7.7 C
Toronto
বুধবার, মে ১, ২০২৪

টিকটক ভিডিওতে অতিথি না করায় বাংলাদেশি নারীকে ‘যৌনকর্মী’ আখ্যা

টিকটক ভিডিওতে অতিথি না করায় বাংলাদেশি নারীকে ‘যৌনকর্মী’ আখ্যা
<br >প্যারিসে বসবাসরত হাসান সাঈদ

যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ারের বাসিন্দা সুলতানা (ছদ্মনাম) টিকটক ব্যবহার করেন। নারী প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব, নির্যাতন ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন কন্টেন্ট পোস্ট করতেন তিনি। ২০২১ সালে এক বন্ধুকে অনলাইন ট্রল ও বুলিং থেকে বাঁচাতে গিয়ে হাসান সাঈদ নামে প্যারিসে বসবাসরত এক বাংলাদেশি টিকটকারের ‘টার্গেটে’ পড়েন তিনি।

এরপর থেকে নিয়মিত সুলতানাকে লক্ষ্য করে বিদ্রুপ, ঘৃণা ও হুমকিমূলক বিভিন্ন কন্টেন্ট পোস্ট করতে থাকেন হাসান। টানা দুই বছর সুলতানাকে এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়।

- Advertisement -

সুলতানা বলেন, আমার মনে হচ্ছিল মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়েছে। আমি প্রতিদিন কাঁদতাম। খেতে পারতাম না। ঘুমাতে পারতাম না। একপর্যায়ে মনে হত মরে যাওয়া ভালো। আমি আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করেছি।

তিনি বলেন, দুই বছর আমার ওপর দিয়ে কী গেছে বলে বোঝাতে পারব না। আমাকে লক্ষ্য করে পোস্ট করা বিভিন্ন কন্টেন্টে লোকজন হাসাহাসি করত, উসকানিমূলক মন্তব্য করত। আমি প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় থাকতাম। একপর্যায়ে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। এখনো আমি পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের মধ্যে রয়েছি।

যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির নারীদের মধ্যে টিকটক ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া বেশ জনপ্রিয়। কারণ সেখানে তারা মন খুলে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলতে পারেন, পছন্দমতো কন্টেন্ট শেয়ার করতে পারেন। আর প্যারিসপ্রবাসী টিকটকার হাসানও তার বিদ্বেষমূলক কন্টেন্টের লক্ষ্যবস্তু বানান যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকজনকেই। কারণ ফ্রান্সের কাউকে তিনি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছেন— এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।

হাসানের টিকটক অ্যাকাউন্টের ফলোয়ারের সংখ্যা হাজার হাজার। তিনি যাদের টার্গেট করেন, প্রথমে ফেসবুক,ইনস্টাগ্রাম ও অন্য সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তাদের ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করেন। তারপর সেসব তথ্য ব্যবহার করে ভিকটিমদের বিরুদ্ধে উসকানি-ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক ভিডিও বানান।

আত্মঘাতী হতে চেয়েছিলেন সুলতানা
হাসানের আরেক টার্গেটের নাম মাসুমা। টিকটকে নিয়মিত বিভিন্ন খাবারের রেসিপি শেয়ার করেন তিনি। তার ছোট একটি দোকানও রয়েছে। সেই ব্যবসাও তিনি পরিচালনা করেন টিকটকের মাধ্যমে।

২০২২ সালের কোনো একদিন তার ভিডিওতে হাসান মন্তব্য করেন এবং বলেন তিনি মাসুমার ভিডিও কন্টেন্টে অতিথি হতে চান। মাসুমা তা প্রত্যাখ্যান করলে হাসান তাকে হুমকি দেন। এর কিছুদিন পর একটি কন্টেন্ট টিকটকে ঘুরে বেড়াতে দেখেন মাসুমা। সেখানে তার ছবি ও ঠিকানা ব্যবহার করে বলা হয়— তিনি একজন যৌনকর্মী।

টিকটকে রিপোর্ট করার পর সেই ভিডিও মুছে ফেলা হলেও মাসুমাকে ব্যাপক ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়। তিনি বলেন, ‘অনেক দিন আমার ফোনে অপরিচিত বিভিন্ন নম্বর থেকে কল আসত এবং অশ্লীল প্রস্তাব-হুমকি দেওয়া হত। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আমার সব ছবি মুছে ফেলতে হয়েছে। ফোন নম্বর বদলাতে হয়েছে। টিকটক ব্যবহার বন্ধ রাখতে হয়েছে।’

তিনি আরও জানান, হাসানের বিরুদ্ধে ওয়েলস পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েও হতাশ হয়েছেন। কারণ, পুলিশ তার অভিযোগ কানে তোলেনি।

হাসানকে থামাতে শেষ চেষ্টা

টিকটকার হাসান যে কেবল বাংলাদেশি নারীদের লক্ষ্যবস্তু করেন তা নয়। কামরুল ইসলাম নামের এক যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিও হয়রানির শিকার হন তার কারণে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে টিকটকে নিজের স্ত্রীর ছবি সম্বলিত একটি ভিডিও দেখতে পান কামরুল। সেই ভিডিওতে তার স্ত্রীকে ‘পেশাদার যৌনকর্মী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

নিজের স্ত্রীকে নিয়ে এমন আপত্তিকর ভুয়া ভিডিও দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন স্ট্যাফোর্ডশায়ারের বাসিন্দা কামরুল। অনলাইনে হাসান সাঈদকে এসব ভিডিও সরিয়ে দিতে বলেন তিনি। তাতে ফল হয় উল্টা। হাসান এবং তার ফলোয়াররা কামরুল এবং তার পরিবারের সদস্যদের লক্ষ্য করে একাধিক কন্টেন্ট শেয়ার করা শুরু করেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার কামরুল ও তার সন্তানদের হত্যা এবং তার স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়।

কামরুল বলেন, আমি প্রথমে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিইনি। পরে বাংলাদেশি কমিউনিটির অন্যদের থেকে জানতে পারলাম, হাসান কয়েক বছর ধরে এই কাজ করছে। যখন এসব ঘটছে, আমার স্ত্রী সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বড় সন্তান স্কুলে যায়। আমার মধ্যে শঙ্কা ছিল— যদি আমার অনুপস্থিতিতে স্ত্রী-সন্তানের ওপর হামলা হয়, তখন কী হবে?

একপর্যায়ে টিকটক কর্তৃপক্ষকে হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তিনি। কিন্তু টিকটক কর্তৃপক্ষ জানায়, হাসান তাদের কমিউনিটি গাইডলাইন ভঙ্গ করেননি। এরপর প্যারিসে ব্রিটেনের দূতাবাসের মাধ্যমে ইংরেজি জানেন এমন একজন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি।

ম্যাথিউ ক্রোইজেট নামের ওই আইনজীবীর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনার পর প্যারিসের একটি আদালতে হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করেন কামরুল। তবে সেই মামলায় দৃশ্যমান অগ্রগতি হচ্ছিল না। কামরুলের আইনজীবী তাকে জানান, যেসব পোস্টকে আপত্তিকর বলা হচ্ছে ফ্রান্সের প্রচলিত আইন ও সংস্কৃতিতে তা আপত্তিকর নয়। কেউ যদি হামলা না করে কেবল হুমকি দেয় সেক্ষেত্রে তা বড় অপরাধ গণ্য করে না ফ্রান্সের আইন।

এছাড়াও ফ্রান্সের প্রয়োজনের তুলনায় বিচারকের সংখ্যা কম। পাশাপাশি রয়েছে ইসলামভীতি। যদিও কামরুল যখন প্যারিসের আদালতে মামলার ব্যস্ততায় ছিলেন, তখনও হাসান থামেন নি। কামরুল শেষ চেষ্টা হিসেবে যোগাযোগ করেন ব্রিটেনের পার্লামেন্টের অধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইনফরমেশন কমিশনার অফিসে (আইসিও)। আপত্তিকর ভিডিওগুলোর লিংকও শেয়ার করেন।

আইসিওতে অভিযোগ করার পর কাজ হয়। ভিডিওগুলো দেখে আইসিও কর্মকর্তারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে ভিডিওগুলো মুছে ফেলা এবং হাসানের যাবতীয় অ্যাকাউন্ট অকার্যকর করতে টিকটক, ফেসবুক এবং ইউটিউবকে ৭ দিন সময় দেওয়া হয় এবং তা কার্যকর হয়।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles