13 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, মে ২, ২০২৪

ভুলু

ভুলু

ভুলুর নিজস্ব কোন বাড়ি নেই। ভুলুদের কখনো নিজের বলে কিছু থাকে না। এই যেমন কুড়িয়ে এনে ফরিদ মাষ্টার তাকে ঘরে রেখেছে। সেই থেকে ফরিদ মাস্টারের বিশ্বস্ত কুকুর সে। ফরিদ মাষ্টার যখন ঘর থেকে বেরিয়ে কোথাও যায় ভুলু তার পিছন পিছন কিছুদূর গিয়ে এক দৌড়ে ফিরে আসে উঠানে। এসেই অকারণে দুচারটা ডাক দেবে। তখন মনে হয় মনিবকে সে জানিয়ে দিচ্ছে আমি নিরাপদে ফিরে এসেছি। বাকীটা পথ তুমিও সাবধানে যেও।
মাস্টার বাড়ির পরিবেশটা বেশ মনোরম। সাদা দেয়ালের উপর টিনের চাল। লাল পাকা মেঝেতে কালো বৃত্ত সাথে কিছু ফুল আঁকার চেষ্টা। চারিদিকে যত্রতত্র নারকেল সুপারি গাছ। রান্না ঘরের কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটা পুকুর যা খেজুর গাছে ঠাসা। মেয়েরা গোসল করতে নামলে দূর থেকে কেউ যেন দেখতে না পায় সেই বন্দবস্ত।

- Advertisement -

বাড়ীর মেয়েরা পুকুরে নামলে ভুলু চারপাশে ঘুরঘুর করে পাহারা দেয়। নিজেও মাঝে মাঝে নেমে যায় পুকুরের এক কোনা দিয়ে। যেদিক দিয়ে কেউ নামে না অর্থাৎ পরিত্যক্ত আবর্জনায় ভরা ঐ দিকটা হলো ভুলুর পুকুর পাড়। বড্ড শীত কাতর। নামলো কি উঠেই গা ঝাড়া দিয়ে দৌড়। ব্যস ঐ পর্যন্ত। উঠানের যে দিকটাতে বেশীরভাগ সময় ভুলু শুয়ে থাকে সেই জায়গাকে বলা হয় ভুলুর যায়গা। বারান্দার যে স্থানে বসে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়া দেখে সময় কাটায় সেই কোনাটা হলো ভুলুর ঘুপচি। এতসবের পরও ভুলুর নিজস্ব বলে কিছু নেই। লোকে বলে মাষ্টার বাড়ীর কুকুর। জমিজমা নিয়ে ফরিদ মাস্টারের সাথে যাদের মামলা মকদ্দমা চলে সেই বাড়ির সবাই ভুলুকে ডাকে ছোট মাষ্টার।

ভুলুর একজন পছন্দের মানুষ আছে। তার নাম বেলি। বেলি গ্রামের অনাথ মেয়ে। এ বাড়ি ও বাড়ির পরিত্যক্ত স্থানে সে জীবন কাটায়। অনাহার নিত্য সঙ্গী তাই দেখতেও বেশ হাল্কা পাতলা। বাতাসের আগে উড়ে বেড়ায়। এ বাড়িতে চার মাস তো অন্য বাড়িতে ছয়। শুধু উকিল বাড়িতে এক নাগাড়ে তিন বছর থাকতে পেরেছিল। যখন যে বাড়িতে থাকে তখন তাদের খুচরা কাজ করে দেয়। কখনো খায় কখনো না খেয়ে কাটায়। গত দুই সপ্তাহ কেউ বেলিকে বাড়িতে রাখছে না। স্বভাবতই আবার সেই না খাওয়া দাওয়া অবস্থা। অথচ দিনের একটা নিদিষ্ট সময় ভুলু তার জন্য অপেক্ষে করে থাকে। তার জন্য বলা হয়তো ঠিক হলো না। বেলি যে খাবার নিয়ে আসে সেটার জন্য ভুলুর অপেক্ষা। ভুলুকে সে শুধু খেতেই দেয় না। গল্প করে করে খাওয়ায়।

গেল কিছুদিন বেলির খাবারের তালিকা হযবরল হয়ে গেছে। একদিন বিস্কুট তো অন্যদিন আচার। আবার কখনো এক প্যাকেট চিপস। বোঝাই যাচ্ছে যখন যা চেয়ে পায় সেটাই নিয়ে আসে ভুলুর কাছে। খালি হাতে কখনোই আসে না। যেন খালি হাতে এলে ভুলুর অমঙ্গল হবে। ভুলুও কম যায় না। কেমন করে যেন সে বুঝে ফেলে বেলির দিন ভালো যাচ্ছে না।

প্রথমবারের মতো আজ বেলিকে খালি হাতে আসতে হলো। ভুলুর গলায় হাত বুলিয়ে এক বিয়ে বাড়ির গল্প বলে গেল অনেকক্ষণ। ভুলুকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো আর একটু দেরি করে এলে বিয়ে বাড়ির থেকে তোর জন্য কিছু খাবার আনতে পারতাম। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তাই খালি হাতেই আসতে হলো। বিয়ে বাড়িতে কি রান্না হচ্ছিল সেটা বেলির জানার কথা না। তবে গন্ধ শুঁকে মনে হয়েছে অনেক সুস্বাদু কিছু হবে হয়তো। বিরানি পোলাও সাথে নাম না জানা অনেক কিছু। বেশিক্ষণ খাবারের গল্প করলে ভুলুর যদি খেতে ইচ্ছে করে তাই প্রসঙ্গ বদলিয়ে বিয়ে বাড়ির রঙিন সাজ, পোশাকের বাহার এসব গল্প বলতে লাগলো। গল্প করতে করতে বেলি বুঝতেই পারেনি ভুলু কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আলতো করে ভুলুর মাথাটা নিজের পায়ের উপর থেকে নামিয়ে সে চলে যায় স্কুল ঘরের দিকে। আজ রাতে সে লাইব্রেরীর বারান্দায় ঘুমাবে।

রাত ঘন হয়ে এসেছে। পূর্ণিমা আসতে এখনো চৌদ্দ দিন বাকী। বেলি খালি পায়ে হাঁটে আর চোখ বড় বড় করে দেখতে থাকে পথে কোন সাপ ইঁদুর আছে কিনা। ঝিঁঝিঁ পোকারা অনবরত ডেকেই চলেছে। যে গাছের নিচ দিয়ে বেলি হেঁটে যায় সেখানে সামান্য নীরবতা নেমে আসে। একটু এগিয়ে গেলে পিছন থেকে আসে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। শূন্য পেট সে জন্য নয়, ওর বেশ ঘুমও এসে গেছে। সামান্য হেলে দুলে হাঁটছে বেলি। অনেকটা নেশাখোর পথ শিশুদের মত। স্কুলের মাঠ পেরিয়ে লাইব্রেরীর বারান্দায় এসে প্রথমে পরীক্ষা করে দেখে কতটুকু ঠাণ্ডা হয়ে আছে পাকা বারান্দা। ঘুমাতে না পারলে সারারাত বসে বসে কাটাতে হবে।

স্কুল সিকিউরিটি বাবুল মিয়া দিনের বেলায় নেশা করা সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছে। যদিও সন্ধ্যার পর দু’এক ঢোক না গিলে পারে না। টিএনও সাহেব বলে দিয়েছেন আর যদি কখনো তার নামে কমপ্লেন আসে তবে চাকরি নট। সে কারণে বাবুল মিয়া বোতলে হাত দেয় না। ওর চরিত্র এখন দু’এক ঢোকে এসে ঠেকেছে। টর্চ লাইট জ্বালিয়ে সে প্রথমে যায় কম্পিউটার ল্যাব বিল্ডিং। এরপর লাইব্রেরীর এক পাশে দিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে আসতে গিয়ে চোখ কচলাতে শুরু করে। বাবুল মিয়ার টর্চের আলো এক জায়গায় স্থির থাকে না। কাঁপতে থাকে আলো। ততক্ষণে বেলি গভীর ঘুমে নাক ডাকছে। ওর শরীরে ঠাণ্ডা ভাবটা এক সময় আর থাকে না। বেশ উষ্ণ একটা অনুভূতিতে সে সামান্য নড়াচড়া করে। এদিকে দূর থেকে ভুলুর আওয়াজ শোনা গেল। সে খুব দ্রুত স্কুলের দিকে এগিয়ে আসছে। যত কাছে আসে ভুলুর চীৎকার ততোই উঁচুতে উঠেতে থাকে। ভুলু দৌড়ায় রেসের ঘোড়ার মতো।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles