22.1 C
Toronto
রবিবার, মে ১৯, ২০২৪

টরন্টোর বন্ধুর বাসায়

টরন্টোর বন্ধুর বাসায়

ইসরায়েলের ওপর খুব রাগ লাগতে লাগলো। তোরা পালক ছাড়া দিগম্বর মুরগি বানাতে পারিস, আর খোসা ছাড়া আলু বানাতে পারলি না?

- Advertisement -

আমার বন্ধুর বাসায় আজ টরন্টো শহরের সব নামি দামি ক্লায়েন্টস আর লইয়ারস-রিয়েল্টর-ব্যারিষ্টাররা আসবে। হুলুস্থুল দাওয়াত। আমি কাল দুপুরে অটোয়া থেকে এসে তার সাথে কাজ করে যাচ্ছি। হ্যামিল্টন এ গিয়ে গাড়ি ভর্তি করে সীফুড বাজার করে এনেছি। এখন বসেছি আলু ছিলতে। এ কাজ যে কত কঠিন, সেটা নজরুল ইসলামের ছেলেবেলার গল্পের মতো হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। রান্নার সময় গিন্নিকে হেল্প করি আলু ছিলতে, কিন্তু সেটা মাত্র দু-তিনটা। আজ বসেছি সাড়ে চার কেজির বস্তা নিয়ে। এক কেজি ছিলতেই পিঠ ব্যাথা হয়ে কুঁজো হয়ে, আঙ্গুল অবশ হয়ে গেল। পায়খানা করার নাম করে বাথরুমে ঢুকে কমোডের ঢাকনা ফেলে ওটার ওপর মিনিট দশেক বসে রেস্ট নিয়ে বের হয়ে আবার কিচেনে ফিরলাম। আমার ধারণা সে আমাকে ইচ্ছা করেই খারাপ পিলার দিয়েছে।

ওদিকে আমার বন্ধু খুব যত্নসহকারে স্যামন মাছ সাইজ করে নিয়ে, গুনে গুনে পঞ্চাশ পিস চারটা ট্রে’র ওপর সাজিয়ে বলল- এক ঘন্টায় এক কেজিও ছিলতে পারিসনি! সে গামলা থেকে একটা আলু তুলে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকিতে বলল- এটাকে আলু ছিলা বলে? কাজ করলে ভালমতো কর, নাইলে বাদ দে?
– কী হইছে?
– তোর নানি-দাদি ক্যামনে রান্না করতো; নিখুঁতভাবে, না যা-তা ভাবে?
– নিখুঁত
– তাইলে? এমনভাবে কাজ করবি, যেন ঠিক তোর নানির মতো হয়; এক বিন্দু খোসা আর কালো চোখ যেন না থাকে। তুই ছিলছিস নানার মতো; নানিদের বোকা পেয়ে যা-তা কাজ গছিয়ে দিয়ে বলত- ‘হইছে’।

মনে মনে গালি দিলাম- ব্যাটা তুই ছোটকালে বসে বসে নানীর আলু ছিলা দেখতি? গুলবাজ! আলু কিনতেও জানিস না; এবড়ো-খেবড়ো এইগুলা কী কিনছিস?
.
আমি চাকু হাতে প্রতিটা আলুর কালো চোখ আর চামড়া তুলে ফেলতে লাগলাম। অর্ধেক ব্যাগ ছেলা হয়ে গেলে সে বলল, থাক আর লাগবে না। নতুন বৌয়ের মতো ঘোমটা দিয়ে কাম করলে আর দাওয়াত খাওয়ানো লাগবে না। এবার সে নিজে হাত লাগিয়ে বলল, একটা আলুতে ঠিক দশ সেকেন্ড সময় নিবি। এভাবে কাটবি- প্রথমে আলুর দুই মাথা মোটা করে ছিলার পর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু ছিলতে থাকবি ফটাফট। ব্যাস!- বলে সত্যি দশ সেকেন্ডের মধ্যে আলু ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে ছিলে গামলার পানিতে চুবাতে লাগলো।
.
আমাকে বসালো সালাদ কাটতে। ডেন্ডেলিওন, লাল গোল মুলা, লাল বিট, লেটুশ, শসা, ইতালিয়ান টমেটো কাটতে থাকি তার দেখিয়ে দেওয়া সাইযের মত। পাশে রাখা এক গামলা গোট চিজ (ছাগলের চিজ) আর পারমাজান চিজ রাখা। আমার ধারনা সে আগে কুক ছিল রেস্টুরেন্টের। যদিও স্বীকার করে না।
.
.
আলু সেদ্ধ করতে দিয়ে একটা বড় বাটিতে মাখন আর ঘন ক্রিম ঢেলে রাখলাম। পূর্বে ভেজে রাখা স্যামন ফিলেগুলো ৩৮০ ডিগ্রি F এ বারো মিনিট করে বেক করে নামাতে থাকি। গোলাপি আভাযুক্ত, রসালো, রুপালি মুচমুচে চামড়া আর মাখনে চুবানো চর্বিযুক্ত স্যামনগুলো হয়েছে দেখার মতো! ঠিক যেন ঘন গোলাপি কাস্টার্ড। গোলাপের মতো সুবাস ছড়াচ্ছে। কাঁটা চামচ দিয়ে ভেঙে নিয়ে ম্যাশড পটেটো আর অলিভ অয়েল মাখানো গোট চিজের সালাদ দিয়ে মুখে ভরতে কেমন লাগবে ভাবতেই মুখের মধ্যে তেঁতুলের মত এক গাদা লালা গিলে ফেললাম।
আজ একটা খানা হবে!
.
রিপন, শিখে রাখ কীভাবে আমি ম্যাশড পটেটো বানাই। পানি ফুটে উঠলে আঁচ কমিয়ে ফেলবি, যেন আলুগুলো বেশি নড়াচড়া না করে। এভাবে ফুটিয়ে বিশ মিনিট পর থেকে চিকন চাকু ঢুকিয়ে দেখবি সেটা আলগোসে ঢুকে গেলে চুলা বন্ধ করে পানি ফেলে দিয়ে আলুগুলো প্যানে নিয়ে বন্ধ চুলার ওপর রাখবি, যাতে গরমে অতিরিক্ত পানি মরে যায়। এবার ভর্তা করে, লবন দিয়ে চেখে দেখবি ঠিক আছে কিনা। গরম থাকতেই মাখন আর ক্রিমের মিশ্রণ ঢেলে মাখিয়ে নিবি। আর কিচ্ছু দিতে হবে না। দেখবি সুপার ফ্লফি ম্যাশড পটেটো তৈরী!
.
আমি স্বপ্নে ডুবে গেলাম; চোখের সামনে যেন প্লেটে সাজানো বিরাট সাইজের ভাজা স্যামন ফিলে, গোট চিজ সালাদ আর ম্যাশড পটেটোর ওপর গ্রিন ওনিয়ন ছিটানো। এটা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম খাবার। আর ওই লবস্টার খাওয়াও আমার খুব শখ।

এই ত্যালতেলে স্যামন চল্লিশ ডলার করে কেজি। অথচ বাজারে বিশ-পচিশ ডলার করেও পাওয়া যায়। সে যা খরচ করতেছে, এরচাইতে রেস্টুরেন্টে অর্ধেক পয়সায় খাওয়ানো যেত। এক কেজি করে দশটা বিশাল সাইজের লবস্টারও কেনা হয়েছে। প্রতি পিস একশো ডলার। সে ওগুলোতে আমাকে হাত ছোঁয়াতেই দিলো না। বিশাল গামলায় তাজা অবস্থায় ঢুকিয়ে সেগুলো সেদ্ধ করে ফেলল। কাটার জন্য দামি রেস্টুরেন্ট থেকে একজন লোক আসবে, সাথে দুজন খাবার সার্ভার। পঞ্চাশজনের জন্য দশটা লবস্টার যথেষ্ট।

তার আলিশান বাড়ির বেইজমেন্টও বিশাল। অন্তত একশজন মানুষের পার্টি করার মতো এরিয়া। আর সাজানোও সেভাবে। রুপার শোপিস, ইরানি দামি কার্পেট আর মরক্কোর সোফা আর ক্রিস্টালের ঝাড়বাতিগুলো দেখার মতো। ডাইনিং টেবিলে বসে ভ্লাদিমির পুতিন আর কিম জং উন অনায়াসে দিপাক্ষিক বৈঠক করতে পারবে।
.
এসব জায়গায় আমার মতো গরিব পোষাকের মানুষ মানায় না।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

লবস্টার কাটার আর সার্ভ করার দুজন পরিপাটি লোক চলে আসতেই সে আমাকে অন্য ঘরে নিয়ে বলল- রিপন রে, বিপদে পড়লাম
– কী?
– আমার অশোয়া’র বাড়িতে ঝামেলা চলতেছে
– বলিস কি!
– স্টুডেন্টস’দের বের করে দিয়েছি আমার লোক আর পুলিশ দিয়ে। তবুও ওরা রাস্তায় দাঁড়ায়ে আছে পোটলা-পুঁটলি নিয়ে। শালারা সাত মাস ভাড়া দিচ্ছে না। তার ওপর দুইটা মেয়ে মানুষও থাকতো ওদের সাথে। আমাকে জানায়নি!
– বলিস কি! সিন ক্রিয়েট করে যদি?
– তা করবে না। তাদের কয়েকবার নোটিস দিয়ে সাক্ষর নিয়ে রাখছি। কাঁচা কাজ করার লোক আমি না। মিডিয়া ডাকলে ওরাই বিপদে পড়বে। টরন্টোতে অনেক স্টুডেন্ট অবশ্য এভাবেই থাকে। কিন্তু আমি একই রুমে মেয়েছেলে এলাও করি না। ভাড়া না দিলেও এই চিশতীর কিছু না। এদের খাসলতই খারাপ, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার প্ল্যান করতেছে। এই চিশতী সারা বছর পঞ্চাশজন স্টুডেন্টকে বিনা পয়সায় থাকা-খাওয়ার হিম্মৎ রাখে! অথচ লোকজন ভাববে আমি কত নিষ্ঠুর, ঠান্ডার মধ্যে বের করে দিচ্ছি..
– পুলিশ দিয়ে উঠায়ে দিলি!
– তুই একটু যা। তুই গেলে পুলিশ আর লোক দুজন চলে যাবে। স্টুডেন্টস’দের কোনো কথা শুনবি না। তুই তো আবার অল্পতেই পটে যাস। বেইজমেন্ট খুলে ভালমতো চেক করে দেখবি তাদের একটা টুথ ব্রাশও যেন না থাকে। সব ব্যাগে ভরে বাইরে মাঠে ফেলে ওদের বলবি কেটে পড়তে
– পুলিশ এখনো আছে?
– আচ্ছা, তুই এতো পুলিশ ভয় পাস ক্যা?
– দোস্ত, আ-আ-মি একা সামলাবো?…

তার অশোয়া’র বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি বাসার পাশে আটজন ছেলে মেয়ে দাঁড়ানো। সাথে তাদের জিনিসপত্র, ব্যাগ আর বইপত্র স্তুপ করে রাখা। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বাইরে চেয়ারে বসা। মেয়েদুটোর মধ্যে একজন কাঁদছে।

বেইজমেন্ট থেকে তাদের বাকি জিনিসপত্র বস্তায় করে বের করে দিতে আমার বিকাল চারটা বেজে গেলো। নতুন তালা লাগানোর জন্য মিস্ত্রি ছ’টার আগে আসতে পারবে না। বন্ধুর কড়া হুকুম, তালা চেঞ্জ না করে ওখান থেকে যেন এক পা’ও না সরি। সরলেই নাকি তাদের কাছে লুকানো ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে সুড়সুড় করে ঢুকে যাবে।
.
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ঠান্ডায় সবাই জবুথবু। আমি কঠোর ভাব নিয়ে গাড়িতে বসা। এদের মধ্যে দুজন শিখ, মাথায় বিশাল পাগড়ি বাধা। অপুর্ব সুন্দরী মেয়েটা আমার কাছে এসে হাত জোড় করে বলল- আপনি আমার ভাই। আর একটা সপ্তাহ সময় দিন প্লিজ? হোটেলে থাকার মতো টাকাও নাই
– আপনাদের আত্মীয় নাই?
– আছে দুজনের। আমরা দুজন বাকিদের ফেলে যাবো না।
.
আমি তোয়াক্কা না করে কঠিনভাবে চেয়ে আবার গাড়ির কাঁচ উঠিয়ে দিলাম। ওরা আমাকে চেনে না, এই রিপন প্রয়োজনে কত কঠিন হতে পারে! টেইলর সুইফট এসেও আমাকে পটাতে পারবে না। বাইরের আবহাওয়া এখন মাইনাস চার। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে মাইনাস দশ-এ পৌঁছুবে। বুঝুক শীত কি জিনিস! বিনা ভাড়ায় ফুর্তি বের হবে!
.
.
তালার মিস্ত্রি কাজ করে চলে গেলো রাত সাতটায়। আমি খিদায় পাগল। কিচ্ছু খাইনি। হোটেলেও যেতে পারিনি। পাশের রেস্তোরাঁ থেকে মাফিন আর কফি নিয়ে বাসায় ফিরবার সময় আবছা আলোয় দেখি তারা টিম হর্টন্স থেকে আনা মাফিন হাতে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। ঠিক তখন চিশতীর ফোন। আমি আবার গাড়ি থামালাম বাসার সামনে।
রিপন, লক চেঞ্জ হইছে?
– হু
– গুড! ওরা এখনো আছে?
– হু
– ঠান্ডা নামলে সুড়সুড় করে গর্তে ঢুকবে! বাস স্টেশন, রেল স্টেশন থাকতে এখানে দাঁড়ায়ে থাকার মতলব কী? তুই চলে আয়। আসার পথে আমার ক্রেডিট কার্ড থেকে গরীবে নেওয়াজের দুই প্যাকেট বিরিয়ানি আনিস। তোর জন্য দুপুরের কিচ্ছু রাখতে পারিনি রে..
– ব্যাপার না
– পঁয়তাল্লিশ জন আসার কথা, আসছে পঞ্চান্ন জন। আরেকটু হলেই বেইজ্জতি ঘটতো..
– কোনো সমস্যা না দোস্ত
– তুই খেয়ে ঘুমায়ে পরিস। রাতে আরেক জায়গায় মিটিং আছে; নাও ফিরতে পারি
– সকালে কিন্তু আমি অটোয়া ফিরবো
– আচ্ছা।
.
ফোনটা রেখে হঠাৎ কি মনে করে তাদের দিকে ফিরে তাকাই। গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে বিনা শর্তে বেইজমেন্টের দরজা খুলে মেলে ধরে তাদের দিকে ইশারা করি ঢোকার জন্য। তারা বিস্ময়ে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে..
এরচেয়ে সহজ সমাধান আর নাই।
.
রাত ন’টায় তার টরন্টোর বাসায় ফিরি। চারদিকে ধবধবে সাদা হয়ে গেল পনেরো মিনিটের মধ্যে। সারা টরন্টো শহর ভেসে যাচ্ছে ঝিকমিক করা অপূর্ব তুলার মতো তুষারে। মানুষের কত শত দু:খ আছে, কত ঝামেলায় থাকে। আর আমরা সেগুলোতে নাক গলিয়ে বোকার মত বিপদ ডেকে আনি।
.
তাছাড়া কাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঝেড়ে দৌঁড় লাগাবো অটোয়ার দিকে। চিশতী আমার টিকিটির নাগালও পাবে না। পরের কথা পরে।
আমি একটা শয়তানি হাসি দিয়ে ঘুমাতে গেলাম।
জীবনটা মাঝে মধ্যে খুব উপভোগ্য মনে হয়।

অটোয়া, কানাডা

 

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles