8 C
Toronto
মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৩, ২০২৪

ডাডা

ডাডা - the Bengali Times
ছবিজাভেদ ইকবাল

মাঝ রাত।

ঘুমিয়েছে ভেবে উঠে আসতে গেলেই হয়তো সে পেছন থেকে জামা টেনে বলবে, কোই যাও ড্যাডি? তার মোশন ডিটেক্টর, সেন্সর খুব প্রখড়। খুব সাবধানে তার বিছানা ছেড়ে উঠে আসি। আজ ভাগ্য সুপ্রসন্ন। সে আসলেই ঘুমাচ্ছে!

- Advertisement -

এটা আমার নিত্যদিনের ধরাবাধা সময়সূচি। বিপদে পড়তে হয় যদি সে সন্ধ্যার সময় মিনিট পনেরোর জন্য ঘুমায়। তখন রাত দুইটা পর্যন্ত ঘুমের ভাণ করে জেগে থাকবে। আমি পালাতে গেলেই সে চেঁচিয়ে উঠবে, “না না!”। আমার দুরবস্থা দেখে গিন্নি বলে, “যত পারো বুকের মধ্যে রাখো মেয়েটাকে। এই আর ক’বছর.. তারপর দেখবা আর আসবে না। নিজেকে নিয়ে, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে তার নতুন বিশ্ব তৈরী হবে। তখন তুমি হাজার চাইলেও আর দিনগুলো ফিরে পাবা না!”
তবে আনন্দের খবর হলো, এদেশে মেয়ে বিয়ে দিতে বাবাদের অতো টেনশন করা লাগে না; মেয়ে বিদায় দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে বিয়ে বাড়ি মাথায় তোলা লাগে না। বাংলাদেশে মেয়েরা কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুরবাড়ি যায়। আর এখানে মেয়েরা বর বগলদাবা করে হাসতে হাসতে নিজের সংসারে যায়।
আমি নিচে নেমে এসে প্রতিদিনের মতো এক কাপ চা হাতে খবরের সামনে বসি।

দেরিতে ঘুম আসা ছাড়া দুনিয়ার উপর আমার তেমন কোনো অভিযোগ নাই। এ ব্যাপারে আমি প্রচন্ড হিংসুটে। “যেখানে কাত, সেখানে রাত” বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষদের দেখলে আমি প্রচন্ড জেলাস ফিল করি। ঘুমোতে গিয়ে আমার গায়ের গেঞ্জিটার হাতাও যদি সামান্য টানটান হয়ে যায়, ব্যাস ঘুম শেষ। আর শরীর স্পর্শ তো দূরের কথা, এমন কি কেউ দুই ইঞ্চি দূরে থাকলেও বৈদ্যুতিক আবেশে আমার ঘুম শেষ। এ নিয়ে আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের অভিযোগের শেষ নাই। এটা নিঃসন্দেহে আমার মানসিক সমস্যা, চিকিৎসা দরকার।

মেয়েটা আমার কোলের মধ্যে সারাজীবন থাকলেও সমস্যা নাই। সমস্যা হলো আমাকে ঘুমাতে হবে। বাবা হিসাবে আমি এটার নাম দিয়েছি “স্বর্গীয় সমস্যা”।
রাত প্রায় একটা।

খবর দেখতে দেখতে বাইরের ঘরে প্রায় ঘুমিয়েই গিয়েছিলাম। ভাবলাম আজ আর বেডরুমে গিয়ে কাজ নেই, এখানেই ঘুমাবো। বাইরের ঘরের টেলিভিশনের সামনে একটা মস্ত বিছানা পেতে রেখেছি। বিছানার শুয়ে, কাঁথা গায়ে, চায়ে চুমুক দিতে দিতে টিভি দেখবো না; এ হতেই পারে না!
ঘরের সৌন্দর্যের গুষ্টি কিলাই।

হঠাৎ আমার লেপ ধরে টানাটানি। মেয়েটা ডাকতে থাকে- ড্যাডি ড্যাডি!

আমি হাত বাড়িয়ে ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেখি মেয়েটা তার বিখ্যাত “ছোট বালিশ” নামক কোলবালিশটা হাতে দাঁড়িয়ে। রাগ মিশ্রিত, ছলো ছলো, অভিমানী চোখে চেয়ে আছে। বলল, ড্যাডি তুমি চলে আসছো কেন?
– তুই ঘুমায়ে গেছিলি তাই
– আমি সারা বাড়ি তোমাকে খুঁজে পাচ্ছি না! আমি ঘুমালেই তুমি চলে আসবা?
– ঘুমালে আর কাউকে লাগে?
– হ্যা লাগে!
– তুই কিভাবে বুঝলি আমি চলে আসছি?
– কেউ পাশে না থাকলে বোঝা যায় না?- বলে সে রেসলিং এ যেভাবে একজন হিংস্র কুস্তিগীর আরেকজনের উপর লাফিয়ে পড়ে, ঠিক সেভাবে দিলো আমার গায়ের উপর লাফ! আমি ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলাম। আমাকে বাগে পেয়ে বলল, কী টের পাওয়া যায়? কেউ পাশে থাকলে বোঝা যায়!
– মা রে, সকালে অফিস, একটু ঘুমাতে দে?- বলে দুই হাত জোর করে তার কাছে ঘুম ভিক্ষা চাই..
সে মানলো না।

তার ‘ড্যাডি’ চাই-ই চাই; দুনিয়া উল্টিয়ে গেলেও। আবার তাকে নিয়ে ঘুমাতে যাই। তাকে চালাকি করে আমাদের বেডরুমে নিয়ে মাঝখানে শুইয়ে দেই। কারণ তার ঘরের ছোট বিছানায় একদম দুইজন আটে না, কোনদিন যে আমি মেঝেতে পড়ে গিয়ে দাঁত-নাক ভাঙবো তার ঠিক নাই..। এবার সে কিন্তু খুব সতর্ক! আমার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে; কোনোমতেই তার টেডি বেয়ার ড্যাডিকে পালাতে দেবে না। কেন রে বাবা, মায়ের কোলে ঘুমানো যায় না? আরেকপাশে তার মা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এই ভদ্রমহিলাকে দেখে আমার প্রচন্ড হিংসে হয়!
পিতৃত্বের সবচাইতে আনন্দের ঘটনা হলো যখন তার কন্যার চেহারা, স্কিন কালার; সব কিছু বাবার মতো হয়। মেয়েটা অবিকল আমার মতো। ছোটকালে আমি তার চাইতেও বেশি স্কিনি, টিংটিঙে ছিলাম। স্বভাবে যদিও আকাশ পাতাল তফাৎ। আমি খ্যাৎ, স্লো, আনস্মার্ট। আর সে ঠিক উল্টো। এটাও একজন বাবার জন্য আরেক আনন্দের ঘটনা!

মিনিট দশেকের মধ্যে মেয়েটা ঘুমিয়ে গেলো। ভালোবাসার মানুষদের ছুঁয়ে হাজার বছর জেগে থাকা যায়, কিন্তু ঘুমানো অসম্ভব। আমি খুব সাবধানে পালানোর সময় সে পাশ থেকে মিনমিনে গলায় শুধু বলল, “গুড নাইট ডাডা, লাভ ইউ”।

আজ হঠাৎ সে ছাড় দিলো। হয়তো ভাবলো, দেই ছেড়ে.. ব্যাচারা আর কত ভুগবে; যথেষ্ট হয়েছে। আমাকে আদর করে অনেকসময় ‘ডাডা’ ডাকে সে। ড্যাডি’র সংক্ষেপ ভার্সন।

আমি উঠে গিয়ে মেয়েটার ঘরের ছোট্ট বিছানায় শুয়ে পড়ি। শরীরটা কোনোমতে আটাই; মাথা আর পা খাটের দুই প্রান্তের কাঠের সীমানায় ঠেকে গেলো। জড় পদার্থে শরীর ঠেকলে অবশ্য আমার ঘুমে তেমন ব্যাঘাত ঘটে না। এটা সৃষ্টিকর্তার অসীম রহমত; বিশেষ ছাড় আমার জন্য।
মেয়েটার ঘর আর ছেলেটার ঘর পাশাপাশি। তাদের দুজনের বিছানার পার্টিশন মূলত ঘরের পাতলা দেয়াল। ছোটকালে ইংলিশ সিরিয়ালে দেখতাম নায়ক এক ঘুষি মেরে ঘরের দেয়াল ফুটো করে ফেলতো। অবাক হতাম। তবে এখন বুঝি আসলে ব্যাপারটা অসম্ভব নয়, বডি বিল্ডাররা জোরে ঘুষি মারলে দেওয়াল ভাঙতে বাধ্য। তবে বাংলাদেশের নায়করা ঘুষি মেরে ইটের দেয়াল পর্যন্ত ভেঙে ফেলে! আমি দিব্যি পাশের ঘরে ছেলেটার খুটখাট শব্দ শুনতে পাচ্ছি। তারও মনে হয় বাপের মতো ঘুমের সমস্যা আছে। হঠাৎ ছেলেটার গলায় গান ভেসে আসে, একদম স্পষ্ট! ডায়ার স্ট্রেইটস এর “Walk of life “. সে গাইতে থাকে-

Here comes Johnny singing oldies, goldies
“Be-Bop-A-Lula, ” “Baby What I Say”
Here comes Johnny singing, “I Gotta Woman”
Down in the tunnels, trying to make it pay…

আমিও তার গলার গলা মিলিয়ে, সুরে তাল মিলিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেয়ালে টোকা মেরে মিউজিক বাজাতে থাকি। ছেলেটা বুঝে ফেলে হেসে ফেলে। বোঝা যাচ্ছে ছেলেটা খুব খুশি; নির্ঘুম রাতে আরেকজন সঙ্গী পেয়ে!
তবে জাস্ট সময়ের ব্যাপার; মেয়েটা আবার আসবে ছোট্ট কোল বালিশটা হাতে..

অটোয়া, কানাডা

 

 

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles