-0 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

ক্ষুধার্ত পেটে একশ একটা ইঁদুরের ‘তান্ডব নৃত্য’ : লেখক হওয়া অতো সহজ না রে পাগলা…

ক্ষুধার্ত পেটে একশ একটা ইঁদুরের 'তান্ডব নৃত্য' : লেখক হওয়া অতো সহজ না রে পাগলা...
লুৎফর রহমান রিটন

একটা টিভি নাটক দেখলাম নাম ‘ভাঙন’। সেই নাটকের একটি চরিত্র আজাদ আবুল কালাম। দুর্ধর্ষ অভিনেতা। চরিত্রটা খিদে সহ্য করতে পারে না। খিদে পেলে খাবার রেডি না থাকলে মুহূর্তেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বউটাকে পেটাতে তৎপর হয়ে ওঠে। আমার অবস্থা অতোটা খারাপ না হলেও কাছাকাছি। খিদে পেলে আমারও মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সামান্য কারণেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি। সামনের গাড়ির চালক মধ্যপ্রাচ্যীয় কোনো বলদ উলাটাপাল্টা ড্রাইভ করলেই মেজাজ খারাপ করি–হালার্পো হালা সৌদিতে তো চড়তা উটের পিঠে। কানাডায় আইসা বিএমডাব্লু চালাও। রাস্তাটা কি তোমার বাপের! শালা খেজুর কোনহানকার…!

শার্লি হাসে–তোর খিদে পেয়েছে? গাড়ি সাইড কর। কিছু একটা খেয়ে নে…।

- Advertisement -

আমার স্ত্রী শার্লি গাড়িতে সবসময় কিছু চিপস্‌-চানাচুর-বিস্কুট-চকোলেট জাতীয় শুকনো খাবার মজুদ রাখে। সে মনের আনন্দে শপিং করতে আলোঝলোমল শপিং মলে ঢুকে যায় আর আমি পার্কিং লটে অপেক্ষা করি। যাবার সময় শার্লি সেই খাবারগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে যায়। আর তাতে আমার মাথা গরম হয়ে যাবার ফুরসত পায় না।

ইন্টারনেটে নানান জিনিস খুঁজতে আমি ব্রাউজ করি। বিশেষ করে খানাখাদ্যের ছবির দিকেই নজর থাকে বেশি। একেকটা খাবারের ছবি দেখি আর ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। একেকটা খাবারের সঙ্গে একেকটা স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। আর আমি আক্রান্ত হই স্মৃতিকাতরতায়।

সদ্য শৈশব পেরুনো তারুণ্যপ্লাবিত সময়টা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আহারে কী অনটনের ভেতর দিয়েই যেতে হয়েছে একটা সময়ে। পকেটে টাকা-পয়সা খুব একটা থাকতো না। কিন্তু লেখক হবার স্বপ্নের কাছে কতো অনায়াসেই না পরাজিত হতো সেই সংকটকালের ক্ষুধার্ত মুহূর্তগুলো! লেখক হবার দুনির্বার স্বপ্ন-আকাঙ্খায় কতো না ক্ষুধার্ত দুপুর কেটে গেছে নিষ্ঠুর সম্পাদকের টেবিলে টেবিলে, মায়াহীন, ভাতহীন। তখন, শুধুমাত্র কয়েকটা সিঙ্গারা আর কয়েক কাপ চায়ের নিচে চাপা পড়ে যেতো খিদে নামের ভয়ংকর দৈত্যটা। ভাতের চেয়ে প্রিয় তখন আগামীকালের পাতার মেকাপ, নিজের লেখার সর্বশেষ পরিণতি চাক্ষুষ করার অনির্বচনীয় আনন্দের ‘চানরাইত’। নিষ্ঠুরতার নাঙ্গা তলোয়ার উঁচিয়ে দৈনিক বাংলার সাত ভাই চম্পায় আফলাতুন ভাই, ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসরে দাদাভাই। সৈয়দ লুৎফুল হক, অলোকেশ ঘোষ কিংবা আইনুল হক মুন্নার মায়াময় লেটারিং। ট্রান্সপারেন্ট ট্রেসিং পেপারে কিংবা খসখসে কার্টিজ পেপারে নিজের নামের কালো পেলিক্যান ক্যালিগ্রাফির দুর্দান্ত শাদাকালো ম্যাজিক। ক্ষুধার্ত পেটে একশ একটা ঈঁদুরের ‘তান্ডব নৃত্যের’ সুর-লহরী। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সম্পাদকের অশেষ কৃপায় চায়ের সঙ্গে একপিস গর্মাগরম সিঙ্গারা। আহারে লেখক হবার স্বপ্ন! আহারে প্রিয় সিঙ্গারা! আচ্ছা সিঙ্গারা না সিঙ্গাড়া? কোনটা সঠিক? মনে হয় সিঙ্গারাটাই সঠিক। কিন্তু পুরান ঢাকায় আমরা এই পেটমোটা ত্রিকোনাকৃতির অসাধারণ খাবারটাকে সিঙ্গারাই বলতাম। আমার অরিজিনাল ঢাকাইয়া বন্ধুরা বলতো–ছিঙ্গারা।

রামকৃষ্ণ মিশন রোডের(হাটখোলা) ইত্তেফাক ভবনের উল্টোদিকের ফুটপাত লাগোয়া একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো ‘দেশবন্ধু’ নামে। ছোট্ট রেস্টুরেন্ট কিন্তু দুপুর হলেই হাউস ফুল অবস্থা, প্রতিদিন। দেশবন্ধু রেস্টুরেন্টে ঢুকতে ফুটপাত থেকে দুই স্টেপ নিচে নামতে হতো। এই রেস্টুরেন্টে আমার খুব প্রিয় ছিলো পরোটা আর সব্জিভাজির আইটেমটি। পুরো ঢাকা শহরে ‘দেশবন্ধু’র পরোটা বিশেষ করে সবজিভাজিটা ছিলো স্বাদে-গন্ধে আনপ্যারালাল। এই সব্জিভাজির আইটেমের ধারে কাছেও আসতে পারেনি তখন আর কোনো রেস্টুরেন্ট। সব্জিভাজিটা তৈরি হতো আলু-পটল-বেগুন এবং মিষ্টিকুমড়ার সমন্বয়ে, পাঁচফোড়নের অপরূপ দক্ষতায়। সঙ্গে থাকতো পর্যাপ্ত পরিমানে কালোজিরার উজ্জ্বল উদ্ভাস। তাতে যৎসামান্য চিনির কুদরতীও টের পাওয়া যেতো।

আর এদের পরোটারও একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো। সদ্য ভাজা উঁচু হয়ে থাকা একগুচ্ছ পরোটাকে কাঠের সার্ফেসে রেখে দু’হাত দিয়ে দু’দিক থেকে সজোরে একবার ঢিঁচো করে চাপ দিয়ে দু’দিকে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া পরোটাগুলোকে ইউ টার্নে ঘুরিয়ে নিয়ে চাপ না খাওয়া অংশে আরেকটা রাম ঢিঁচো করে চাপ দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ফেলা হতো। এই এবড়ো-খেবড়ো পরোটাগুলো একদিকে যেমন ক্রাঞ্চি ছিলো অন্যদিকে ছিলো নরম মোলায়েমও। এবং ডালডার একটা সুবাস মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়তো এই পড়োটা মুখে পোড়ার সঙ্গে সঙ্গেই।

দাদাভাইয়ের পাতায় লিখে যেদিন লেখক সম্মানির বিলটা পেতাম(খুবই সামান্য টাকা, পদ্যের জন্যে ২৫ আর গদ্যের জন্যে ৩০টাকা রেটে) সেদিন এই বিখ্যাত পরোটা ভাজির সঙ্গে জুটতো দুর্দান্ত রকমের টেস্টি একপিস রসগোল্লাও। আর বিলের পরিমাণটা কিঞ্চিৎ বেশি হলে কোনো কোনো দুপুরে খেতাম ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, সঙ্গে মুড়িঘন্ট। দেশবন্ধুর মুড়িঘন্টটাও ছিলো তখনকার ঢাকার একটি বিখ্যাত আইটেম।

কোনো কোনো দিন দৌঁড়ুতে হতো ইত্তেফাক-দৈনিক বাংলা ছাড়াও শিশু একাডেমি কিংবা বাংলা একাডেমিতে। সবকয়টা জায়গায় সঠিক সময়ে উপস্থিত থাকার প্রয়োজনে দুপুরে ঠিকমতো খাওয়াও হয়ে উঠতো না। পকেটের অবস্থাও কেরোসিন আবার খিদেটা চাগাড়ও দিচ্ছে অন্তহীন। কী আর করা। তখন মুশকিল আসান করতো রাস্তার ধারের টং-দোকানগুলো। এই টং-দোকানে গর্মাগরম চায়ের পাশাপাশি পাওয়া যেতো কিছু কমদামি ক্ষুধানিবারক খাদ্যবস্তু। ছোট্ট খুপড়ি মতোন দোকানের ছাউনি বরাবর ঝুলে থাকতো কিছু বনরুটি-পাউরুটি-বাটারবন এবং কিছু পাকা কলা। অর্থ সংকটকালে এই টং-দোকানগুলোর সস্তা দু’টি বনরুটি বা বাটারবনযোগে একটি পাকা কলা আর এক কাপ চায়ে কতোদিন যে দুপুরের আহার সম্পন্ন হয়েছে তার হিশেব নেই।

সস্তার কারণে গরিব রিকশাচলকদের খুব প্রিয় খাবার ছিলো ওগুলো। তাই প্রায়শঃ টং-দোকানের কলা কিংবা রুটি যেতো ফুরিয়ে।

তখন আমার ক্ষুধা নিবারণে একমাত্র ভরসা হয়ে উঠতো নাবিস্কোর মহাবিখ্যাত এক প্যাকেট ‘গ্লুকোজ’ বিস্কুট। গ্লুকোজ বিস্কুটের প্যাকেটে চকচকে পিংক কালারের ব্যাকগ্রাউন্ডে শাদা-হলুদ আর কালোর সমণ্বয়ে করা নকশায় কেনো যে আঙুরের ছবি থাকতো কে জানে!

টং-দোকানির জাদুকরী হাতে কন্ডেন্সডমিল্কের মিথস্ক্রিয়ায় নির্মিত ভুবনমোহিনী রঙের চায়ে ডুবিয়ে বা চুবিয়ে কমদামি এই গ্লুকোজ বিস্কটগুলো খেতে হতো ঝটপট, দ্রুত গতিতে। দ্রুত না খেলে বিস্কুটের মুচমুচে ক্রাঞ্চি ভাবটা নেতিয়ে যেতো। শুধু নেতিয়েই যেতো না, মুহূর্তেই বিস্কুটটা গলে মিশে যেতো বা নিমজ্জিত হতো কমদামি ট্রান্সপারেন্ট চিকন চাকন কাপের ভেতরে।

টাকায় না কুলালে গ্লুকোজ বিস্কুটের জায়গায় কিনে নিতাম শক্ত খটখটে কয়েকটা টোস্ট বিস্কুট। সেই টোস্ট বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে নরম করে খেয়ে নিয়ে খিদে নামের দৈত্যটাকে ম্যানেজ করে ফের ছুটতাম আরেকটা গন্তব্য অভিমুখে।

এখনকার তরুণ লেখকরা কি জানে–কী কষ্টকর দীর্ঘ অমসৃণ কন্টকাকীর্ণ ক্ষুধাজর্জর একটা পথ আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছে?

লেখক হওয়া অতো সহজ না রে পাগলা…

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles