6.8 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

অটোয়ার নতুন বাসিন্দা

অটোয়ার নতুন বাসিন্দা
ছবি ড্রিউ কফম্যান

সকাল সাতটা।
দখিনা বাইরের ঘরে দুধ-ওট খাচ্ছিল। তার দিকে তাকিয়ে বললাম- দেখিস আম্মু, মুখ না ধুয়ে স্কুল যাস না যেন। সারা মুখে দুধ লেগে আছে
– ওকে
– আচ্ছা আম্মু, আমি কি সকালে মুখ ধুইছিলাম?
– খেয়াল করিনি
– তোর স্কুল থেকে মেসেজ আসছে [ ইমেইল চেক করে রসিকতা করে বললাম]
– কী লিখছে আব্বু?
– লিখছে.. দখিনা.. তুই যেন ঠিক আটটায় রাস্তার পাশে বাসের জন্য দাঁড়ায়ে থাকিস

– উফফ আব্বু!
– আরো লিখছে বাস আজকে একদম লেট করবে না!
– আব্বু তুমি এতো ফান করো কেন? আমি কিন্তু মুখ ধুবো না!
– এভাবে স্কুল গেলে সবাই তোকে বিলাই ডাকবে
– আগে সরি বলো?
– আচ্ছা সরি!
সে ভেবেছিল তার স্কুল বাস বাতিলের খবর দেব। স্কুল বাস বাতিল মানেই তাকে স্কুলে যেতে হবে না। আশায় গুঁড়েবালি।

- Advertisement -

সে নাস্তা শেষ করে দৌড়ে এসে এঁটো মুখে আমার দুই গালে ওট-দুধের আঠালো ঝোল লেপ্টিয়ে, ঠেসে চুমু দিয়ে খিলখিল হাসতে হাসতে ধুপধাপ সিঁড়ি বেয়ে পালাতে পালাতে বলল- আব্বু, আমি তোমার থেকেও বেশি দুষ্টু হবো!
এবার ছেলেটা আসলো। সে ইদানিং খুব গম্ভীর থাকার ব্যার্থ চেষ্টা করে। তার দিকে চেয়ে এক গাল হেসে বললাম- কি রে বিত্ত, তোকে দেখি নায়ক নায়ক লাগতেছে!
– আব্বু, আমার কিচ্ছু ভালো লাগতেছে না..
– শরীর খারাপ?
– এমনি ভালো লাগতেছে না
– তোকে কিন্তু খুব হ্যান্ডসাম লাগতেছে
– তুমি কেন আমাকে শেভ করতে বললা? আগেই ভালো ছিল..
সে আলগা রাগ অভিমান দেখানোর চেষ্টা করতে থাকে। নতুন লুকে স্কুল যেতে খুব দ্বিধা করছে।

কাল রাতে অনেক রিকোয়েস্ট করে তার দাঁড়ি-গোঁফ কাটিয়েছি। একেবারে ক্লিন শেভড! বাংলাদেশে গেলে তার কাজিনরা, কাকু-ফুপু অনেক চেষ্টা করেও তার গোঁফ কাটাতে পারেনি। সেদিন স্কুল থেকে এসে বলল- আব্বু একটা মজার ব্যাপার ঘটছে। ছোট্ট বাচ্চা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করছে, তোমার গোঁফে কেমন ফিলিংস লাগে?
আমরা হো হো করে হাসতে থাকি..

কাল রাতে হাতেনাতে শিখিয়েছি শেভ করানো। সে ঘুমানোর আগে কয়েকবার স্কুল ব্যাগ পিঠে আয়নার সামনে ট্রায়াল দিয়ে দেখেছে তাকে কেমন লাগে। দখিনা দেখে হাসতে হাসতে কুটিপাটি..
সত্যি তাকে দেখে মনে হচ্ছে এডাল্ট মানুষ। অথচ আর কিছুদিন পর সে চোদ্দ বছরে পা দেবে। ছয় মাস পর হাই স্কুলে যাবে।

আমি নাস্তা করে খবরের সামনে বসি।
মেয়েটা চিরুনি হাতে মায়ের পাশে বসে অপেক্ষা করছে মাথা আঁচড়িয়ে নিতে। তার মা বিত্ত কে ভাতভাজি-ডিমভাজি চামুচে করে খাইয়ে দিচ্ছে। বললাম- এই ব্যাটা, বড় হবি না?
– আমাকে দেখতে কেমন খারাপ লাগতেছে? [সে লজ্জা, রাগ, অস্বস্তি মেশানো অভিব্যক্তি নিয়ে দুই গালে হাত দিয়ে বলল]
– দেখিস তুই স্কুলে গেলে তোর গার্ল ফ্রেন্ডরা কত খুশি হয়!
– স্টপ আব্বু স্টপ, প্লিজ!
আবার দখিনা হাসতে হাসতে লুটোপুটি।

আমরা অটোয়ার এ এলাকার নতুন বাসিন্দা। হেনরি লারসন স্কুলে তার মা প্রথম কদিন তাকে দিয়ে আসতো। তার প্রেস্টিজে খুব লাগতো। মা কে পেছন ফেলে সে আগে আগে হাঁটতো, যেন কেউ বুঝতে না পারে ওটা তার মা।
গিন্নীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওর ক্লাসের বন্ধু বান্ধব কেমন দেখলা?
– ভালো। বাঙালিও আছে। কেন?
– না, মানে মেয়েগুলা দেখতে কেমন?
– বাবা রে বাবা.. আর বইলো না, যে ড্রেস পরে সব!
– ছেলেটার কপালে যে কী আছে!

আমি ছোটকালে বিত্ত’র চাইতেও বেশি মুখচোরা ছিলাম।
দাঁড়ি-গোঁফ উঠার পর এমন লজ্জায় পড়ছিলাম! ক্লাস সিক্সে ডাক্তার চশমা দেবার পর ক্লাসের সবাই কী ভাববে ভেবে বছরখানেক চশমা পরিনি। শেষে আব্বার বোকা খেয়ে যেদিন পরে গেলাম; নাম হয়ে গেলো চার চোখ!

আমি জ্যাকেট গায়ে অফিসে জন্য রেডি হয়ে চাবির গোছা হাতে নিতেই দখিনা দৌড়ে এসে আমাকে আলিঙ্গন করে সারা মুখে, টাকে বেশ কিছু চুমু দিয়ে নিত্যদিনের মতো বলতে থাকে- “আব্বু আই লাভ ইউ, মিস ইউ, আসসালামু আলাইকুম, সি ইউ, বাই..”
এই একই বিদায় বার্তা সে ঘুমানোর আগেও দেবে। বাজারে কিম্বা বাইরে ঘুরতে গেলেও। শুক্র আর শনিবার আমার সাথে ঘুমায়, বাকি পাঁচদিন মায়ের সাথে। একা ভয় পায়। মায়ের সাথে ঘুমানোর আগে ঠিক একইভাবে বিদায় নিয়ে যাবে। এমন কি, পাশের ঘরে লাইট-দরজা বন্ধ করে শুয়ে আবার কান ফাটানো চিৎকার মারবে- “আব্বু আই লাভ ইউ, মিস ইউ..”
তার মা বিরক্ত হয়ে চিল্লিয়ে উঠবে, এক কথা আর কয়বার বলবি? কানের পর্দা ফাটায়ে দিলি তো!
তবুও লাভ হয় না, কিছুক্ষন পর আবার চিৎকার.. আব্বু আই লাভ ইউ…!

এ তো গেলো বাচ্চা কাচ্চা।
সেদিন এমন অস্বস্তিতে পড়ছিলাম! অফিসে যাচ্ছিলাম লেট এ। দখিনাকে বাস স্টপেজে নামিয়ে দিতে গেলাম তার মা শুদ্ধ। মেয়েকে বিদায় দেবার সময় তার মা পর্যন্ত লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে আমাকে হাগ করলো! তাও আবার বাসআলার সামনে?
ছিঃ ছিঃ..

রাতে মেয়ে বিদায় দেবার পর আসবে ছেলের বিদায় পালা। ছেলে আরো মারাত্মক; আমি ঘুমিয়ে গেলেও ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে বলবে, আব্বু গুড নাইট!
– গুড নাইট! [আমি ঘুম ঘুম গলায় বলবো]
– বাই বাই!
– বাই!

এখানেই শেষ না; সে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আবার চেঁচাবে, আব্বু এটাই ফাইনাল; গুড নাইট!
আমি বিরক্ত হয়ে চুপ থাকলে আবার গলা ফাটাবে- আব্বু গুড নাইট! আব্বু?
– হা, গুড নাইট বাবা
– বাই!
– বাই। আর না রে বাপ..
– বাই!.. আব্বু.. আব্বু.. আব্বু?

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles