ঈদ সামনে রেখে জাল টাকার কারবারিরা এখন বেপরোয়া। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন ১০-১২টি চক্র সক্রিয় বলে তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গোপনে চালায় জাল নোট তৈরির কাজ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আট জেলায় টাকা সরবরাহ করা হয় বলে জানতে পেয়েছেন। আর জাল রুপি সরবরাহ করা হচ্ছে তিন জেলায়। এ ছাড়া তিন ধরনের জাল নোটের খোঁজ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এ জালনোট বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত ২৮৮ জনকে শনাক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ১২ এপ্রিল পুরান ঢাকার লালবাগে একটি জাল মুদ্রা তৈরির কারখানায় অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। অভিযানকালে প্রায় ২০ লাখ জাল টাকার নোট ও দেড় লাখ ভারতীয় জাল রুপি জব্দ করা হয়। গ্রেফতাররা হলেন- জাহাঙ্গীর আলম, আলী হায়দার, তাইজুল ইসলাম লিটন ও মহসিন ইসলাম মিয়া। তাদের কাছে জাল টাকা ও রুপি তৈরিতে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, প্রিন্টার, বিভিন্ন রকমের কালি, স্ক্রিন ফ্রেম, বিশেষ ধরনের কাগজ, কেমিক্যাল, স্ক্যানার মেশিন, কাটার, স্কেল ইত্যাদি পাওয়া গেছে।
ডিবির তথ্যে জানা যায়, জাল টাকা ও রুপির একটি চালান সংগ্রহের জন্য নাটোর থেকে ঢাকায় আসেন জাহাঙ্গীর আলম। তাকে অনুসরণ করে ডিবি পুলিশ বেলা ১১টায় লালবাগের নবাবগঞ্জ বেড়িবাঁধে অভিযান চালায়। সেখানে নির্মাণাধীন ছয় তলা ভবনের চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটে পাওয়া যায় জাল মুদ্রা তৈরির কারখানা।
ডিবির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকার মানুষ তুলনামূলক সচেতন। তাই ঢাকার বাইরে জালনোটের কারবারিরা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। আমরা গত কয়েকদিনে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে জালনোটের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, শরীয়তপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও সিরাজগঞ্জে জাল টাকার বাণিজ্যের তথ্য পাওয়া গেছে। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও লালমনিরহাটে হয় জাল রুপির বাণিজ্য। এসবের সঙ্গে জড়িতের শতকরা ৯৯ জনই জামিনে বেরিয়ে আবারও একই কাজ করেন।’
ডিবি পুলিশের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ২৮৮ জনকে জালনোট কারবারে শনাক্ত করা হয়েছে। এ সময় জালনোট কারবারে জড়িত ৩০৬ জন গ্রেফতার হয়েছেন। এর মধ্যে মামলা হয়েছে ১৪৫টি। ১২৪টির চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে একটির ও তদন্ত চলছে ২০টি মামলার। ১৮ মার্চ রাজধানীর ডেমরায় জাল টাকা তৈরির কারখানা থেকে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন- ইমরান হোসেন, মিলন হোসাইন, ইলিয়াস মিয়া, সবুজ আহম্মেদ, সাইফুল ইসলাম ও আলিফ। ডিবি পুলিশসূত্র বলছেন, জাল রুপি আসছে পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে পণ্যের মোড়কে। এরপর জাল মুদ্রাগুলো পাঠানো হয় সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সেখান থেকে পাচার করা হয় ভারতে। শুধু এ চক্রে দেশে-বিদেশে অন্তত ৩০ জন সক্রিয় রয়েছেন। পুরো কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে পাকিস্তানের করাচি থেকে। ফজলুর রহমান নামে মুন্সীগঞ্জের এক ব্যক্তি সেখান থেকে জাল রুপির চালান পাঠান। এ চালান আসে শেখ আবু তালেব নামে ঢাকার এক ব্যবসায়ীর আমদানি পণ্যের সঙ্গে। এরপর ফজলুর রহমানের দুই ভাই ও এক ভগ্নিপতি এবং চক্রের অন্য সদস্যরা সেগুলো ভারতে পাচার করেন। এ চক্রে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন গাড়িচালকও রয়েছেন।
গাড়িচালক আমানউল্লাহ ভূইয়া, ব্যবসায়ী আবু তালেবসহ গ্রেফতার পাঁচজন ইতোমধ্যে ঢাকার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গত বছরের ২৬ নভেম্বর ৭ কোটি ৩৫ লাখ জাল রুপি জব্দের ঘটনায় রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় মামলা হয়। এর সূত্র ধরে ৭ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড থেকে নোমানুর রহমান খানকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি করাচিতে অবস্থানরত ফজলুর রহমানের ভাই। জিজ্ঞাসাবাদে নোমানুর স্বীকার করেন, তার ভাই বিভিন্ন সময় পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে মোজাইক পাথর, শুঁটকি ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর বস্তার মধ্যে ভারতীয় জাল রুপি বাংলাদেশে পাঠান। এরপর জাল রুপির একটি চালানের একাংশসহ তাদের আরেক ভাই সাইদুর রহমান, ব্যবসায়ী আবু তালেব ও ফাতেমা আক্তার নামে এক নারীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা থেকে হুন্ডি ব্যবসায়ী শাজাহানকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এ চালানের বাকি জাল নোট আমানউল্লাহ ভূঁইয়া-কাজলরেখা দম্পতির হাজারীবাগের মনেশ্বর রোড বাড়ির নিচতলায় রাখা হয়। সেখানে অভিযান চালিয়ে আমানউল্লাহ ও তার শ্যালক ইয়াসির আরাফাত ওরফে কেরামতকে আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১২ লাখ ভারতীয় জাল রুপি জব্দ করা হয়। আমানউল্লাহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সুনামগঞ্জ জেলার গাড়িচালক। পরে আবার ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে ৩ লাখ জাল রুপিসহ কাজলরেখাকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় হাজারীবাগ থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে। গত ছয় বছরে ডিবি ভারতীয় জাল মুদ্রাসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে। এদের অন্তত ছয়জন পাকিস্তানি।
পুরান ঢাকার জালনোটের কারখানায় যা পায় ডিবি : কারখানার মূল পরিচালক লিটন। তিনি নিজে মেকার। শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। দীর্ঘদিন নীলক্ষেত এলাকায় কম্পিউটারের দোকানে গ্রাফিক্সের কাজ করায় বিভিন্ন ধরনের জাল কাগজপত্র, দলিল, জাল টাকা ও রুপি তৈরি রপ্ত করেন। লিটন বিশেষ ধরনের কাগজ কিনে তা জোড়া লাগানো, একটি কাগজে বঙ্গবন্ধু, গান্ধীর ছবি স্ক্রিন প্রিন্টিং/জলছাপ দেওয়া ও রঙের সমন্বয়ের কাজ করেন। জাল টাকার নিরাপত্তা সুতা জোড়া লাগানো হয় আইকা বা অন্যান্য গাম দিয়ে। বঙ্গবন্ধু বা মহাত্মা গান্ধীর ছবি তিনি নিজে মূল টাকা থেকে স্ক্যানিং করে পেনড্রাইভে নিয়ে রাখেন। নিরাপত্তা সুতা তৈরির জন্য ডায়াস কিনে আনেন। জলছাপ দেওয়া হলে দুটি বিশেষ ধরনের কাগজ একসঙ্গে জোড়া দিয়ে শুকিয়ে এরপর টাকা প্রিন্টিংয়ে দেন। এসব কাজে সহযোগিতা করেন আলী হায়দার। প্রতি লাখ জাল নোট ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। জাহাঙ্গীর ও মহসিন মূলত লিটনের কাছ থেকে জাল নোট কিনে নিয়ে সচরাচর ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা লাভে বিক্রি করেন। জাহাঙ্গীর নওগাঁ, নাটোর, বগুড়াসহ দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের অনেক ডিলারের মাধ্যমে বিক্রি করেন। শহরের ব্যস্ততম এলাকায় রেস্টুরেন্ট, ভোজ্যসামগ্রী, প্রসাধন, পরিধেয় বস্ত্র ইত্যাদি কেনাবেচার সময় ভালো টাকার ভিতরে জাল নোট ঢুকিয়ে দেন।
এক চক্রের হাতেই জাল মুদ্রার বাণিজ্য : একটি আন্তর্জাতিক সংঘবদ্ধ ভারতীয় জাল মুদ্রা পাচারকারী চক্রের দুজনকে ২৬ নভেম্বর গ্রেফতার করে রাজধানীর খিলক্ষেত থানা পুলিশ। ওই দুজন হলেন- ফাতেমা আক্তার অপি ও শেখ আবু তালেব। বাংলাদেশি ফাতেমা পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ দানিশের স্ত্রী। ১০ বছর আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন দানিশ ও ফাতেমা আক্তার অপি। ফাতেমা গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে দানিশ সিন্ডিকেটের ফের খোঁজ পাওয়া গেছে।
২৩ নভেম্বর গ্রেফতার তালেব জব্দ করা ভারতীয় জাল মুদ্রা ফাতেমার কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। তালেব পাকিস্তানি নাগরিক সুলতান ও শফির মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে এসব জাল মুদ্রা শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। ফাতেমার বিরুদ্ধে জাল টাকাসংক্রান্তে মতিঝিল থানায় মামলা রয়েছে। প্রসঙ্গত, ১০ বছর আগে ২০১০ সালের ১৮ জানুয়ারি ডিবি পুলিশের হাতে ১০ লাখ জাল ভারতীয় রুপিসহ গ্রেফতার হন দুই পাকিস্তানি নাগরিক দানিশ, সাব্বির আলী ও দানিশের স্ত্রী বাংলাদেশি ফাতেমা আক্তার। ২০০৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর রুবিনা হোসাইন নামে এক পাকিস্তানি নারীকে ভারতীয় মুদ্রাসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রায় চার বছর আগে সেই দানিশের দুই সহযোগী জাল রুপিসহ ডিবির হাতে ধরা পড়েন। ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর আদাবরের মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ের ১১ নম্বর সড়কের ১৫/১ নম্বরের একটি ভবনে জাল মুদ্রা তৈরির কারখানার সন্ধান পায় ডিবি। সেখানে যাবতীয় মালামাল জব্দসহ জাল নোট সিন্ডিকেটের বুলবুল আহাম্মদ, খাইরুল ইসলাম, শামসুল হক, শাহীন আক্তার ও আলমগীর হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে পাকিস্তানি নাগরিক দানিশের ঘনিষ্ঠ সহযোগী খাইরুল ও শামসুল। দানিশ হাতে কলমে তাদের জাল নোট তৈরি শিখিয়েছেন বলে ডিবির তৎকালীন কর্মকর্তারা জানান।