9.4 C
Toronto
শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

অফ টপিক- ২

অফ টপিক- ২
ফাইল ছবি

আজ অনেক লেইট।

সকাল সাতটা চল্লিশে হুড়মুড় করে উঠে দ্রুত ইমেইল, আবহাওয়া, ফেইসবুক, বিবিসি বাংলার শেষ আপডেটে একনজর বুলিয়ে নিচে নেমে ডিমভাজি করে, দুই পাউরুটির মধ্যে দিয়ে চা হাতে ডাইনিং টেবিলে বসলাম মেয়েটার সামনে। সে রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছিল, তাই সকাল সকাল উঠে খেতে বসেছে। বাটিতে দুধ পাউরুটি সামনে নিয়ে নির্বিকার বসে কিছু ভাবছে। বলল, আব্বু তোমার বইটা থেকে কয় টাকা আর্ন করছো?

- Advertisement -

– মা, গুড কোয়েশ্চেন। এখনো আয় করিনি
– সেল হইছে কেমন?
– নতুন হিসাবে বেশ ভালো
– তাহলে টাকা পাচ্ছ না কেন?
– কিছু ব্যাপার আছে। হয়তো ফিউচারে পাবো।
তার প্রশ্ন সোজা সাপ্টা, যৌক্তিক। বাচ্চাদের অনেক প্রশ্ন থেকে বড়দের শেখা উচিত। আমার সকালটা শুরু হয় মেয়েটার চেহারা দেখে, আবার রাতও শুরু হয় তাকে দেখে। এ প্রজন্মের বাচ্চাদের ভালো লাগে; কারণ তারা সচরাচর মিথ্যা বলে না। অতীতের সেই নেংটো রাজার গল্পের মতো পরিস্থিতি আর নেই। নতুন প্রজন্মের কিছু অভাবনীয় ভালো দিক আছে, সফলতা আছে।

গাড়ি চলতেই রেজওয়ানা চৌধুরী’র গলায় “দুই হৃদয়ের নদী” গানটা চালু হয়ে যায়। মনযোগ দিয়ে শুনতে থাকি। মাঝে মাঝে আমার গানের সীজন আসে। এখন চলছে রেজওয়ানা চৌধুরী’র সীজন। গানটাতে এক পর্যায়ে আছে-
“অবশেষে জীবনের মহা যাত্রা ফুরাইলে,
তোমারি স্নেহের কোলে যেন গো আশ্রয় মিলে”

গানটা রিপিটে দিলাম। ওটা গীতবিতানের “আনুষ্ঠানিক” অংশে আছে। গানটা মূলত প্রার্থনার হলেও এখানে কি মানব-মানবীর সংসার যাত্রার চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে বলা হয়েছে? “দুই হৃদয়ের নদী” বলতে কী বোঝানো হয়েছে? অনেক সময় রবি ঠাকুরের গানের মর্ম বোঝা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। গীতবিতান বই যদিও আমার সব সময়ের সঙ্গী।

হাইওয়ে থেকে নেমে যেতে ইচ্ছা করে না।
মনে হয়, এই পথ যদি শেষ না হতো? ইচ্ছে হচ্ছে দূরে ড্রাইভ করে চলে গিয়ে গাছের ছায়া ভরা নদীর ধারে বসে থাকতে, হাঁস দেখতে, পাখির ডাক শুনতে, জলজ পাখি উড়ে বেড়ানো দেখে গরম কফিতে চুমুক দিতে। এরকম জায়গা অবশ্য অটোয়ায় অনেক আছে, প্রথম প্রথম এ শহরে এসে ওভাবে বসেও থাকতাম।

কবি সাহিত্যিকরা নদীর সাথে মানুষের জীবনের তুলনা করে।
যদিও মানব জীবন নদীর মতো, রেল লাইনের মতো নির্দিষ্ট পথে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে চলে না। তবে নদীরও জন্ম আছে, মৃত্যু আছে। যদিও একদম নিঃশেষ হয় না; সমুদ্রে মিলে মিশে একাকার হয়। সমুদ্র এখানে রূপক; হয়তো পরকালকে বুঝায়, বা সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যাওয়া বুঝায়। নদীও মানব জীবনের মতো পিছনে চলবার ক্ষমতা হারায়।

বাসার পাশের হাইওয়ে 174 এ উঠার পর থেকে একটা সাদা ভক্সওয়াগন গাড়ি আমার পিছু পিছু প্রায় বারো কিলোমিটার এগোলো। আমি 417 হাইওয়ে থেকে ডানে এক্সিট নিতে মেটক্যাফ রোডে নেমে গেলাম ডাউনটাউনের দিকে। সেটা আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আচ্ছা, আমি কি আশা করছিলাম সেটা যেন আমার পেছনেই আসতে থাকে? কিছুক্ষন আমার সাথে ছিল বলে মায়া তৈরী হয়েছিল?

এদেশে কাউকে যেচে সাইড দিলে বা তাকে লেন চেঞ্জ করতে সুবিধা করে দিলে সে রেয়ার-ভিউ মিররে এদিক ওদিক হাত দুলিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তার সাথে হয়তো কোনোদিন দেখাও হবে না, কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দেখতে ভালো লাগে। আসলে আমরা সবাই মনে মনে কৃতজ্ঞতা; ভালবাসা, স্নেহ, মমতা, সম্মান আশা করি।

তবে মিটলোফের একটা গানে মানুষের আত্মাকে গাড়ির সাথে, আর জীবনটাকে একটা ব্যস্ত মহাসড়কের সাথে তুলনা করেছে। উদাহরণটা মন্দ নয়। জীবনের মতো এ রাস্তাতেই বেআইনিভাবে রেসিং চলে; সমাজে যেভাবে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে। দামি গাড়ি, রোলেক্স ঘড়ি কিনে অন্যকে তাক লাগিয়ে আনন্দ পায়; পকেট ফাঁকা থাকলেও। আবার এ রাস্তাতেই অপরিচিত মানুষ হয়ে উঠে আপন। বিপদে পড়লে মানুষ চেনা যায়। কিছু মানুষ নিজ স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অন্যকে হেল্প করবে। একজন তার জব ইন্টারভিউ বাদ দিয়ে বরফে আটকানো আমার গাড়ি ঠেলেছিল। আরেকজন তো সেই শহর থেকে অনেক দূরে; জনমানবহীন বিস্তীর্ণ গমের ক্ষেতের ধারে নিজ দায়িত্বে বরফের মধ্যে আমার গাড়িতে শিকল বেঁধে তার পিকআপ ট্রাক দিয়ে টেনে খাদ থেকে উঠিয়েছিল। সাথে ছিল আমার বৌ-বাচ্চা-শাশুড়ী। প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে সন্ধ্যা পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল!

কিছু মানুষ হাসি মুখে আরেক মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে, বিনিময়ে কিচ্ছু আশা করবে না। আবার অনেকে শুধু পেতেই চায়, আমৃত্যু আশা করবে সবাই যেন তাকে মাথায় নিয়ে নাচে। আবার এ রাস্তাতেই একসিডেন্ট করে জীবন বরবাদ হয়ে যেতে পারে নিমেষে। জীবন হয় ঠুশ, হার্ট এটাকে মৃত্যুর মতো। এ রাস্তাতেই একজন অপরিচিত মানুষের হাতের সামান্য ইশারা, মিষ্টি হাসি, কৃতজ্ঞতাবোধ দিনটা সুন্দর করে দিতে পারে। কিছু স্বল্প পরিচিত মানুষ আজীবন আপনার সাথে থাকবে। আবার অনেক নিকট আত্মীয়ও হয়ে যাবে পর; স্বার্থের খাতিরে। গাড়ির স্টিয়ারিং শক্তভাবে না ধরলে যেমন বিপদ নিশ্চিত, তেমন মানুষ হাল ছেড়ে দিলেও জীবন খাদে পড়তে বাধ্য।
মজার ব্যাপার হলো, ততক্ষনে আমি অফিস পৌঁছে গেছি। অথচ কিছু ভাবতে হয়নি। মানুষের ব্রেইন প্রোগ্রামড হয়ে যায়, সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির মতো। শুধু জিপিএস এ এড্রেস পুট করলেই হলো!
তারপর আবার সেই অফিস, ব্রেক, বাসায় যাবার জন্য গোছগাছ।

বাসায় পৌঁছে পার্কিং করতেই হয়তো মেয়েটা খালি পায়ে দৌড়ে আসবে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। মিষ্টি হাসি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করবে, কত সুখ দুঃখের কথা বলবে!
তারপর আবার রিপিট হবে; রেজওয়ানা চৌধুরীর গানের মতো।
অবশ্য নাও হতে পারে..
.
“সেই এক আশা করি দুইজনে মিলিয়াছে,
সেই এক লক্ষ্য ধরি দুইজনে চলিয়াছে।
পথে বাধা শত শত, পাষাণ পর্বত কত,
দুই বলে এক হয়ে ভাঙিয়া ফেলিবে তায়॥”
এসব জাদুকরী কথা একজন মানুষের মাথায় আসে কিভাবে? অসম্ভব সুন্দর!
গানটা শুনতে হবে আরো..

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles