8.4 C
Toronto
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

রম্যাঁ রলাঁর বিবেকানন্দ

রম্যাঁ রলাঁর বিবেকানন্দ - the Bengali Times
স্বামী বিবেকানন্দ

নোবেল বিজয়ী ফরাসি সাহিত্যিক রম্যাঁ রলাঁ (১৮৬৬-১৯৪৪) ইংরেজি জানতেন না। আর বাংলা জানার তো প্রশ্নই ওঠে না। ১৯১০ সালে মোটর দুর্ঘটনায় প্রায় প্রতিবন্ধী রলাঁর ভার নিয়েছিলেন তাঁর বোন মাদরেন রলাঁ। মাদরেন ইংরেজি জানতেন, বাংলা পড়তে পারতেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার তিনি শুধু দোভাষীই ছিলেন না, ছিলেন সহযাত্রী ও সহমর্মীও। মাদরেনই তর্জমা করে রম্যাঁ রলাঁকে শোনাতেন ভারতীয় বিভিন্ন প্রসঙ্গের সাথে বিবেকানন্দের রচনাও। আর সেভাবেই ১৯৩০ সালে রচিত হয়েছিল জীবনী সাহিত্য ইতিহাসের বিস্ময়কর সৃষ্টি – Vie de Vivekananda (Life of Vivekananda), ফরাসি ভাষায়।

সেটি ছিল রলাঁ রচিত শেষ জীবনীগ্রন্থ। এর ঠিক আগের বছরেই লিখেছিলেন Vie de Ramakrishna। একই বছরে প্রকাশিত তাঁর অন্য গ্রন্থটি হলো L’Inde Vivante (Living India) যেটিরও বিষয় ছিল ভারত। তবে উল্লেখের যে মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে তাঁর গ্রন্থটি বেরিয়েছিল অনেক আগেই – ১৯২৪ সালে। জীবনী রচনার ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ববর্তী প্রয়াসগুলো হলো বিথোভেন (১৯০৩) মাইকেল্যাঞ্জেলো (১৯০৭), হ্যান্ডেল (১৯১০) ও তলস্তোয় (১৯১১)। জেনে রাখা যেতে পারে যে রবীন্দ্রজীবনী রচনার ইচ্ছাও রম্যাঁ রলাঁর ছিল যদিও সেটা বাস্তবায়িত হয়নি।

- Advertisement -

রম্যাঁ রলাঁর জীবনী থেকে জানা যায় ছাত্রাবস্থাতেই ইউজিন ব্যুর্ন্যুফ-এর ফরাসি অনুবাদে ভাগবতপুরাণ এর কপি তাঁর হাতে পড়েছিল। উপন্যাস জ্যাঁ-ক্রিসতফ-এ ব্যবহার করেছিলেন ভগবদগীতার শ্লোক। এরপর যোগাযোগ ঘটে শ্রীলঙ্কার লেখক আনন্দ কেন্টিশ কুমারস্বামীর (১৮৭৭-১৯৪৭) সাথে যিনি রলাঁকে পাঠিয়েছিলেন গীতার অনুবাদ। ১৯১৬ সালে জাপান ভ্রমণকালে রবীন্দ্রনাথ যে ভাষণ দেন সেটি পত্রিকায় পড়ে একাত্ব বোধ করেন রলাঁ। শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের সাথে পত্র যোগাযোগ। ১৯২১ সালের ১৯ এপ্রিল পারীতে রলাঁর সাথে দেখা করেন তাঁর মনন ও চিন্তার ভারতীয় দ্বৈত সত্ত্বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের আগে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ প্রসঙ্গ রলাঁর কাছে ছিল অপরিচিত। তিনি আমেরিকা প্রবাসী লেখক ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের (১৮৯০-১৯৩৬) মুখেই প্রথম রামকৃষ্ণের জীবনকাহিনী শুনেছিলেন। দুজনের সাক্ষাতের পূর্বেই রল্যাঁ পড়ার সুযোগ পান ধনগোপালের লেখা ১৯২৬ সালে প্রকাশিত রামকৃষ্ণের জীবনী The Silence of Face যা পড়ে রলাঁ অনুভব করেছিলেন রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের আসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে পড়া ও পড়ানোর তাগিদ। রলাঁ ধনগোপালকে অনুরোধ করেছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে।

এর কিছুদিন পরই রলাঁর সংস্পর্শে আসেন বিবেকানন্দের আমেরিকান বান্ধবী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড। বিবেকানন্দের নিকট সান্নিধ্যে সাত বছর থাকা এই রমণী যেমন আমেরিকাতে বিবেকানন্দকে আতিথ্য দিয়েছেন তেমনি ভারতবর্ষে তাঁর ভ্রমণসঙ্গী হয়েছিলেন দীর্ঘকাল। তাঁর সাথে ব্যক্তিগত সংযোগের স্মৃতিসমূহ এবং রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সংক্রান্ত পুস্তকাদির সংগৃহীত রাশি রম্যাঁ রলাঁকে এই দুই মহান অধ্যাত্মবাদী ভারতীয়ের সম্পর্কে দিতে পেরেছিল ব্যাপক ও পরিচ্ছন্ন একটি ধারণা।
রলাঁ ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ করেন রামকৃষ্ণ জীবনী। বিবেকানন্দের জীবনী লেখা চূড়ান্তভাবে শেষ হয় ১৯২৯ সালের জুন মাসের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে রামকৃষ্ণ মঠ থেকে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে Linda Prugh-এর গ্রন্থ Josephine Macleod and Vivekananda’s Mission। রলাঁ রচিত মূল ফরাসি গ্রন্থ দুটি প্রকাশ হওয়ার আগেই সেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ ভারত থেকে ছাপা হয়। কলকাতার অদ্বৈত আশ্রম থেকে E.F. Malcolm-Smith এর ইংরেজি অনুবাদ The Life of Ramakrishna এবং The Life of Vivekananda and the Universal Gospel বর্তমানে বাজারে লভ্য।

ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের সাথে সাথেই জীবনীগ্রন্থ দুটি জুরিখ থেকে জার্মান, হলান্ড থেকে ডাচ, স্টকহোম থেকে সুইডেন এবং মাদ্রিদ থেকে স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশ পায় ১৯৩১ সালের ভেতর যা বিপুলসংখ্যক ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের বিস্ময়ের খোরাক হয়েছিল। গান্ধীর জীবনী রচনা করে তিনি যেমন ইউরোপে গান্ধীকে পরিচিত করে তুলেছিলেন তার ব্যতিক্রম ঘটেনি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ক্ষেত্রেও।

বিবেকানন্দের জীবন ও বিশ্ববাণী শিরোনামে রলাঁর বইটি বাংলাতে অনুবাদিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৫৩ সালে কলকাতার ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি থেকে। সে গ্রন্থের আর কোন অনুবাদ ১৯৫৩ সালের আগে বা পরে বাজারে এসেছিল কিনা তা বর্তমান আলোচকের অজানা। তবে ঋষি দাসের সে অনুবাদটি প্রকাশের পর মাত্র পনের বছরে চারটি সংস্করণ ছাপা হয়েছিল যা থেকে ধারণা করা যেতে পারে অনুবাদটি যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল।

রলাঁ তাঁর বিবেকানন্দ বিষয়ক গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড অর্থাৎ ‘The Universal Gospel-এ উচ্চারণ করেছিলেন ইউরোপ ও এশিয়ার মহামিলন। গ্রন্থের শেষাংশে রলাঁর উদ্ধৃতি দিয়েই এ লেখা শেষ করব। রলাঁ লিখেছেন: ‘আমার ইউরোপীয় বন্ধুরা, আমি আপনাদিগকে প্রাচীরের অন্তরালে আসন্ন এশিয়ার আঘাতের শব্দ শুনাইয়াছি। …যান, আপনারা তাহার সহিত মিলিত হউন! সে আমাদের জন্য কাজ করিতেছে। ইউরোপ ও

এশিয়া আত্মার দুই অর্ধাংশ। মানুষ এখনও আসে নাই। মানুষ আসিবে। ভগবান এখন বিশ্রাম করিতেছেন এবং তাঁহার সর্বাপেক্ষা মনোরম সৃজনের, সপ্তম দিবসের সৃজনের ভার আমাদের হাতেই দিয়াছেন। বন্দী আত্মার সুপ্ত শক্তিগুলিকে জাগ্রত ও মুক্ত করিতে হইবে! মানুষের মধ্যে ভগবানকে জাগ্রত করিতে হইবে; “সত্তাকে” নূতন করিয়া সৃষ্টি করিতে হইবে।’

ইস্টইয়র্ক, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles