9.4 C
Toronto
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

মায়া রিভারা-১

মায়া রিভারা-১ - the Bengali Times
ছবি জাজাবেল ম্যাঙ্গোলজা

প্রতি বছর ব্যস্ত একঘেয়ে জীবন থেকে কিছুটা অবসর নেবার জন্য বেড়িয়ে পড়ি দূরে বা কাছে কোথাও বেড়াতে। সংসার, কর্ম ব্যস্ত জীবন যখন হাঁপিয়ে তোলে তখন মনে হয় সময় এসেছে নিজের দিকে ফিরে তাকাবার, নিজেকে ভালোবাসার, নিজেকে আপ্যায়ন করার। সে উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়ি জীবনটাকে অন্যভাবে দেখার জন্য।

এবার আমি আর আমার জীবন সঙ্গী ঠিক করলাম এমন কোথাও যাবো যে দিকটাতে আমাদের আগে যাওয়া হয়নি কখনো এবং উড়োজাহাজে বেশি সময় বসে থাকতে হবে না। কম্পিউটার খুলে বসে গেলাম দুজনে। খুঁজে বের করলাম আমাদের মনের মতো একটি জায়গা। ম্যাক্সিকোর উপসাগরের তীর ঘেঁষা একটি রেজোটে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ম্যাক্সিকোর রেজোর্ট শহর রিভারা মায়ার ‘মায়া রিভারা’ রেজোর্টে আমরা যাবো এবার। যেই ভাবা সেই কাজ। টিকেট বুক করে ফেললাম। রেজোটেও বুকিং দেয়া হয়ে গেল। সবকিছু ঠিক করে টিকেট কেনার পরে ছেলে-মেয়েদের জানালাম আমাদের বেড়াতে যাবার কথা। ছেলে-মেয়ে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকলো আমাদের দিকে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা হলো ভেকেশান মাস্টার। কতো জায়গাতে ওরা ঘুরে বেড়ায়। কিছুমাস পর পর ভেকেশান না নিলে ওদের জীবনই বরবাদ। এই তো গত সাপ্তাহে মেয়ে তার পরিবার নিয়ে ঘুরে এলো ক্যারেবিয়ানের একটা রেজোর্টে থেকে। বুঝলাম ছেলে-মেয়ে খুবই অপমানিত বোধ করছে ওরা এত অভিজ্ঞ এসব ব্যাপারে অথচ তাদের কোনো পরামর্শ উপদেশ কিছুই নিলাম না আমরা। আমি হাসলাম আর মনে মনে বললাম, তোমরা যখন ছোট ছিলে তখন দুধের বোতল আর ডায়পার ব্যাগ নিয়ে কতো দেশ ঘুরেছি। তোমরা ছোট দুই ভাই-বোনকে নিয়ে সারা ইউরোপ ঘুরে বেড়িয়েছি তখন তো আমরা কারো পরামর্শ নেইনি। তোমাদের কিশোর বয়েসেও ঘুরে বেড়িয়েছ কত জায়গাতে আমাদের সাথে। আর এখন কি-না তোমরা ভাবছো তোমাদের সাথে কথা না বলে কী করে টিকেট কিনে ফেললাম? তবে অনেক খুশি হলাম ছেলে-মেয়েদের আমাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়া দেখে। মুখে বললাম, সত্যি অনেক ভুল হয়ে গেছে, আমাদের উচিৎ ছিল টিকেট কেনার আগে তোমাদের সাথে কথা বলে নেয়া। তারপর ছেলে-মেয়ে ইন্টারনেট খুলে দেখতে বসে গেলো এই রেজোর্টটা আমাদের জন্য কতোটুকু আনন্দদায়ক হবে? ওরা কথা বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছালো আমাদের পছন্দ ঠিকই আছে। ওদের র্কমকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছিল ওরা আমাদের বাবা-মা আর আমরা তাদের সন্তান। আমরা ওদের সাথে যা করেছি ওরা ঠিক সেটাই করছে আমাদের সাথে।

- Advertisement -

যা-হোক অবশেষে মেয়ে, মেয়ের জামাই মিলে আমাদের বিচব্যাগ গুছিয়ে দিল। সূর্যের তাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করার লোশান, তাপে পুরে গেলে সেটা নিরাময়ের লোশান, পোকা মশা কামড়ানো থেকে নিজেকে বাঁচাবার ক্রিম। তারপরও যদি কামড় দিয়ে ফেলে সে জন্য আফটার বাইট ক্রিম। সুইমিং পুল বা সাগরে সাঁতার কেটে ওঠার পর যে গাউনটা দিয়ে নিজেকে জড়াতে হবে সেটাও মেয়ে বিচ ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো। পই পই করে আমাদের হাজারটা উপদেশ দিয়ে দিল। মেয়ে বারবার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হতে চাইলো, আমরা পাঁচতারা হোটেল বুক করেছি কি-না? ছেলে-মেয়ে চলে যাবার পরে আমরা দুজন মিলে অনেক আনন্দের হাসি হাসলাম আমাদের সন্তানদের বাবা-মায়ের প্রতি এতটা খেয়ালী দেখে। যাবার দিন ছেলে আমাদের এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিলো। ছেলে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে আমাদের জড়িয়ে ধরে বলে গেলো, ভ্রমণের প্রতিটি মুহূর্ত যেন আমরা উপভোগ করি।

বিমানবন্দরে ঢুকে চেক ইন করলাম তারপর এগিয়ে গেলাম। নিরাপত্তা প্রক্রিয়া শেষ করে হাঁটতে শুরু করলাম আমাদের নির্দিষ্ট গেটে পৌঁছাবার উদ্দেশ্য নিয়ে। গেটে এসে যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসলাম। আরো অনেকটা সময় হাতে আছে আমাদের। আমার পাশে এসে বসলেন একজন মধ্যবয়েসী কিংবা তার চাইতে একটু বেশি বয়েসী একজন মহিলা। খুবিই হাসি খুশি মনে হলো মহিলাকে দেখে। আমাকে বললো, জানো আমি জীবনে কখনো একা বেড়াতে যাইনি। এবার আমি একা যাচ্ছি। আমি নিজেকে নিজে ট্রিট করতে যাচ্ছি। আমি মৃদু হেসে জিজ্ঞাস করলাম, আগে কার সাথে যেতে? এখন কেন যাচ্ছ না তাদের সাথে? মহিলা খুব স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলেন, আগে যেতাম বয়ফ্রেন্ডের সাথে তারপর গেছি নিজের হাসবেন্ডের সাথে। আমাকে জিজ্ঞাস করলো তুমিও কি একা যাচ্ছ? আমি মাথা নেড়ে বললাম না আমরা দুজনে যাচ্ছি? আমি জিজ্ঞাস করলাম কোথায় যাচ্ছ তুমি? মহিলা জবাব দিলো রিভারা মায়া। তাই নাকি? আমি বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম, আমরাও তো ওখানে যাচ্ছি। তবে জানা গেলো আমরা এক শহরে গেলোও আমাদের রেজোট ভিন্ন। এত কথার পরে আমরা খেয়াল করলাম আমাদের কেউ করো নাম জিজ্ঞাস করা হয়নি। আমাদের মাঝে নাম বিনিময় হল। মহিলাটির নাম অলিভিয়া। আমার নামও জানালাম তাকে। আমরা দুজনই জানি ভবিষ্যতে আমাদের দেখা আর কোনোদিনও হবে না। এমন এয়ারপোর্ট বন্ধু উড়োজাহাজ বন্ধু আমার জীবনে অনেক হয়েছে কিন্তু পরবর্তীকালে কখনো তাদের সাথে দেখা হয়নি। অলিভিয়া প্রাণ খুলে তার মনের কথা আমাকে খুলে বলতে বসলো। অলিভিয়া জানে আমি আর সে এক গোত্রের, এক সমাজের, এক ধর্মের, এক রঙের মানুষ না। কাজেই আমাকে বলতে কোনো সমস্যা কোথায়? তাছাড়া এতদিন এদেশে থেকে বুঝতে পেরেছি তারা ব্যক্তিগত কথাগুলো বিনা দ্বিধাতে বলে যেতে পারে। অলিভিয়ার ভাই আসার সময় তাকে একটা আই ফোন দিয়েছে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু অলিভিয়া সবকিছু বুঝতে পারছিল না ফোনটির। আমার হাতে আই ফোন দেখে আমার কাছে জানতে চাইলো কিছু জিনিশ ফোনের ব্যাপারে। আমিও মহাপণ্ডতিসেজে বসে গেলাম তাকে সবকিছু বুঝাতে। অলিভিয়া আনন্দে আটখানা।

অলিভিয়ার সাথে এত অল্প সময়ে অনেক আন্তরিকতা হয়ে গেলো। আমি আমতা আমতা করে অলিভিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার হাসবেন্ড কোথায়? তোমার কোনো ছেলেমেয়ে আছে? আমার প্রশ্নের জবাবে অলিভিয়া তার জীবনের খাতা খুলে বসলো আমার কাছে। বলতে থাকলো সে তার বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করেছিল কারণ সে একটা সন্তান চায়। কিন্তু সে অবিবাহিত অবস্থাতে সন্তান চায় না। বিয়ের পর তাদের বাচ্চা হচ্ছে না দেখে চললো চিকিৎসা। অলিভিয়া ঠিক হলো কিন্তু তবুও সন্তান ধারণ করতে পারছে না। তাই তার স্বামীকে পাঠানো হলো নানা ধরনের পরীক্ষাতে। জানা গেলো তার স্বামীর পিতা হবার ক্ষমতা নেই। আমি আবারো জিজ্ঞাস করলাম, তোমার স্বামী এখন কোথায়? অলিভিয়া নির্বিকারভাবে জবাব দিলো সে কারাগারে। আমি চমকে উঠলাম, জিজ্ঞেস করলাম কেন? অলিভিয়া আবারো নির্বিকারভাবে জবাব দিলো কারণ সে একজন চোর। আমি তো চোরের বউ হয়ে থাকতে পারি না তাই তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছি। আমি এখন আমার মতো আনন্দে আছি। ভাবলাম ঠিকই করেছে অলিভিয়া চোরের বউ চুন্নি সে পরিচয় নিয়ে কেন থাকবে?
চলবে…
ম্যাল্টন, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles