13.5 C
Toronto
রবিবার, মে ৫, ২০২৪

‘প্রতি রাতে ১৮ জন পুরুষের সঙ্গে ঘুমাতে হতো’

‘প্রতি রাতে ১৮ জন পুরুষের সঙ্গে ঘুমাতে হতো’

কাজ এবং উপার্জনের আশায় অবৈধ পথে বাংলাদেশ থেকে ভারতের গুজরাটে আসেন সালমা (ছদ্মনাম)। অপ্রাপ্তবয়স্ক এ মেয়েটি অনেক কম বয়সেই এখানে খুব তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। নিজের সেই অন্ধকার জীবনের গল্প বলেন বিবিসি গুজরাটের কাছে। ঘরে ফিরে যাবার আগে যে গল্প সে বিবিসি গুজরাটকে বলেছে, তা ছিল খুবই হৃদয় বিদারক।

- Advertisement -

সালমা জানান, একবার তার খালা ভারত থেকে ঈদের সময় তাদের বাড়িতে বেড়াতে যান। সে সালমার মাকে বলেন যে, তাকে (সালমা) ভারতে নিয়ে গিয়ে একটা চাকরি দেবেন। এতে করে তাদের সংসারে আর অভাব থাকবে না। কিন্তু সালমাকে গুজরাটে এনে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তারপর থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৮ জন লোক তার দেহ আঁচড়ে খেয়েছে।

বাংলাদেশে ফিরে যাবার আগে সালমা দুবছর ছিলেন ‘জাগরুত মহিলা সংস্থা’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে। এরা তাকে চিকিৎসা এবং কাউন্সেলিং সেবা দিয়ে নতুন করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এরাই সালমাকে বাংলাদেশে তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়।

সালমা গুজরাট ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন, কিন্তু এই বয়সেই শারীরিক ও মানসিক যে ক্ষত তার তৈরি হয়েছে, সেটি হয়তো জীবনেও পূরণ হওয়ার নয়।

জাগরুত মহিলা সংস্থার প্রেসিডেন্ট আশাভান দালাল জানান, পুলিশ প্রায় আড়াই বছর আগে সালমাকে তার অফিসে নিয়ে আসে। পুলিশ সালমাকে স্থানীয় একটি বাসস্ট্যান্ডের কাছে খুবই বিচলিত অবস্থায় দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে।

আশাভান বলেন, ‘সে যখন আমার অফিসে আসে, তখন সে চুপচাপ হয়ে একটা কোণে বসে থাকতো। আমরা চিকিৎসা করি। ধীরে ধীরে সে কথা বলতে শুরু করে। সে যখন নিজের সম্পর্কে বলা শুরু করে তখন আমরাই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।’

সালমার গল্প শুরু হয় বাংলাদেশে। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করার কারণে, ভারতে নিয়ে এসে সালমাকে তার এক আত্মীয় পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে, যাকে সে খালা বলে ডাকতো।

সালমা বলেন, ‘খালা তখন বলেছিলেন যে, ভারতে সেও অনেক টাকা আয় করে। সে আমার মাকে বলেছিলেন যে, এখানে মানুষ অন্যের বাসায় কাজ করেও অনেক টাকা আয় করতে পারে। আমরা মনে করেছিলাম যে, চাকরি পেলে আমাদের অভাব দূর হবে। আর আমরা সেটাই করলাম।’

তখন সালমার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। তার খালা তাকে অবৈধভাবে ভারতে নিয়ে যায়। সালমা জানান, ভারতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তার খালার আচরণ বদলে যায়। ভারতে পৌঁছানোর পর তার খালা বলেন, ‘তোমার পাসপোর্ট নেই। তুমি এখানে অবৈধভাবে এসেছ। আমি যেখানে কাজ দিবো, তোমাকে সেখানেই যেতে হবে, তা না হলে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরবে।’

সালমা হিন্দি জানতো না। কিন্তু সে কোন না কোন ভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, সে সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে।

সালমা বলেন, ‘একদিন আমার খালা আমাকে একটি হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে সে আমাকে একজন লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি জানি না তাদের মধ্যে কী কথা হয়, কিন্তু খালা বলেন যে, ভারতে থাকতে হলে তাকে আমার টাকা দিতে হবে।’

সালমা তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে, সে কিভাবে তার মায়ের কাছে টাকা পাঠাবে যদি সে বেতন না পায়। সেখান থেকেই সালমার সমস্যার শুরু। সে খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারে যে তাকে বিক্রি করা হয়েছে। এরপর প্রতি রাতেই হতো তার নিজের বিকিকিনি।

সেই সব ভয়ংকর দিনগুলোর কথা মনে করে সালমা বলেন, ‘প্রতি রাতে তারা আমার দেহ আঁচড়ে খেয়েছে। অনেক সময় আমাকে ১০ জনের সঙ্গে শুতে হতো, কখনো কখনো ১৮ জনের সঙ্গেও থাকতে হয়েছে। এর বিনিময়ে আমি যা পেয়েছি তা হলো খাবার আর ঘুমানোর জায়গা। অনেক সময় খদ্দেররা বকশিস দিতো, আর সেটাই ছিল আমার একমাত্র উপার্জন। নিয়োগকর্তা আমাকে বলতো যে, সে আমার টাকা আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতো।’

কিন্তু পরে সালমা জানতে পারে যে, তার মা কোন টাকাই পায়নি। দেহ ব্যবসাটা অনেক সময় ফাঁদ এর মতো। সে সেখান থেকে পালাতে চাইতো, আবার পুলিশের কাছে ধরা পড়ারও ভয় ছিল। কিন্তু সালমা সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন এবং সেটি পেয়েও যান।

তার বক্তব্য, ‘একদিন হোটেলে কোন খদ্দের আসেনি। এই সুযোগে আমি হোটেল থেকে বেরিয়ে যাই এবং পালিয়ে একটি বাস-স্ট্যান্ডে গিয়ে পৌঁছাই।’

হঠাৎ সে পুলিশদের দেখতে পায়। সে বলে, ‘পুলিশের চোখ এড়াতে আমি লুকিয়ে পড়ি, কিন্তু আশেপাশের লোকজন মনে করে যে আমি চোর এবং তারাই আমাকে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।’

সালমাকে যখন পুলিশ ধরে তখন সে তার নাম বলেনি। কিন্তু তার অবস্থা দেখে পুলিশ তাকে মহিলা আশ্রমে নিয়ে যায়। অনেক নিপীড়িত নারী ওই প্রতিষ্ঠানটিতে বাস করতো যেখানে তাদেরকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করা হয়।

এই প্রতিষ্ঠানে আসার পর নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে সালমা বলেন, ‘এখানে এসে মনে হচ্ছে আমি বাড়িতে এসেছি, কিন্তু এখনো আমি পুলিশকে ভয় পাই। এখানকার ভাল ব্যবস্থাপনা দেখে, আমি ধীরে ধীরে তাদের আমার বিষয়ে, আমার যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলতে শুরু করি। আমি তাদের এটাও বলেছি যে, আমি বোকা নই, আমি পুলিশের ভয়ে কিছু বলিনি।’

সালমার আসল অবস্থা জানার পর পুলিশকে জানায় সংস্থাটি, সরকারকেও জানায়। বাংলাদেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাকে তার বাড়িতে পাঠানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়।

জাগরুত মহিলা সংস্থার প্রেসিডেন্ট আশাভান দালাল বলেন, ‘তাদের সহায়তায় আমরা তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি। তার মাকে মেয়ের এই দুরবস্থার কথা জানানো হয়েছে। সে তার জীবনে প্রথমবারের মতো পাসপোর্ট তৈরি করে তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসছে।’

সালমা দুই বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে যেখানে সে এমব্রয়ডারি, সেলাই এবং কৃত্রিম গয়না তৈরি করতে শিখেছে। সালমা তার তৈরি করা পণ্য বিক্রি করে দুই লাখ রুপি আয় করেছে। সালমা যখন তার মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে যায়, এই প্রতিষ্ঠানটি তার আয় করা দুই লাখ রুপি তাকে দিয়ে দিয়েছে।

এদিকে, সালমার সেই খালাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সালমা এখন মায়ের বাড়িতে।

সূত্র : আমাদের সময়

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles