9.4 C
Toronto
শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

৮ বছর পর জানা গেল মেয়ের খুনি বাবা

৮ বছর পর জানা গেল মেয়ের খুনি বাবা

পারুল আক্তার, টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার গরিয়া গ্রামের স্বচ্ছল কৃষক আ. কুদ্দুছ খাঁর মেয়ে ছিলেন। পড়াশোনা করছিলেন দশম শ্রেণিতে।

- Advertisement -

কুদ্দুছের ইচ্ছা ছিল নিজ হাতে মেয়ের বিয়ে দেবেন। কিন্তু পারুল তা হতে দেননি। পালিয়ে বিয়ে করেন প্রেমিক নাছির উদ্দিন বাবুকে। এতে ক্ষোভ হয় তার বাবার। মেয়েকে ফুসলিয়ে এনে হত্যা করেন। এ ঘটনায় জামাই নাছিরকে ফাঁসাতে আঁটেন নানা ছক। মামলার পর মামলা, না-রাজি; কত কিছুই না করেছেন। কিন্তু, আইনের ফাঁক গলে নিজে বাঁচতে পারেননি। ধরা পড়েছেন কুদ্দুছ।

মেয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর নিজের স্বপ্নভঙ্গ ও সম্মানহানির ঘটনায় পারুলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন কুদ্দুছ খাঁ। অপেক্ষা করছিলেন মোক্ষম সময়ের। একসময় মিলেও যায় যে সুযোগ। হাতছাড়া না করে প্রথম সুযোগেই মেয়েকে বন্ধুর বাড়ি নিয়ে হত্যা করেন। টানা ৮ বছর ধরে মেয়ের জামাই নাছিরকে ফাঁসাতে একের পর এক মামলা চালিয়ে আসছিলেন। থানা পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), সিআইডি তার মামলার তদন্ত করে। কোনো মামলায় নাছিরের সংশ্লিষ্টতা পায়নি সংস্থাগুলো। কিন্তু আদালতে প্রতিবেদন দিলে কুদ্দুছ তার পরিপ্রেক্ষিতে না-রাজি দিতেন।

পরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সম্পূরক তদন্ত শুরু করে পিবিআই ঢাকা জেলা। এতেই বের হয় হত্যার রহস্য। ২০১৫ সালে বন্ধু মোকাদ্দেছ ওরফে মোকা মণ্ডলের সহযোগিতায় পারুলকে শ্বাসরোধে হত্যার পর নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন কালিহাতি উপজেলার গরিয়া গ্রামের এ কৃষক।

ঘটনার শুরু ২০১২ সালে। সে বছর দশম শ্রেণিতে পড়তেন পারুল। রোল ছিল দুই। সুন্দরী পারুল প্রেমে পড়েন এলাকার তরুণ নাছিরের সঙ্গে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর নাছিরের প্রবাসী বাবা বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু কুদ্দুছ রাজি ছিলেন না। বাবার সিদ্ধান্তে তুষ্ট হতে না পেরে একদিন সকালে প্রাইভেট পড়ার নাম করে বাড়ি ছাড়েন পারুল। মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে এমন অভিযোগে থানায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেন কুদ্দুছ খাঁ। কিন্তু ততক্ষণে গ্রামের সবাই জানে, নাছিরের হাত ধরেই পালিয়েছে তার মেয়ে।

বাড়ি থেকে পালিয়ে নাছিরের সঙ্গে ঢাকার আশুলিয়ায় চলে আসেন পারুল। সেখানেই বিয়ে করেন। পরে দুজনেই একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। বসবাস করতেন আশুলিয়ার জামগড়ায় ভাড়া বাসায়। শুরুতে সুখে সংসার করলেও বেশ কয়েকদিন পর শুরু হয় অশান্তি।

২০১৫ সালে কুদ্দুছ খাঁকে ফোন করেন পারুল। জানান নাছিরের সঙ্গে সংসারে অশান্তির কথা। এ সময় মেয়েকে তার ‘ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা’র কথা জানান কুদ্দুছ। কিন্তু মনে মনে যে অপমান ও রাগ পুষে রেখেছিলেন, সেটি বুঝতে দেননি। ফিরে আসতে বলেন মেয়েকে। ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেবেন বলেও জানান। লোভ দেখান উন্নত জীবন গড়ে দেওয়ার।

জন্মদাতা বাবার কথা শুনে মেয়েও বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। একই বছরের ১৮ জুলাই নাছির তার নানীকে দেখতে বাড়ি যান। এ সুযোগে স্বামীর সংসার ছাড়েন পারুল। ১৯ জুলাই বাবাকে ফোন করে টাঙ্গাইল ফেরেন তিনি। একই দিন বাসায় ফেরেন নাছির। স্ত্রীকে না পেয়ে কুদ্দুছ খাঁর বিরুদ্ধে ‘বাবার বাড়ি পালিয়ে যাওয়ার প্ররোচনার’ অভিযোগে আশুলিয়া থানায় জিডি করেন।

সেদিন টাঙ্গাইল ফেরার পর পারুলকে নিতে যান কুদ্দুছ। কিন্তু তাকে বাড়ি না নিয়ে এসে ভূঞাপুরে বন্ধু মোকা মণ্ডলের কাছে নিয়ে যান। মেয়েকে বলেন, তার মোকা চাচা সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবেন। কিছুদিন নাছিরের কাছ থেকে লুকিয়েও রাখবেন। পরে মেয়ে ও বন্ধুসহ জয়পুরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেন কুদ্দুছ।

জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকায় পৌঁছে বাস থেকে নেমে পড়েন তারা। পারুলকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তুলসী গঙ্গা নদীর পাশে আসেন কুদ্দুছ ও মোকা। নির্জন রাতে মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন কুদ্দুছ। পরে পারুলের পরনের ওড়না দুই ভাগ করে তার হাত-পা বেঁধে ফেলেন। মোকা মণ্ডলের সহায়তায় পারুলের গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। পরে মরদেহ ফেলে দেন তুলসী গঙ্গা নদীতে। সে রাতেই টাঙ্গাইল ফিরে আসেন তারা।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর ২০১৫ সালের ৪ আগস্ট টাঙ্গাইলের আদালতে নাছির ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে পারুলকে অপহরণ ও গুমের মামলা করেন কুদ্দুছ। সেটি আদালতের নির্দেশে কালিহাতি থানায় নথিভুক্ত হয়। প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করে নাছির-পারুলের প্রেম ও বিয়ের সূত্র পায়। কিন্তু ‘ভুক্তভোগী’ পারুলকে না পাওয়া ও ঘটনাস্থল তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়ায় ঢাকার মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করে কালিহাতি পুলিশ।

এতে না-রাজি দেন মামলা বাদী। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিবি পুলিশ, টাঙ্গাইল পিবিআই ও সিআইডি তদন্ত কাজ করে। এ সংস্থাগুলোও একই প্রতিবেদন জমা দেয় আদালতে। তাতেও না-রাজি দেন কুদ্দুছ। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত জুডিশিয়াল তদন্তের ভিত্তিতে প্রতিবেদন দেন, ‘বাদী ঢাকার আদালতে মামলা করলে প্রতিকার পেতে পারে। ’

প্রতিবেদন অনুসারে ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর কুদ্দুছ খাঁ ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন আদালতে উপরোক্ত তদন্তের রেফারেন্সসহ নারী নির্যাতন দমন আইনে ‘যৌতুকের জন্য মারপিট করে হত্যা’ মমালার আবেদন করেন। ৩০ নভেম্বর আদালত আশুলিয়া থানাকে মামলা রুজু ও পিবিআই ঢাকা জেলাকে তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর পিবিআই ঢাকা জেলা মামলাটির তদন্ত শুরু করে। মামলার তদন্তভার পান পিবিআই’র উপ-পরিদর্শক (এসআই) বিশ্বজিৎ বিশ্বাস।

তদন্তের ধারাবাহিকতায় ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে নাছির উদ্দিনকে গ্রেফতার করেন এসআই বিশ্বজিৎ। আদালতের নির্দেশে তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এরপর ডাকা হয় মামলার বাদী কুদ্দুছকে।

রিমান্ডে নাছির জানান, পারুলের কোনো খোঁজ না মেলায় তিনি ২০১৫ সালের ১৯ জুলাই আশুলিয়ায় জিডি করেন। জিডিতে কিছু মিথ্যা তথ্যও দেন। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, নানার বাড়ি থেকে ফিরে স্ত্রীকে পাননি তিনি। এর দুই ঘণ্টার মধ্যে কোথাও খোঁজাখুঁজি না করে তিনি জিডি করেন। তার দাবি ছিল, পারুল যাওয়ার সময় ৫০ হাজার নিয়ে গেছেন।

কিন্তু প্রতিবেশীদের ভাষ্য ছিল ভিন্ন, নাছিরের ৫০ হাজার টাকা রাখার সামর্থ্য ছিল না। অন্তত তাদের ঘর দেখে সেটি প্রতীয়মান হয়। ২০১৬ সালে নিখোঁজ স্ত্রীকে একতরফা তালাক দেন নাছির।

৮ বছর পর জানা গেল মেয়ের খুনি বাবা
পারুলের হন্তারক বাবা কুদ্দুছ খাঁ

পিবিআই জানায়, নাছিরের কাছ থেকে পাওয়া পুরনো জিডির কপিতে ঝাপসা একটি নাম্বার পাওয়া যায়। যেখানে শেষের দুটি ডিজিট ৩৭ বোঝা যাচ্ছিল। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে কুদ্দুছের পরিবারের সবাইকে খবর দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কেউই নম্বরটির ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। জিডির কপিতে আরও একটি নম্বর পাওয়া যায়, যেটির শেষ দুটি ডিজিট ৯৫। পরে জানা যায় এ নম্বরটি পারুলের বোন জামাইয়ের। আর ৩৭ নম্বরটি কুদ্দুছ খাঁর।

বিষয়টি নিয়ে কুদ্দুছকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ওই নম্বরটি নিজের বলে স্বীকার করেন। ওই জানান, তার এ নম্বরের সিমটি ২০১২ সালে হারিয়ে গেছে। কিন্তু সিআইডির প্রতিবেদনে ওই নম্বরটি ২০১৫ সালেও সচলের কথা উল্লেখ ছিল। এসব ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকেন কুদ্দুছ। একবার বলেন, তার মনে হচ্ছে পারুল বেঁচে আছে। আবার জানান তিনি নিজেই বন্ধু মোকা মণ্ডলের বাড়ি মেয়েকে রেখে এসেছেন।

এতে তার ব্যাপারে সন্দেহ প্রশমিত হয় পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তার। তারা মোকা মণ্ডলের খোঁজ করেন। এরপরই বন্ধুর সহায়তায় নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করেন কুদ্দুছ খাঁ। পরে পাঁচবিবি থানায় যোগাযোগ করে ঢাকা জেলা পিবিআই। সেখান থেকে এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধারের খবর পান তারা। মরদেহের বর্ণনার সঙ্গে কুদ্দুছের বয়ানে মিল পান তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এমনকি পারুলের ছবির সঙ্গে মরদেহের ছবির মিল পান।

গত শুক্রবার (২০ জানুয়ারি) মেয়েকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন কুদ্দুছ।

পুরো ঘটনাটির বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার। জানান, ২০১৫ সালে নিজ হাতে মেয়েকে খুন করে জামাইকে ফাঁসাতে কুদ্দুছের দায়েরকৃত মামলায় বেরিয়ে আসে হত্যার মূল রহস্য। মেয়ের কার্যকলাপের অপমান বোধ করেন তিনি, যার পরিপ্রেক্ষিতেই এ খুনের ঘটনাটি ঘটে। খুনের পর তিনি ভাবতেন, এ অপমানের জন্য নাছিরও দায়ী। তিনি চেয়েছিলেন নাছিরের যেন ফাঁসি হয়। তাই তিনি বার বার মামলার তদন্তে না-রাজি দিচ্ছিলেন।

কুদ্দুছের বন্ধু মোকা মণ্ডলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রোববার (২২ জানুয়ারি) তাকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির জন্য আদালতে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান বনজ কুমার।

জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে নিয়ে মেয়েকে হত্যা করার কারণ প্রসঙ্গে কুদ্দুছের বর্ণনা অনুসারে পিবিআই প্রধান বলেন, সেখানে মোকা মণ্ডলের শ্বশুর বাড়ি। সেখানকার সব এলাকা মোকার জানাশোনা। বন্ধুকে সহায়তা করতে মোকা এগিয়ে আসেন এবং সেখানে নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কুদ্দুছ একজন স্বচ্ছল কৃষক ছিলেন। কিন্তু মামলা চালতে গিয়ে তার জমিজমা বিক্রি করে দেন। এখন তার ভিটাবাড়ি রয়েছে। মেয়েকে হত্যা করলেও মেয়ে জামাই নাছিরকে ফাঁসিতে না চড়াতে পারলে তার শান্তি হচ্ছিল না। তাই তিনি বার বার না-রাজি দিয়ে মামলা চালিয়ে আসছিলেন।

বনজ আরও বলেন, ইতোপূর্বে তদন্তে গাফিলতির চেয়ে বড় বিষয় বাদি কুদ্দুছকে বা তার পরিবারকে সন্দেহ করার কোনো কারণ ছিল না। ইতোপূর্বে তদন্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতি থাকলেও কুদ্দুছ দীর্ঘদিন মামলা চালিয়ে সেটি পুষিয়ে দিয়েছেন। আর নাছিরকে গত ১৯ জানুয়ারি রিমান্ড শেষে জেলে পাঠানো হয়েছে। তিনি জামিন চাইলে আমরা তাকে সাহায্য করবো। মামলার বাকি প্রক্রিয়া শেষে তিনি নিশ্চই মুক্তি পাবেন।

সূত্র : বাংলানিউজ

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles