18.1 C
Toronto
শনিবার, মে ৪, ২০২৪

এক পুলিশ ক্লান্ত হলে আরেক পুলিশ পেটাত

এক পুলিশ ক্লান্ত হলে আরেক পুলিশ পেটাত - the Bengali Times

সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকা শান্তিগঞ্জের যুবক উজির মিয়ার মৃত্যুর পর বেরিয়ে আসছে পুলিশ হেফাজতে অমানুষিক নির্যাতনের লোমহর্ষক সব বর্ণনা। উল্টো করে ঝুলিয়ে তাকে পেটানো হতো। এক পুলিশ ক্লান্ত হলে আরেক পুলিশ পালাক্রমে পেটাত বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা গেছে।

- Advertisement -

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, শান্তিগঞ্জ থানায় পুলিশ হেফাজতে পায়ের সাথে আড়াআড়ি করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ঝুলিয়ে পিটানো হয় উজির মিয়াকে। নির্যাতনে বেহুঁশ, অজ্ঞান হলে পুলিশ হাসি-ঠাট্টা করত ‘অভিনেতা’বলে। ‘তুই চোর, বল- তুই চোর’ বলেই অমানুষিক নির্যাতন চালায় পুলিশ। আর্তচিৎকার করলে চোখ-মুখ বেঁধে ফেলা হয়।

ঘটনার রাতে শান্তিগঞ্জ থানায় নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছিল উজির, শহিদ ও আক্তারের ওপর। এর মধ্যে আক্তারের বর্ণনা এ রকম— রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর পর দরজায় শব্দ শুনি। জিজ্ঞাসা করলে বলা হয়, আইনের লোক। দরজা খোলার পর এসআই দেবাশিষসহ কয়েকজন পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায়। পুলিশের সরকারি গাড়ি ব্যবহার না করে সিএনজি অটোরিকশায় করে নেওয়া হয় থানায়। সেখানে গিয়ে উজির মিয়া, শহিদ ও শামীমকে দেখতে পাই।

তিনি বলেন, পুলিশ শামীম ছাড়া উজির, শহিদ ও আমাকে আলাদাভাবে মারধর করে। এসআই দেবাশিষ ও অন্য ২ জন পুলিশ আমাদের লাঠিপেটা করেন। পুলিশের কথামতো নিজেকে চোর স্বীকার না করায় সবাইকে একস্থানে জড়ো করা হয়। তখন উজির ভাইয়ের হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো হলো, আমাদেরও লাগাল। দুটি টেবিল কাছাকাছি এনে একটা বড় লাঠির দুই দিকে দুই টেবিলে লাগিয়ে মাঝখানের অংশে উজির ভাইকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, ঝুলানোর আগে তাকে বসিয়ে তার দুই হাত দুই পায়ের পেছন দিকে ঢুকিয়ে সামনে দিয়ে বের করে মাথা নিচু করে ঘাড়ের উপরে দুই হাত নিয়ে হ্যন্ডকাফ লাগানো হয়। এরপর পেটের অংশ দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে দুইজন অফিসার ধরে তাকে পা উপরের দিকে দিয়ে ঝুলিয়ে দেন।

আক্তার বলেন, এরপর দেবাশিষ তাকে অনেক জোরে জোরে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। এ সময় উজির ভাইকে চোর স্বীকার করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। অনেক সময় ধরে এই নির্যাতন চলে। পায়ের নিচের অংশে সমস্ত শক্তি দিয়ে পেটানো হয়। উজির চিৎকার করতে করতে এক সময় অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলা হয় ‘অভিনেতা’।

তিনি বলেন, এভাবে নির্যাতন করে জোর করে আমাদের চোর বানানোর চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু উজির ভাইয়ের অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় রাত ২টা বা আড়াইটার দিকে আমাদেরকে নিয়ে সুনামগঞ্জের হাসপাতালে যায় পুলিশ। আমাদের ওষুধ দিয়ে থানায় আনা হলেও উজির ভাইকে ডাক্তাররা হাসপাতালে ভর্তি করতে বলে। তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।

একই রাতে শান্তিগঞ্জ থানার নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আটক শহিদ বলেন, উজির ভাইসহ আমাদের তিনজনকে ঝুলিয়ে পেটানো হয়। একজন পুলিশ যখন ক্লান্ত হন তখন আরেকজন পুলিশ পেটাতেন। তারা পেটান আর বলেন ‘তুই চোর, বল- তুই চোর’। অথচ উজির ভাইসহ আমরাই গ্রামে চুরি বেশি হওয়ায় পুলিশের কাছে অভিযোগ করা নিয়ে কাজ করেছি। উজির ভাই তো নিজে বাদীও ছিলেন। উজির ভাই এলাকার ভালো মানুষ। তারপরও তাকে চোর বলে যেভাবে মাথা নিচের দিকে দিয়ে পেটানো হয় সেটা কেউ দেখলে সহ্য করতে পারবে না।

তিনি বলেন, পুলিশের এমন অমানুষিক নির্যাতনে উজির ভাই যখন বেহুঁশ, অজ্ঞান হয়ে যান। তখন এসআই দেবাশিষ বলেন, সে ভঙ্গি ধরেছে, ভালো অভিনয় জানে। কিন্তু বিনা অপরাধে পুলিশের এমন মারধর মানুষটাকে আধমরা করে দেয়। পুলিশ প্রথমে উজির ভাইকে নিয়ে হাসাহাসি করে, রুমের মেঝেতে ফেলে রাখে। আমাদেরও অনেক মারধর করে, জীবনে কোনো দোষ না করেও মাইর খাইলাম। দেখলাম পুলিশের কাজ, চোরকে আরাম করে বসিয়ে রেখে তার কথামতো উজির ভাইরে চোরের গডফাদার বলে পিটাইল। রাতে হাসপাতালে না নিলে উজির ভাই থানাতেই মারা যেত।

উজিরের মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তে দুটি কমিটি কাজ করছে। এর মধ্যে একটি জেলা প্রশাসনের অপরটি পুলিশ প্রশাসনের। বৃহস্পতিবার তদন্ত প্রতিবেদন জমার কথা থাকলেও জমা হয়নি। বিষয়টি জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান। তবে দুটি দুটি তদন্ত টিমই সরেজমিন তদন্ত অনেকটা গুটিয়ে এনেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

উজির মিয়ার মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এদিকে অভিযুক্ত এসআই দেবাশিষ সূত্রধরকে দিরাই থানায় বদলি করা হয়েছে।

পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান জানান, যেহেতু এলাকাবাসী এসআই দেবাশিষ সূত্রধরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এই সময়ে ওখানে দায়িত্ব পালন করা বিব্রতকর। এজন্য তাকে দিরাই থানায় বদলি করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে গরু চুরির অভিযোগে উজির মিয়াকে আটক করে শান্তিগঞ্জ থানা পুলিশ। এরপর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করে এবং ১০ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্তি পান উজির। জামিন নিয়ে ওই দিনই সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন উজির মিয়া। ২১ ফেব্রুয়ারি অসুস্থতা বাড়লে কৈতক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানেই কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সূত্র : যুগান্তর

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles