নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার অবলোকনের মধ্য দিয়ে শেষ হতে যাচ্ছে ২০২৩ সাল। বছরজুড়ে ঘটেছে বড় রাজনৈতিক ঘটনা, যা বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নতুন রূপ দিয়েছে। এছাড়া বিদায়ী বছরে চলমান যুদ্ধগুলো বেগবান হয়েছে, নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প থেকে শুরু করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার মতো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরেও নানা ঘটনা ঘটেছে বিদায়ী এই বছরে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু সেরা ঘটনা তুলে ধরা হলো।
ভূমিকম্পের ঘনঘটা
ভূমিকম্প পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যুগে যুগে এ দুর্যোগের ভয়াল থাবার শিকার হয়েছে অসংখ্য দেশ। ধ্বংস হয়ে গেছে বড় বড় ভবন-স্থাপনা। ধুলোয় মিশে গেছে হাজার হাজার মানুষের সহায়-সম্বল। অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে গোটা নগরী। ইট-পাথর-বালির নিচে পিষ্ট হয়ে মারা গেছে অগণিত মানুষ। চলতি বছর অনেকগুলো ব্যাপক মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এতে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। প্রথমেই আসে তুরস্কে ৬ ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া ৭.৮ মাত্রার প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের কথা। এতে ৫০ হাজারের ওপর মানুষ প্রাণ হারায়। তুরস্কের বিশাল এলাকা জুড়ে ভূকম্পন টের পাওয়া যায়। কয়েক মাস পর্যন্ত এর আফটার শক অনুভূত হয়।
তুরস্ক ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশে আঘাত হানে ভূমিকম্প। ৮ সেপ্টেম্বর মরক্কোর আল হুজে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে মারা যায় প্রায় ৩ হাজার মানুষ। আফগানিস্তানের হেরাতে ৭ অক্টোবর ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে মারা যায় দেড় হাজার মানুষ। এছাড়া চীন ও ফিলিপাইন ছাড়াও এশিয়ার কয়েকটি দেশে বিভিন্ন মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, যাতে প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে।
জনসংখ্যার দিক দিয়ে চীনকে ভারতের ছাড়িয়ে যাওয়া
গত এক শতাব্দী ধরে সবচেয়ে বেশি মানুষের দেশ হিসেবে রেকর্ড ছিলো চীনের হাতে, যা ভঙ্গ হয়েছে ২০২৩ সালে। চীনকে ছাপিয়ে ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। প্রায় ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন মানুষের বসবাস এখন ভারতে, এবং চীনের নাগরিকেরা যেখানে বুড়িয়ে যাচ্ছেন সেখানে ভারতের জনসংখ্যা আগামী কয়েক দশক ধরে কেবলই বাড়তে থাকবে। এই শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ চীনের জনসংখ্যা কমে যাবে প্রায় ১০০ মিলিয়ন এবং চীনা নাগরিকদের গড় বয়স হবে ৩৯ বছর থেকে ৫১ বছর। এর বিপরীতে এই শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ ভারতের জনসংখ্যা হবে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন এবং এই বিপুল পরিমাণ ভারতীয় নাগরিকদের গড় বয়স হবে ৩৯ বছর।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্ব
বছরের শুরু থেকে মনে হচ্ছিল চীন-মার্কিন সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথেই এগোবে। বেলুন নিয়ে বছরের গোড়ার দিকে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হলেও এ নিয়ে উত্তেজনা আর বাড়েনি। তবে তাইওয়ান ইস্যুতে দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক যথেষ্ট উষ্ণ হতে পারেনি। তাইওয়ান ও ফিলিপাইনকে হয়রানির অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর কিছু বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি ব্লিনকেন জুনে চীন সফর করেন। আসছে ফেব্রুয়ারিতে তিনি আবার দেশটিতে যাবেন। ১৫ নভেম্বর সানফ্রান্সিসকোতে বাইডেন ও শি জিনপিংয়ের মধ্যে বৈঠক হয়। তবে বাণিজ্য ইস্যুতে বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে বরফ গলেনি বলেই জানা গেছে।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ
ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত গাজা ভূখণ্ড ইসরায়েলের বোমা হামলায় ক্ষতবিক্ষত ও রক্তস্নাত হয়েছে এ বছর। ৭ অক্টোবর গাজা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাস ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সহস্রাধিক লোককে হত্যা ও শতাধিক ব্যক্তিকে বন্দি করে নিয়ে যায়। এরপর আন্তর্জাতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচারে বেসামরিক অবস্থানের ওপর হামলা শুরু করে। সেখানে পানি, বিদ্যুত্, গ্যাস ও টেলিযোগাযোগ বন্ধ। ইসরায়েল বলেছে, বন্দিদের ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত এগুলো চালু করা হবে না। গাজা পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরীতে।
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ৫০ বছরে এত ব্যাপক লড়াই আর হয়নি। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যে রাজনৈতিক চাপের মধ্যে ছিলেন সেটা কেটে যায়। আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে গাজায় বিমান ও স্থল হামলা অব্যাহত রাখেন বছরের প্রায় শেষ পর্যন্ত। কাতারের মধ্যস্থতায় মাঝে এক সপ্তাহের মতো অস্ত্রবিরতি হলেও সেটা স্থায়ী হয়নি।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের ফলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের গুরুত্ব অনেকটাই চাপা পরে গেছে। তবুও, এই যুদ্ধের ফলে ইউরোপের নিরাপত্তা এখনও হুমকির মুখে রয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় দুই বছর হতে চললেও যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধে ইউক্রেন প্রথম দিকে সুবিধা করতে পারলেও বিগত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকানদের আটকে দেয়া ৬১ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ ইউক্রেনকে বেশ অসুবিধায় ফেলেছে। এই মুহূর্তে দেশটি যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য নতুন যোদ্ধার সন্ধানে রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অবনতি
২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিঘ্নিত হয়েছে। আফ্রিকায় একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে, থাইল্যান্ডে একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল ক্ষমতায় এলেও দেশটির সামরিক বাহিনী তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। ভারত সরকার বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন ব্যবহার করে সমালোচকদের বাকরুদ্ধ করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সমালোচকদের ‘জীবানু’ আখ্যা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক পরিবেশ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পুনর্নির্বাচিত এরদোগান
তুরস্কে ৬ ফেব্রুয়ারি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প সত্ত্বেও সময় মতোই নির্বাচন হয়। ভূমিকম্পের ঠিক তিন মাসের মাথায় নির্বাচন সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। পশ্চিমা গণমাধ্যম সর্বশক্তি দিয়ে বিরোধীদের সহায়তা করে। তারা দেখানোর চেষ্টা করেছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঠ উভয় পক্ষের জন্য সমান নয়। তবে মে মাসের নির্বাচনে নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও এরদোগান পুনর্নির্বাচিত হন। ২৮ মে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে তিনি ৫০ শতাংশের ওপর ভোট পান। বিরোধীরা জোট বেঁধেও তার এই জয় ঠেকিয়ে দিতে পারেনি।
প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিকদারোগ্লু নিজেকে যেভাবে পশ্চিমাপন্থি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন সেটি ভোটের মাঠে তার বিপক্ষে য়ায়। কারণ সাধারণ ভোটারদের অনেকে চায়নি তুরস্ক কোনো একটি পক্ষে ঢুকে পড়ুক। দেশটি দীর্ঘ সময় পশ্চিমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। এরদোয়ান সেখান থেকে তার দেশকে বের করে এনে একটি নতুন পরিচয়ে দাঁড় করিয়েছেন। নতুন সরকার গঠনের সময় তিনি যেভাবে মন্ত্রিসভা ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূরণ করেন সেখানেও অনেক চমক ছিল বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
ইমরান খানের গ্রেফতার এবং নওয়াজ শরীফের ফেরা
ইমরান খানের জন্য ২০২২-২০২৩ ছিলো খুবই ঘটনাবহুল একটি বছর। ২০২২ সালের এপ্রিলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তোশাখানা মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ইমরান খানের অপসারণের পর তার প্রতিদ্বন্দ্বী নওয়াজ শরীফের ভাই শেহবাজ শরীফের ক্ষমতায় আরোহন এবং দীর্ঘদিন নির্বাসনে কাটানোর পর নওয়াজ শরীফের দেশে ফিরে এসে মুসলিম লীগের হাল ধরা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ন একটি ঘটনা ছিল।
ভারতে জি-২০ সম্মেলন
সেপ্টেম্বর ৯-১০ তারিখে ভারত ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশসমূহের জোট জি-২০ এর সম্মেলন আয়োজন করে। সম্মেলনে মোট ৪৩ জন রাষ্ট্রপ্রধান অংশ নিয়েছিলেন। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই সম্মেলনে যোগ দেননি। এই সম্মেলনটি আয়োজন করে ভারত বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের গুরুত্বকে অনেকগুণ বৃদ্ধি করেছে বলে ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
আফ্রিকায় সামরিক অভ্যুত্থান
মধ্য ও সাব-সাহারান পাঁচটি দেশে এ বছর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। দেশগুলো হলো নাইজার, সিয়েরা লিয়ন, গ্যাবন, বুরকিনা ফাসো ও গিনি বিসাও। এছাড়া সুদানে নতুন করে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সবকিছু মিলে মহাদেশটিতে গণতন্ত্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রুশ মিলিশিয়া বাহিনী ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর জানা গেছে, সাব-সাহারান দেশগুলোতে তারা কতটা প্রভাবশালী ছিল। লক্ষণীয় যে, সামরিক অভ্যুত্থানগুলোকে সাধারণ মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। কারণ সাবেক ফরাসি ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে নির্বাচিত নেতাদের বেশির ভাগ জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে সাবেক ঔপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থ প্রাধান্য দিতেন।
আজারবাইজানের নাগর্নো কারাবাখ দখল
সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের তিন দশক পরও এর আফটার শক মিলিয়ে যায়নি। আর্মেনীয় অধ্যুষিত আজারি ছিটমহল নাগর্নো কারাবাখ এখন পুরো আজারবাইজানের অংশ। জাতিগত আর্মেনীয়রা এর বাসিন্দাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় এটি আজারবাইজানের সঙ্গে যোগ দিতে গররাজি ছিল। ১৯৯১ সালে নাগর্নো কারাবাখ স্বাধীনতা ঘোষণা করলে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় ১৯৯৪ সালে ঐ যুদ্ধ শেষ হয়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। এ বছর সেপ্টেম্বরে আজারবাইজান ফের হামলা চালিয়ে ছিটমহলটি অধিগ্রহণ করে নেয়। বিশ্লেষকদের ধারণা, ইউক্রেন যুদ্ধ আজারবাইজানকে এই সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে।