6.1 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

পাখি

পাখি
ছবিজিয়া সাইদ

পূর্বজন্মে যদি বিশ্বাস করতাম তাহলে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারতাম আমি আগের জন্মে একটি সুশ্রী পাখি ছিলাম। যে পাখিটিকে দেখে মানুষ মুগ্ধ হতো। কবির ইচ্ছে হতো আমাকে নিয়ে কবিতা লিখতে। গায়ক আমাকে নিয়ে গান গাইতো। আর আমি আনন্দচিত্তে ডানা মেলে এ ডাল থেকে সে ডালে ঘুরে বেড়াতাম। মনে মনে ভাবি যদি পরজন্ম বলে কোনো জিনিশ থাকে তাহলে নির্ঘাত আমি পাখি হয়ে জন্মাবো। তা না-হলে পাখি নিয়ে এত চিন্তাভাবনা পাখিদের প্রতি এত ভালোবাসা কেন হবে আমার? অনেক সময় এমনও হয়েছে বাইরে আঙিনাতে বসে আছি। উপভোগ করছি সন্ধ্যা নেমে আসার দৃশ্যটি। পাখিদের তখন ঘরে ফেরার সময়। পাখিরা দল বেঁধে নীড়ে ফিরছে। সেটাও দেখার মতো একটা দৃশ্য। হঠাৎ করে একটা পাখি দলছুট অবস্থাতে ছোটাছুটি করছে উদ্বিগ্ন চোখ নিয়ে, একবার গাছের উপরে উড়ে বসছে, আবার নিচে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে তার সাথী পাখিকে ডাকছে তার নিজেদের ভাষাতে, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না। সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। মনটা আমার ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো, বুঝতে পারছিলাম না, কী করে আমি পাখিটিকে সাহায্য করতে পারি। অবশেষে সাথী পাখিটি ফিরে এলো তার সাথীর কাছে। তারপর দুজন একসাথে উড়ে চলে গেলো নিজেদের নীড়ে। সেদিন খুব ভালো লেগেছিল তাদের স্বার্থহীন ভালোবাসা দেখে। এই দৃশ্য শুধু একবার নয় বেশ অনেকবারই দেখেছি আমি।

পাখি জাতিটা আমার অনেক প্রিয়। পাখি নিয়ে আমার ভালোবাসার, গবেষণার শেষ নেই। একেক সময় আপ্লুত হয়েছি নানারকম পাখি দেখে। সেদিন কোথায় যেন টুনটুনি পাখির কথা পড়ে চমকে উঠেছিলাম। টুনটুনি পাখি নামে যে পৃথিবীতে কোনো পাখি আছে সেটাই যেন ভুলে গিয়েছিলাম। ভাবতে শুরু করলাম টুনটুনি পাখি নিয়ে। পাখির প্রতি ভালোবাসার যথেষ্ট কারণ আছে আমার। আমাদের ছোটবেলা বড় বেলা সব বেলাতেই ছিল আমাদের পাখির সাথে বসবাস। টিয়া পাখি, ময়নাপাখি, ঝাঁকে-ঝাঁকে কবুতর, তিতিরপাখি আর হাঁস, মুরগীকে যদি পাখির আত্মীয়-স্বজন ভাবা যায়-ওরা তো অর্ধ শত আমার বাবা-মায়ের কৃপাতে ঘর বাড়ি বানিয়ে বসবাস করতো। তাদের সবার সাথে মিলিত হয়েছিল এক পা ভাঙা একটা বকপাখি। তার আগমন যে কোথা থেকে হয়েছিল মনে নেই। বকটি নির্ভয়ে তার একটা পা নিয়ে সব ঘরে ঘুরে বেড়াতো। বক পাখিটি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ছিল বলে তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা ছিল অগাধ। সে সুযোগের অপব্যবহার করে বকটি আমাদের ঘরে টয়লেটের কাজটা সেরে ফেলতো।

- Advertisement -

টরন্টোতে আমার বাড়ির আঙিনাতে একদিন কাকের ডাক শুনে ছুটে গিয়েছিলাম কাকটিকে দেখতে। এই কর্কশ কণ্ঠের পাখিটিকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভেবে আনন্দিত হয়েছিলাম কাকেরা ক্যানাডাতে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আহা রে কতদিন কোকিলের ডাক শুনি না। মনটা কোকিলের ডাক শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। সেই কোকিলের গান প্রাণ ভরে শোনার সুযোগ হলো হওয়াই এর মাওয়াই দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে।

২.
সময়ের ব্যবধানের জন্য অনেক ভোরে ঘুম ভেঙে গেলো। আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে হোটেল রুমের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। উঁচু উঁচু পাম ট্রি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পাম ট্রি দেখতে অবিকল তালগাছের মতো। মনে হয় ওরা এক-ই পরিবারের চাচাতো ভাই-বোন। আমি নিজের মনে বলে উঠলাম,’ তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি দেয় আকাশে।’ চারপাশ থেকে ভেসে আসছে পাখির কলরব। একটি কোকিল কোনো একটি গাছে বসে বেসুরো গলাতে গান গেয়ে চলেছে। মনে হয় কোকিলের কোনো দূর সম্পর্কের আত্মীয় হবে। কোকিলটি ভোর থেকে শুরু করে বেলা নয়টা পর্যন্ত গান গেয়ে গেলো ক্লান্তিহীনভাবে। তার সাথে তার সখা সখীরাও সুর মিলাচ্ছে।

রুমের বাইরে কফি হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসলাম। পাঁচতলা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখলাম ঘুঘু পাখিদের চলাচল। একটি ঘুঘুকে দেখলাম আরেকটি ঘুঘুর ঠোটে ঠোট রেখে চুমু খেতে। ধরে নিলাম একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ঘুঘু হবে। কারণ পাখিদের সমকামী হওয়ার কথাটি এখনো কেউ আবিষ্কার করেনি। প্রকৃতির নিয়মে ছেলে ঘুঘুটি ভালোবাসলো মেয়ে ঘুঘুটিকে। ভালোবাসা শেষ করে ছেলে ঘুঘুটি মেয়ে ঘুঘুটির উপর থেকে নেমে সদর্পে হাঁটতে শুরু করলো আর মেয়ে ঘুঘুটি হেলেদুলে ছেলে ঘুঘুটির পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলো। বিস্মিত হয়ে দেখলাম পাখিদের মাঝেও পুরুষত্বের দম্ভ।

আমাদের আজকের পরিকল্পনা সমুদ্র সৈকতে যাবো। যদিও আমরা বসে আছি প্রশান্ত মহাসাগর ঘেরা দ্বীপে। আজ ভেবেই গেলাম শুধু পা ভেজাবো, গা ভেজাবো না। পা ভিজিয়ে হেঁটে বেড়ালাম সৈকতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সূর্য ততক্ষণে মাথার ওপর প্রচণ্ড আক্রোশে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের পর ঢেউ আমার পা দুটো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার নিজেকে মনে হচ্ছিল চঞ্চলা কিশোরী। ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই সমুদ্রের বুকে।

কিছুক্ষণ পর সূর্যের তাপে অস্থির হয়ে সৈকত ছেড়ে ওপরের দিকে উঠে এলাম। ছায়া সুনিবিড় জায়গাটি। বিশাল গাছগুলি উদারভাবে ছায়া বিলিয়ে যাচ্ছে। আমিও একটি গাছে হেলান দিয়ে বসলাম। একটি শালিকপাখি উড়ে এসে ঠিক আমার পাশটিতে এসে দাঁড়ালো। তারপর দুটি তিনটি করে একঝাক শালিক এসে জড়ো হলো একই জায়গাতে। মনে মনে ভেবে নিলাম আজ হয়তো শালিকদের জরুরি সভা। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেলো। এক শালিকে দুঃখ, দুই শালিকে আনন্দ, তিন শালিকে চিঠি, চার শালিকে অতিথি। কথাগুলো শুধু বলতাম না, মনে প্রাণে বিশ্বাসও করতাম। আজ একঝাঁক শালিক আমার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে, আজ কী ভাববো জানি না। ছোটবেলাতে এক শালিক দেখলে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যেতো, ভেবে নিতাম আজ নির্ঘাত দুঃখের কিছু একটা ব্যাপার ঘটে যাবে। দুই শালিক দেখলে খামাখাই মন আনন্দে নেচে উঠতো, কী জানি কী আনন্দ বার্তা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তিন শালিকের চিঠির ব্যাপারটা মোটামুটি সঠিক হতো, যদিও আমার কোনো চিঠি কখনো আসতো না, কিন্তু ডাকপিওন কোনো না কোনো চিঠি নিয়ে এসে ‘চিঠি আছে চিঠি’ বলে হাঁক দিতোই। আর চার শালিকের ব্যাপারটা ছিল পাক্কা সত্যি কারণ সে সময়ে বাড়িতে অতিথিদের আনাগোনা ছিল নিয়মিত। কাজেই ছোটবেলাতে শালিক বেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আমাদের জীবনে।

এত কাছ থেকে আমি কখনো শালিক পাখি দেখিনি। মানুষ কেন বলে হরিণচোখ কেন বলে না শালিকচোখ। আজ যেন শালিকের চোখ আবিষ্কার করলাম নতুনভাবে। শালিকের চোখের চারপাশে যে এত সুন্দর করে শৈল্পিকভাবে হালকা হলুদ রঙে আঁকা তা তো কখনো দেখিনি। শালিকের হলুদ পা নিয়ে কতো লেখা, তাহলে শালিকের চোখ নিয়ে কেউ কিছু লেখেনি কেন? হয়তো লিখেছে আমি পড়িনি।

আজ সারাটা দিন গেলো নানারকম পাখি ভাবনাতে। তারপরে আরো দশদিন কাটালাম মাওয়াই দ্বীপে বিভিন্ন জায়গাতে ঘোরাঘুরি, নানারকম অভিজ্ঞতা বিভিন্ন সুন্দর জিনিশে চোখ জুড়িয়ে। তবে সে দশদিন কোকিলের বেসুরা গান নয় বরং অসম্ভব সুরেলা কণ্ঠের সকাল বিকেল গান শুনে মুগ্ধ হলাম, মনে হলো এ যেন এই দ্বীপের কোকিলদের দায়িত্ব সকাল বিকেল সবাইকে গান শুনিয়ে মুগ্ধ করা। আমিও সে মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে এলাম।

ম্যাল্টন, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles