13.2 C
Toronto
শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪

লুকোচুরি খেলা প্রতিদিনের

লুকোচুরি খেলা প্রতিদিনের

অফিস থেকে ফিরে, ভাত খেয়ে, পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়লাম; সে পাশের রুম থেকে, কম্বল সরিয়ে মাথা বের করার আগেই। পা ধুয়ে নিয়ে এক ঝটিকায় বেড়িয়ে ঝেড়ে দৌড় লাগাই। দখিনা দরজার পাশেই ওঁৎ পেতে ছিল আমাকে ধরতে; তবুও তাকে ফাঁকি দিয়ে দ্রুত নিচে নামতে থাকি। সেও আমার পেছন পেছন হাত বাড়িয়ে তেড়ে ধরতে আসতে লাগলো..।

- Advertisement -

আমি নেমেই দ্রুত বাইরের ঘরের বিছানার লেপের তলায় ঢুকে লেপ টানটান করে এটে ধরে ঘুমানোর ভান করলাম। সে অনেক কষ্টে লেপে ঢুকবার জায়গা বের করে, ভেতরে ঢুকে হাঁপিয়ে বলল, আব্বু সরি বলো!
– কেন?
– আমি তোমার জন্য ওয়েট করি, হাগ দেবার জন্য; আর তুমি খালি পালাও! এতো দুষ্টুমি করো কেন?
– ওকে, সরি
– আর?
– আর, আই লাভ ইউ!
– ভালো করে বলো!
আমি আরও ভালো করে বলার চেষ্টা করতে থাকি..

আমাদের বাপ-বেটির বিকালের এই লুকোচুরি খেলা প্রতিদিনের। আজ আমাকে ধরতে পারলো না, কারন সে খুব দুর্বল; জ্বরে ভুগছে।

মেয়েটা কম্বলের মধ্যে তার এক ঠ্যাং আমার গায়ের উপর তুলে, জড়িয়ে ধরে বলল- আব্বু কেমন ছিলা সারাদিন?
– ভালো মা
– ভালো ছিলা!
– হু?

– আমাকে ছাড়া তুমি কীভাবে ভালো থাকো?
– তুই আমার কাছে থাকলে কি ভালো হতো? আমি কাজ করতাম, তোর দিকে নজর দিতাম না, তোর মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। তখন তুই পাগল হয়ে যাইতি।
.
গিন্নি চায়ের কাপটা পাশে রাখতেই আমি টেবিল থেকে আন্তন চেখভের গল্পের বইটা তুলে নিয়ে র‍্যান্ডমলী একটা গল্প বেছে নিয়ে পড়া শুরু করি।
আব্বু কী পড়ো? [সে বাংলা পড়তে জানে না]
– গল্প
– কী ধরনের গল্প?
– রোমান্টিক
– তুমি রোমান্টিক বই পড়ো!
সে বিশ্ময়ে হা হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল, কী লিখা আছে বলবা?
– না। তুই যে এতো এতো বই পড়িস, আমি জানতে চাইলে তখন বলিস? তোর বইগুলা ধরতেও দিস না!
– একটা গল্পন শুনাবা?
– আমার গল্প যে ট্রাজেডীর?
– কষ্টের?
– হু, খু-উ-উ -উ-ব..
– তাহলে থাক
– আহা, শোনই না! সে অনেক অনেক দিন আগের কথা..
– কবেকার গল্প?

– তোদের ইংলিশে ফেইরিটেল গল্প শুরু হওয়ার আগে যে বলিস- “ওয়ান্স আপন এ টাইম”‘; সেইরকম একটা আরম্ভ। এর মানে কোনো এক সময়ের গল্প, কিন্তু আমরা জানি না ঠিক কখন। এক দেশে ছিল একটা ছোট মেয়ে, নাম ময়না। বারো বছর বয়স
– আমাকে নিয়ে গল্প?
– না, তোর মতো একটা মেয়ের। সে তার মায়ের সাথে একটা বস্তিতে থাকতো
– বস্তি কী আব্বু?
– শ্যানটি। কোনরকমে পলিথিন, ভাঙা কাঠ দিয়ে সস্তায় বানানো শেল্টার। তাঁবুর মতো। তারা ছিল খুব গরিব। ময়নার মা ইট ভাঙতো
– ইট কী?
– ইট হলো ব্রিকস, একটা হ্যামার দিয়ে সারাদিন বসে বসে ইট ভাঙতো। ইটের টুকরা দিয়ে কংক্রিট বানায়। আর প্রতিদিন তিনশো টাকা আর্ন করতো। সেই টাকা দিয়ে ভাত আর আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেতো
– তিনশো টাকা মানে কত ডলার?
– এই ধর ফোর ক্যানাডিয়ান ডলার
– সারাদিন কাজ করে মাত্র ফোর ডলার?
– হু, তুই একটা ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা কফি খাস তিন ডলার দিয়ে। তাহলে বোঝ, মানুষ কত কষ্টে থাকে! আর তোরা কত ভালো আছিস..
– আব্বা, অন্য গল্প বলো.. পরশুদিন ভ্যালেন্টাইন্স ডে।একটা সফট গল্প শোনাও?
– আগে শেষ করতে দে?

একদিন ময়নার মায়ের খুব অসুখ হলো; জ্বর আর কাশি। শীতের দিন, ভাঙা ঘরের ছেঁড়া পলিথিন দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে। গায়ে দেবার কম্বল ছিল না। কাজে যেতে পারেনি, তাই টাকা আর্ন করতে পারে নাই। এখন কী খাবে? ওষুধ কিনবে কীভাবে? সারাদিন তারা না খেয়েই থাকলো। পরের দিন সকালে উঠে ময়না ভাবলো কিছু একটা করতে হবে। তা না হলে মাকে বাঁচানো যাবে না। জ্বর আর খিদেতে খুব কাহিল অবস্থা
– আব্বু, থাক। দুঃখ নাই এরকম গল্প পারো না?
– শোন-ই না! সে পাশের মার্কেটে গেলো একটা ফুলের দোকানে। সেখানে এক পরিচিত আঙ্কেল ফুল বেচে। বলল- আংকেল, আমাকে কিছু ফুল ধার দিবেন? বিকালে টাকা দিয়ে দিবো?
– ফুল দিয়ে কি করবি?
– আমার মা কাজে যেতে পারেনি, খুব অসুখ। ফুল বেচে ওষুধ আর খাবার কিনবো
– আচ্ছা নিয়ে যা।

সেই আংকেল ছিল অনেক কাইন্ড। তাকে কিছু গোলাপ [রোজ] আর কিছু গাঁদা [মারিগোল্ড] ফুল দিলো। সে ওগুলা বাসায় নিয়ে সুন্দর করে মালা বানিয়ে মেইন রোডের ইন্টারসেকশনে গিয়ে রেড লাইটে দাঁড়ানো গড়িতে বসা মানুষগুলোর কাছে বিক্রি করতে লাগলো। কেউ কিনলো, কেউ কিনলো না
– তারপর?
– তবে বিকালের মধ্যে সে সব বিক্রি করে ফেলল! ফুলওআলাকে পাঁচশো টাকা [ছয় ডলার] ফেরত দিয়েও তার হাতে পাঁচশো টাকা প্রফিট থাকলো!
– তারপর!

– তারপর সে মায়ের জন্য টাইলেনল [এদেশের জ্বরের ওষুধ], কিছু চাল, ডিম আর আলু কিনে নিয়ে বাসায় গিয়ে মা কে ওষুধ খাওয়ালো, ভাত রান্না করে ডিম ভেজে একসাথে খেতে বসলো। তার মা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠলো!
– এই গল্প তুমি এখন বানালা?
– হু। তোর কাছে গল্প মনে হলেও এরকম এগজাম্পল অনেক আছে বাংলাদেশে। তুই কি জানিস ইট ভাঙা কত কঠিন কাজ? হাতুড়ি স্লিপ কেটে আঙুলে লাগলে অনেক সময় আঙ্গুল ভেঙে যায়, ব্লিডিং হয়, ঘাঁ হয়। তবুও অনেকে এরকম ইট ভেঙে টাকা আয় করে। অনেক মহিলা শাড়ির মধ্যে বাচ্চা বেধে নিয়েও এভাবে ইট ভাঙে। আবার ভাবিস না বাংলাদেশের সবাই এরকম। অনেক রিচ, অনেক মিডিল ক্লাস মানুষও আছে; মিক্সড
– আব্বু আর বলবা না, এখানেই স্টপ করো প্লিজ?
– আর একটু বাকি.. তারপর ময়নার অনেক প্রফিট হতে লাগলো। সে ছয় মাসের মধ্যে তার মায়ের সাথে একটা ফুলের দোকান দিলো। তাদের অভাব অনেক কমে আসলো। এখন তারা তিন বেলা খেতে পারে
– ওরা কি মিলিওনিয়ার হয়ে গেলো?
– ধুর বোকা.. তবে কোনরকমে দিন যায়। একটা ছোট্ট ঘর বানালো কাঠ আর টিন দিয়ে
– এখন ভালো লাগতেসে আব্বু
– দুঃখের কথা ভালো লাগে না?
– না
– তাহলে বিশ্ব চিনবি কীভাবে? তারপর একদিন কী হলো জানিস!!
– কী!
– ওদের দরজায় এক দুষ্টু লোক নক করলো!
– আব্বু স্টপ! আই বেগ ইউ! তুমি কি আজকেও আমাকে কান্দাবা?

– লোকটা কে জানিস? ময়নার বাবা! ব্যাটা আরেকজন মহিলাকে বিয়ে করে আরেক ফ্যামিলি নিয়ে থাকতো। কিন্তু ময়না আর তার মা কে কোনো হেল্প করতো না, খোঁজও নিতো না; এতই ফাজিল!
– আর না আব্বু.. তুমি না থামলে আমি আর কখনো তোমার গল্প শুনবো না!
– প্রায় শেষ.. লোকটা ময়নার কাছে টাকা চাইলো বারবার। ড্রিংক করে এসেছিল। ময়না টাকা দেয়নি বলে তাকে এমন পিটুনি দিলো.. তার চুলও ছিল ঠিক তোর মতো লম্বা!
– এনাফ আব্বু স্টপ! – বলে সে এবার তার দুই তাতে দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলো। আমি স্টপ করে ফেললাম।
.
দখিনা ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো আমাকে জড়িয়ে ধরে।
মেয়েটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে!

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles