কলঙ্ক নেব না, যদি ভালবাসা দাও, ভেবে দেখব। লোকালয় ছেড়ে অরণ্যে যাব যদি ভালবেসে হাত ধর।
স্বপ্ন দেখব না, যদি ঘর বাঁধো, ভেবে দেখব। অপলক চেয়ে থাকব যদি ভালবেসে পাশে বস।
অবিশ্বাসে নয়, যদি বিশ্বাস দাও, ভেবে দেখব। বিদূর থেকে টেনে আনব যদি ভালবেসে স্পর্শ কর।
দুঃখ চাই না, যদি কষ্ট দাও, ভেবে দেখব। সব অশ্রু শুকিয়ে নেব, যদি ভালবেসে বুকে রাখ।
চিঠিটা আমারই লেখা। তারিখ ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮।
মনে করে দেখ তো বলোনি তুমি, বিয়ের পর প্রতি পূর্ণিমায় ছাদে বসে রাত কাটাবে এক সাথে।
বলোনি, দুই মাসে একবার যাবে কক্সবাজার সমুদ্র দেখতে।
ছয়মাসের মাথায় যাবে কোলকাতা, দুই বছর হলে ব্যাঙ্কক।
আর, বিবাহিত জীবনের পাঁচ বছর উদযাপন করতে যাবে ডিজনীল্যাণ্ডে, আমেরিকায়।
তোমার বাবা সরকারি কর্মচারী ছিলেন, সৎ বলে অঢেল পয়সা ছিল না। তুমি তারই ছেলে। চুরি না করলে ছাত্রজীবনে পয়সা পাবে কোথা থেকে। সবসময় বাসে চড়ে আসতে আমাদের বাড়ি। কখনোসখনো বাসের পয়সাটাও থাকতো না। তবুও চাঁদ দেখার মতো আমার দিকে চেয়ে থাকতে দুই মাইল পথ হেঁটেই আসতে।
মনের ভেতর জেগে ওঠা সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব আমি চিঠিতে লিখে দিতাম। ভালবাসার একটা অঙ্গীকার থাকে। হয়তো সে অঙ্গীকারের নাম বিশ্বাস। তোমার কাছ থেকে একটা বিশ্বাস উড়ে এসে আমার হৃদয় জুড়িয়ে দেবে সে আশায় বসে থাকতাম। একদিন আমার সব চিঠির জবাব দিলে তুমি অন্যরকম করে। ভালবাসার এমন চিঠি হয়তো আগে কেউ লেখেনি কখনো। তোমার পাগলামির কোনো রকমসকম ছিল না। সব পাগলামিই আমাকে অবাক করতো। অবাক হতে হতে একদিন সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে গেলাম।
তুমি আমাকে অনুরোধ করলে ঘরের মধ্যে খালি পায়ে দশ কদম হেঁটে দেখাতে, সেটাই নাকি সব চিঠির জবাব হবে। কি করে মাটির সাথে নিবিড় একটা বন্ধন গেঁথে হাঁটতে হবে সেটাও বুঝিয়ে দিলে। তোমার শেখানো পন্থায় আমি দশ কদম হেঁটে এলাম। এক অদ্ভুত মায়াজাল ছিল তোমার অনুরোধে। অবজ্ঞা ছিল অসাধ্য। এরপর জুতা মোজা খুলে আমার পায়ের নিশানা খুঁজে খুঁজে কদমের উপর কদম রেখে তুমি যখন থেমে গেলে, তখন আমি আর তুমি এক হয়ে গিয়েছিলাম। এক কদমে এক জোড়া মানুষ।
এখন বলো, কি করে পারলে সেই চাঁদ মুখে হাত তুলতে, তা’ও বিয়ের দুই বছরের মাথায়। যখন আমাদের ব্যাঙ্কক যাবার কথা। পাঁচ বছরের মাথায় যখন যাব আমেরিকা, তখন গলায় ও গালে কি সব লালচে দাগ মাখিয়ে ঘরে ঢুকতে আরম্ভ করলে। ঐ সমস্ত দাগ দেখে বুঝতে কষ্ট হতো কোনটা লতার আঁকা। কোনটাই বা শিল্পীর। ভালবাসার অন্য রূপ দেখাতে শুরু করেছিলে তারও কিছুদিন আগে। ইচ্ছে করে ভাতের থালায় লাথি বসাতে মাঝে মাঝে। মনে করতে ঐ সামান্য ভাতের থালা বুঝি পূর্ণিমার চাঁদ, আর তুমি হলে চাঁদ বিজয়ী নভোচারী।
গরিব আমরাও ছিলাম। তোমার গরিবত্ব নিয়ে কোনো হিংসা ছিল না। কিন্তু ঘরে ঢুকে একসময় তুমি যেভাবে হুঙ্কার দিতে শুরু করে দিতে, তখন আর তোমাকে গরিব মনে হতো না। মনে হতো তোমার দুই কামরার ঘরটা একটা ছোট্ট জমিদারি, তুমি এক জেদি জমিদার এবং ভীষণ প্রতাপশালী। অন্যদিকে আমি এক সামান্য প্রজা। তোমাকে দেখামাত্র দাঁড়িয়ে থাকা উচিৎ। জাঁহাপনার হাসি ফুটিয়ে রাখা উচিৎ চোখেমুখে।
নাটক(মনোলোগ, ২০০৪) ‘কদম কদম ভালবাসা’ থেকে অংশ বিশেষ।
স্কারবোরো, কানাডা