল করতে না পারা। রাগ এর কারণেই পৃথিবীতে যত সমস্যা
– তা ঠিক
– আমি কোনো কারণে রেগে গিয়ে হার্ট এটাক করে মারা যেতে পারি। তাতে কারো কিছু আসবে? সবার জীবন কিন্তু ঠিকমতোই চলবে। তুই কয় দিন কষ্ট পাবি? তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবি- ভালই হইছে, আল্লাহ যা করে ভালো’র জন্যই করে। সাড়ে তিন হাত মাটি হলো আসল ঠিকানা।
.
আমার আর তার ফিলোসফিক্যাল কথাবার্তা কানে ঢুকছে না। অসহ্য লাগছে। সে নিজেও সব ভুলে যাবে দুদিনেই। ইফতারীর আর মাত্র পাঁচ মিনিট আছে, এই সময় প্লেট ফাঁকা অবস্থায় আধ্যাত্মিক কথা শোনার মতো ধৈর্য্য আমার নাই। মনে মনে বললাম, পাগল তুই থামবি? খিদে পেটে এসব কথা অসহ্য!
.
রিপন, ওযু করে আয়। একসাথে ইফতারী সারি। এমনও হতে পারে এটাই আমার-তোর একসাথে শেষ ইফতারী!
সে এক মুঠো খেজুর ধুয়ে এনে প্লেটে সাজিয়ে একটা কলা আর ফ্রিজের উপর থেকে পুরানা বিদ্ধস্ত এক পিস পাউরুটি এনে বলল- তেমন কোনো আয়োজন নাই রে.. বুঝতেই পারছিস মন-টোন খারাপ..
– কোনো সমস্যা নাই দোস্ত
– জর্জের মৃত্যু আমাকে খুব এফেক্ট করছে। কালকেও এসেছিল, সোফায় বসে আমরা একসাথে ডিনার করলাম, মুভি দেখলাম
– আহা! কী হইছিল রে?
– হার্ট এটাক।
.
এখন আমারও কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, খিদের মধ্যেও। মাঝে মাঝে আমিও হাঁটতে যেতাম চিশতী আর জর্জের সাথে। খুব নম্র, ভদ্র প্রকৃতির ছিল জর্জ।
.
.
আমরা ওযু করে, ইফতারী সেরে একসাথে নামাজে দাঁড়াই। দোয়া করার সময় সে মিনিট দশেক ধরে ফুঁপিয়ে কেঁপে কেঁপে কাঁদলো যথারীতি। এটা অবশ্য তার নরমাল সিনারিও; জর্জ মারা না গেলেও সে এভাবেই কাঁদতো।
.
প্রস্তাব দিয়ে বললাম, দোস্ত চা বানাই?
– বানা।
দুই কাপ চা বানালাম। তবে আমার কাপ ভর্তি করে দুধ, তিন চামচ চিনি দিলাম। খিদেতে পেট চোঁ চোঁ করছে। ভারি চা খেয়ে পেট কিছুটা শান্ত রাখা যাবে। আমারটা চা না বলে অন্য কোনো নাম দেওয়া উচিত।
.
তাকে ঠিক যে সময় বলতে যাবো ‘দোস্ত একটু বাইরে যাচ্ছি’, ঠিক সে সময়ে কলিং বেল বেজে উঠলো। ‘ডোর-ড্যাশ’ থেকে কেউ একজন খাবার ডেলিভারি দিতে এসেছে। প্রথমে বেশ ভদ্রভাবেই তাদের কথোপকথন চলল, তারপর উত্তাপ ক্রমেই বেড়ে চলল চক্রবৃদ্ধিহারে। এক পর্যায়ে তীব্র ঝগড়া শুরু হয়ে গেল, সাথে মুখ খারাপ; অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি।
.
চিশতী শেষে ধ্রিম করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে রাগে গজগজ করে একগাদা খাবার ডাইনিং টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেলে বলল, হারামজাদাদের অর্ডার দিয়ে বলছিলাম সাড়ে ছয়টায় দিস। টাকা অগ্রিম নিলে আর হুঁশ থাকে না “….” বাচ্চাদের! রিপন আয়!
.
এরই নাম রিজিক।
মাশরুম দেয়া লার্জ পিজা আর পপেয়েস থেকে মুরগি ফ্রাই আমরা চেটেপুটে খেলাম।
রিপন, রাতে তো আছিস, নাকি?
– হু
– একটা কাজ পারবি?
– শিওর!
– আমি খুব টায়ার্ড। তাছাড়া মরা বাড়িতে যেতে আমার ভালো লাগে না। মিস অলিভার এখন একদম একা। আমি নিশ্চিত তার খাবারের কোনো আয়োজন নাই। উনার জন্যও খাবার অর্ডার করছিলাম। দিয়ে আসতে পারবি?
– অবশ্যই!
একটু আগে ডেলিভারী দেওয়া আরেকটা বড় ঠোঙার দিকে নির্দেশ করে বলল, পারলে এখনই দিয়ে আয়। এরা আবার অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাগ তো আর এমনি হয়নি।
.
আমি পাশের দু-বাড়ি পরে দরজায় বেশ কয়েকবার নক করার পর মিস অলিভার দরজা খুলে বললেন, রিপন!
– চিশতী আপনার জন্য খাবার পাঠালো
– অনেক ধন্যবাদ তোমাদের। একটু বসো?
– অলিভার, আমার কাজ আছে
– এখন আমি খুব একা, পাঁচটা মিনিট না হয় বসো?
.
আমি আর না করতে পারিনি। মরা বাড়িতে আমিও খুব ভয় পাই। উনি আমার নাম জানেন, কয়েকবার এসেছিলাম। একবার জর্জের জন্মদিনে এসে ধুমধাম পার্টি দেখে অভিভূত হয়েছিলাম।
বৃদ্ধা অনেক স্মৃতি মন্থর করে একটা ফটো এলবাম এনে আমার পাশে বসে আস্তে আস্তে পাতা উল্টিয়ে দেখাতে লাগলেন। তাঁর চোখ দিয়ে টসটস করে পানি পড়তে লাগলো। উনার সারা দেয়াল জুড়ে জর্জের অসংখ্য হাস্যোজ্জ্বল ছবি শোভা পাচ্ছে। আমার চোখের সামনে দিব্যি যেন দেখতে পারছি জর্জ ঘুড়ে বেড়াচ্ছে..
.
আমি উঠার আগে মিস অলিভার কিছুটা শান্ত হলেন। বলতে লাগলেন, আমার একটা উপকার করবে?
– জি বলেন?
– বেজমেন্ট থেকে খাঁচাটা একটু বাইরে রাস্তার ধারে রেখে আসতে পারবে? কারো যদি কাজে লাগে..
.
আমি জর্জের বিশাল লোহার খাঁচাটা বেইজমেন্ট থেকে তুলে এনে রাস্তার ধারে রাখলাম। জর্জের যে সাইজ ছিল ভাই রে ভাই! দূর থেকে মনে হতো সাক্ষাত ভাল্লুক! তার জাত ছিল Pyrenean Mountain Dog. ধবধবে সাদা অপূর্ব সুন্দর। ফ্রান্স থেকে আমদানি করা।
আহা, বাড়ির আশপাশে এখনো জর্জের চারপায়ের ছাপ পড়ে আছে। হঠাত খুব মায়া লাগতে লাগলো।
ভরপেটে মায়া বেশি লাগে..

- Advertisement -

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles