9.1 C
Toronto
সোমবার, মে ৬, ২০২৪

তরুণীকে বিকৃত নির্যাতনের ভিডিও বিদেশে

তরুণীকে বিকৃত নির্যাতনের ভিডিও বিদেশে
জড়িত এক নারীসহ গ্রেপ্তার চারজনকে সোমবার আদালতে নেওয়া হয় সংগৃহীত

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তরুণীকে ২৫ দিন শিকলে বেঁধে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার নেপথ্যে মাসুদ নামে এক ব্যারিস্টার। তিনি কয়েক মাস ধরে লন্ডনে রয়েছেন। ২০১৭ সাল থেকে তরুণীর সঙ্গে ওই ব্যারিস্টারের ‘ঘনিষ্ঠতা’ ছিল। বাংলামটর, উত্তরাসহ কয়েকটি জায়গায় তরুণীকে বাসা ভাড়া করে রেখেছিলেন মাসুদ। মাস চারেক আগে লন্ডন যাওয়ার আগে তরুণীকে তাঁর পূর্বপরিচিত এক প্রবাসীর স্ত্রী সালমা ওরফে ঝুমুরের কাছে রেখে যান। সালমা এবং ওই তরুণীর বাসা ভাড়া, থাকা-খাওয়ার খরচ লন্ডন থেকে পাঠাতেন ওই ব্যারিস্টার।

এরই মধ্যে সান নামে এক যুবকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান তরুণী। এ তথ্য সালমা জানিয়ে দেয় ব্যারিস্টারকে। এর পর তাঁর পরিকল্পনায় বাসার ভেতরে দিনের পর দিন শিকলে আটকে রেখে পাশবিক যৌন নিপীড়নের ভিডিও তৈরি করা হতো। এই ভিডিও ব্যারিস্টারের কাছে পাঠাত সালমা। পাশবিক নির্যাতনের সময় বারবার কেঁদে আকুতি জানাতেন– ‘আমায় মাফ করেন প্লিজ, আমার কী অন্যায়? এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই।

- Advertisement -

আমাকে দয়া করে ছেড়ে দেন।’ এমন আকুতির পরও জড়িতরা উল্লাস করে বলে– ‘তোর শেষ দেখব। কথা না শুনলে দুনিয়াছাড়া করব।’

এ ঘটনায় সালমাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার অন্যরা হলো– তরুণীর কথিত বখাটে প্রেমিক সান (২৬) ও তার দুই বন্ধু রকি (২৯) এবং হিমেল (২৭)। সান এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। রকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। আর হিমেল বখাটে।

কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যায়, মেয়েটির হাত-পা শিকলে বাঁধা। ওড়না দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে মুখ। শিকলের পাশাপাশি গামছায় বাঁধা তাঁর হাত। কখনও স্কচটেপ দিয়ে মুখ ও চুল বেঁধে রাখা হতো। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় মুখের বাঁধন খোলা হয়। আবার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ঘরের মেঝেতে তরুণী হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন।

পুলিশ জানায়, রোববার রাতে অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল সোমবার রাজধানীর শ্যামলীতে নিজ কার্যালয়ে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, তরুণীর বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়েছে। এর পর মা-বাবা নতুন জীবন শুরু করেন আর ওই তরুণী ঢাকায় তাঁর বড় বোনের বাসায় থাকতেন। সেখান থেকে ভগ্নিপতির মাধ্যমে ব্যারিস্টার মাসুদের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। ব্যারিস্টার অধিকাংশ সময় বিদেশে থাকতেন। তিনি দেশে এলে তরুণীর সঙ্গে চলাফেরা করতেন। তরুণীর থাকার কোনো জায়গা না থাকায় এক পর্যায়ে সালমা নামে এক নারীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে সালমার সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করিয়ে দেন ব্যারিস্টার। এক পর্যায়ে নবীনগর এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে তাঁকে রাখেন। সেখানে সব খরচ বহন করতেন মাসুদ। এর পর ব্যারিস্টার মাসুদ বিদেশে যাওয়ার পর জানতে পারেন, সান নামে এক তরুণের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন মেয়েটি। এর পরই সালমার সঙ্গে পরামর্শ করে তরুণীকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করেন।

ডিসি আরও বলেন, মাসুদ তরুণীকে শায়েস্তা করতে তাঁর বর্তমান প্রেমিক সানকে হাত করেন। সালমাকে দিয়ে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে মাসুদের নির্দেশনা অনুসারে কাজ করতে প্ররোচিত করেন। তরুণীর রুমে বসানো হয় গোপন সিসি ক্যামেরা। বিভিন্ন সময় সান ও তার বন্ধু হিমেলের সঙ্গে ভুক্তভোগী তরুণীর শারীরিক সম্পর্কের দৃশ্য গোপনে ধারণ করে পাঠানো হতো মাসুদের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে তারা এভাবে ভিডিও পাঠান। এই ভিডিও দিয়ে ব্যবসা করতেন মাসুদ।

ডিসি আজিমুল হক বলেন, গোপনে ভিডিও করার বিষয়টি ভুক্তভোগী তরুণী জেনে যাওয়ায় তাঁর ওপর নেমে আসে নির্যাতন। শুরু হয় শিকলে বেঁধে নির্যাতন। হাত-পা ও মুখ বেঁধে পৈশাচিক নির্যাতন চালাতেন সান ও তার বন্ধুরা।

ডিসি আজিম বলেন, শনিবার রাত ৯টার দিকে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কলের পর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের একটি বাসা থেকে ভুক্তভোগী তরুণীকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় তরুণীকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়। তিনি ঘুমিয়ে পড়লে বাইরে চলে যায় সালমা, সান ও অন্যরা। কিছুক্ষণ পর ভুক্তভোগীর ঘুম ভেঙে গেলে বাসায় কেউ না থাকার সুযোগে চিৎকার দিয়ে আশপাশের বাসিন্দাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এক ব্যক্তি ৯৯৯-এ কল দিয়ে পুলিশকে জানান। স্থানীয়রা প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো ওই ফ্ল্যাটে কোনো গৃহকর্মীকে নির্যাতন করা হচ্ছিল। পুলিশ গিয়ে বহুতল ভবনের চার তলা থেকে তাঁকে শিকল বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করে। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

আজিমুল হক বলেন, ভুক্তভোগী তরুণীকে নির্যাতনের বেশির ভাগ ভিডিও ও ছবি সালমার মোবাইলে। কিন্তু সে মোবাইল ফোন লুকিয়ে ফেলেছে। ওই মোবাইল ফোন উদ্ধার করা গেলে পৈশাচিক নির্যাতনের আসল তথ্য ও ভিডিওর গন্তব্য সম্পর্কে জানা যাবে। এদিকে আদালতে তুলে চারজনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। পরে আদালত তাদের তিন দিন করে রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছেন।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ব্যারিস্টার মাসুদ দ্বৈত নাগরিক। তিনি দেশে এলে তরুণীকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা করতেন। সর্বশেষে তারা বছিলা ঢাকা উদ্যান এলাকায় নদীর পাড়ে বসতেন। সেখানে গান-বাজনা করত ধর্ষণ মামলার তিন আসামি সান, রকি ও হিমেল। সেখান থেকে তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। এর পর এক দিন ওই তরুণী তাদের বাসায় দাওয়াত দেন। এভাবে চলাফেরার এক পর্যায়ে সানের সঙ্গে ভুক্তভোগী তরুণী প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এর পর থেকে ওই বাসায় তিন তরুণের যাওয়া-আসা বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে তারা শারীরিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে। এসব ভিডিও করে মাসুদকে পাঠালে তিনি ক্ষিপ্ত হন।

পাঁচ বছর আগে মাসুদের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। এর পর থেকে ওই তরুণীকে রাজধানীর উত্তরা, কাঁটাসুর, ঢাকা উদ্যান ও নবীনগর এলাকায় বিভিন্ন বাসায় রাখতে শুরু করেন মাসুদ। এসব বাসা ব্যারিস্টার মাসুদের নামে ভাড়া নেওয়া হয়। তরুণীকে পাহারা দেওয়ার জন্য তিনি নিয়োগ দেন স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা সালমাকে। পুলিশ বলছে, মাসুদকে গ্রেপ্তার করা গেলে ঘটনার সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। তাঁকে খোঁজ করা হচ্ছে। তবে জানা গেছে, তিনি বর্তমানে দেশে নেই। পুলিশ বলছে, যুক্তরাজ্য থেকে তাঁকে দেশে ফেরাতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া হবে।

পুলিশের মোহাম্মদপুর বিভাগের এডিসি মৃত্যুঞ্জয় দে সজল বলেন, সালমার মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বরে ব্যারিস্টার গত তিন মাসে দেড় লাখ টাকার বেশি পাঠিয়েছেন। তাঁর অর্থে দু’জনের খরচ চলত। তরুণীকে ব্যবহার করে যে পর্নো ভিডিও করা হয়েছে, তা ব্যারিস্টার কোনো ডার্ক ওয়েবে বিক্রি করেছিলেন কিনা, তার তদন্ত চলছে।

নবীনগর হাউজিংয়ের ১১ তলা ভবনে ওই তরুণী ও সালমা থাকতেন বলে জানিয়েছেন সেখানকার নিরাপত্তাকর্মী আবু তালেব ও আব্দুল হক। গতকাল ওই বাসায় যাওয়ার পর দুই নিরাপত্তারক্ষী বলেন, নিয়মিত চার তলার ফ্ল্যাটে যাতায়াত ছিল তিন তরুণের। তারা খালাতো ও মামাতো ভাই পরিচয় দিয়ে যাওয়া-আসা করত। ওই ভবনে প্রবেশ করতে হলে মেহমানদের নাম-পরিচয় রেজিস্টার খাতায় লেখা হতো। তবে রেজিস্টারে এই তিন তরুণের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা বলেন, তারা গেটে এলেই নিচ থেকে সালমা এসে তাদের রিসিভ করে নিয়ে যেত। এ জন্য তাদের নাম-পরিচয় লেখা হতো না।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles