2.4 C
Toronto
শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪

পর্ন তারকাকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ কতটা গ্রহণযোগ্য?

পর্ন তারকাকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ কতটা গ্রহণযোগ্য? - the Bengali Times

গত কয়েকদিন ফেসবুকের পাতা জুড়ে যেসব বিষয় তোলপাড় হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম সানি লিওনের বাংলাদেশে আগমন ও বিয়ের অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন। আরেকটি আলোচ্য বিষয় ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে সেনোরিটা গানের সঙ্গে নারী ও পুরুষের নাচের দৃশ্য।

- Advertisement -

এই ২টি ভিডিওকে কেন্দ্র করে সমাজের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন জন বিভিন্ন ধরনের মতামত দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। সানি লিওনকে আমরা চিনি পর্ন তারকা হিসেবে। তার সম্পর্কে এভাবেই লেখা হতো, দেখানো হতো। কে পর্নোগ্রাফি দেখবেন এবং কে দেখবেন না, এটা তাদের নিজস্ব পছন্দ। এটা একটা ইন্ডাস্ট্রি, বলতে গেলে দুনিয়ার প্রথম সারির ইন্ডাস্ট্রি। তবে এই ইন্ডাস্ট্রি শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।

সানি লিওন বাংলাদেশে পা দিতে পারবেন না, সরকারের উঁচু পর্যায় থেকে এ কথা বলার পরেও তিনি এসেছেন এবং একটি জমকালো পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। সানি লিওনের জীবন, ব্যবসা এসব নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছু বলার নেই। যৌন ব্যবসা এমন একটি ব্যবসা, যা আইনসিদ্ধ এবং বহু পুরুষ যৌনকর্মীদের কাছে যান, তাদের ছবি দেখেন, পর্ন মুভি দেখেন, তাদের সঙ্গে সময় কাটান। সেখান থেকে বের হয়ে এসে হয়তো সেই মানুষটিই নীতি-নৈতিকতার কথা বলেন।

অবশ্য পর্নোগ্রাফি নিয়ে যদি আমরা নৈতিকতার প্রশ্ন তুলি, তাহলে আমাদের বলতে হয় ঘুষ খাওয়া, দুর্নীতি করা, অন্যের সম্পত্তি মেরে খাওয়া, চুরি করা, প্রলোভন দেখানো, মিথ্যা বলে মানুষের ক্ষতি করা সবই অনৈতিক। আর এর চেয়েও বড় অপরাধ ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, নারী-শিশু নির্যাতন, বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন না করা ইত্যাদি। এ রকম অপরাধ ও অনৈতিক কাজ আমরা এ দেশে হরহামেশা দেখছি।

সেগুলো সম্পর্কে ঘৃণা প্রকাশ না করে শুধু একজন পর্ন তারকাকে ছোট করে নানা ধরণের মন্তব্য আমরা করছি। এই বিদ্বেষকে বলে সেক্সিজম বা যৌনবাদ। কাজেই সানি লিওনের পেশা নিয়ে কথা না বলে আমরা একটু অন্যদিকে দৃষ্টি দিতে পারি।

যেমন সানি লিওন যতদিন পর্যন্ত শুধু পর্ন জগতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তখন তার মেলামেশার ক্ষেত্র ছিল ভিন্ন। কিন্তু যখন তিনি সামাজিকতা ও ঘরোয়া সংস্কৃতিতে অ্যাডাল্ট এন্টারটেইন্টমেন্ট নিয়ে হাজির হবেন, তখন সমাজের অনেকেই, বিশেষ করে কিশোর-তরুণ ও যুব সমাজ একটা ভুল বার্তা পাবে।

ইতিহাসে এবং সব সমাজে যৌন কর্মীদের শহরের বাইরে বা আলাদা পাড়ায় বিচ্ছিন্ন রাখা হতো এবং হয়। পশ্চিমের দেশগুলো ছাড়াও ব্যাংকক, ভারত, বাংলাদেশসহ সব দেশেই এই পেশাজীবীদের আলাদা পাড়ায় রাখা হয়। এর কারণ ঘৃণা নাও হতে পারে। হয়তো সমাজের শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মূল্যবোধের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এমনটা করা হয়।

পর্ন তারকা কিংবা যৌনকর্মী এমন একজন যাকে ঘরে বসে একা একা দেখা যায় কিংবা তার সঙ্গ উপভোগ করা যায়। কিন্তু সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের প্রবেশ নিয়ে এখনো মতভেদ আছে। বড়দের বিশেষ ধরণের বিনোদনের জন্য তারা যেমন যৌন উদ্দীপনামূলক নাচ, দেহ প্রদর্শন ও দেহের অবজেক্টিফিকেশন করে, সেই একই ধরণের পোশাক পরে, নাচ ও মুদ্রা প্রদর্শন করে যখন তারা সামাজিক অনুষ্ঠানে নাচে-গায়, তখনই আপত্তির প্রশ্নটি আসে। যেমনটা এসেছে সানি লিওনের ক্ষেত্রে।

প্রথমত বাংলাদেশের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে আইটেম গার্ল বা বয় হিসেবে নাচ-গানের জন্য কেন বাইরে থেকে শিল্পী ভাড়া করে আনতে হবে? দেশে কি তারকার অভাব পড়েছে? যদি আনতেই চাই তাহলে কেন একজন সাবেক পর্ন তারকাকে পারিবারিক অনুষ্ঠানে আনতে হলো? এটা কি শোবিজ, কোনো ক্লাবের প্রোগ্রাম বা ব্যবসায়িক কোনো আয়োজন? এটা ছিল বিয়ে বাড়ি।

সব সমাজই পর্ন তারকার জীবনকে সাধারণ মানুষের জীবন বা সমাজ থেকে আলাদা করে রাখতে চায়। সানি লিওনকে এখানে একটি মুক্ত পারিবারিক অনুষ্ঠানে এনে আমরা কি আমাদের শিশু কিশোর ও যুব সমাজের কাছে এই বার্তা দিলাম না যে পর্ন জগতে জড়িয়ে আবার স্বাভাবিকতায় ফিরে আসা যায়? এটা তাদের জীবনকে নেতিবাচক দিকে টেনে নিতে পারে।

ইতোমধ্যেই দেশে পর্নোগ্রাফির বিস্তার ও ভয়াবহতা সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যাচ্ছে। শিশুসহ অল্পবয়সী মেয়েরা কিভাবে এই ব্যবসার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে সেই তথ্যও আসছে। ঠিক এ রকম একটি সামাজিক পরিস্থিতিতে সানি লিওনের মতো আলোচিত পর্ন তারকাকে সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসাটা কতটা ন্যায্য হয়েছে?

আমাদের উচিৎ বড়দের জন্য এই বিশেষ বিনোদন, তার কনটেন্ট ও তাদের কলাকুশলীদের সুস্থ বিনোদন ও সাধারণ তারকাদের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলা এবং শিশু-কিশোরদের নাগালের বাইরে রাখা।

দেশে এখন যেসব গান-নাচ চালু হয়েছে, যা ভাইরাল হচ্ছে, টিকটক-লাইকির মতো অ্যাপ ব্যবহার করে তরুণ-তরুণীদের ডিজে পার্টির যে নাচ গান, এর কোনোটাই সুস্থ সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে না। আমাদের উচ্চশিক্ষা, রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, পেশা, নাটক, চলচ্চিত্র সব কিছুই এখন নিম্নগামী। প্রযুক্তির অপব্যবহার একটি প্রজন্মকে ভয়াবহ বিপদের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে বিয়ে বাড়িতে সানি লিওনের আবির্ভাব সেই বিপদ আরও বাড়াবে, কমাবে না।

জানা যায়, বেশিরভাগ নারী পর্ন তারকা অল্প বয়সে নিজের জীবনের এক দুর্বল মুহূর্তে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে এই ইন্ডাস্ট্রিতে জড়িয়েছেন। এরপর তারা অনেকেই বের হয়ে আসতে চেয়েছেন। এই পথে টাকা উপার্জন ছেড়ে অন্য কিছু করতে চেয়েছেন। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়েছেন। অনেকে মাদকাসক্ত হয়েছেন এবং অনেকে হারিয়ে গেছেন।

সানি লিওন অবশ্য এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। এই জগত থেকে ফিরে এসে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে স্থান করে নিতে পেরেছেন। এমনই স্থান করে নিয়েছেন যে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশের বিয়ের অনুষ্ঠানে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে তাকে অতিথি করে আনা হলো।

তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যখন অসংখ্য কমবয়সী ছেলে-মেয়েরা নাচল, তখন দেখা গেল যৌনভাব ও সংকেতের অযৌনকরণ। যার ফলে অযৌন পারিবারিক ও সামাজিক আসরও হয়ে গেল যৌনমুদ্রা ও যৌনভাব সংকেত প্রদর্শনের স্টেজ। বিয়ের আসর, হলুদের আয়োজন কি এ ধরণের দৃশ্যায়নের জন্য তৈরি হয়?

পর্ণ তারকার সামাজিকীকরণের মাধ্যমে সমাজের উঠতি ছেলে-মেয়েদের কাছে যে বার্তা যায়, তাতে তারা ঠাহর করতে পারে না যে কোনটা যৌনমুদ্রা ও যৌনভাব আর কোনটা অযৌন শিল্পকলা বা নিছক আনন্দ।

এমনিতেই বাংলাদেশে পরিবারগুলো হয়ে পড়েছে হিন্দি সংস্কৃতি নির্ভর। সমাজ হয়ে যাচ্ছে টিকটক ও লাইকি নির্ভর। আশঙ্কা হয়, এভাবে চলতে থাকলে দেশের সংস্কৃতি পরিচিত হবে কিশোর গ্যাং, টিকটক হৃদয়, আমি অপরাধী, হিরো আলম, কাকলি ফার্নিচার এবং হয়তো বা সানি লিওন দিয়ে।

এবার আসি আরেকটি প্রসঙ্গে। কেন এই রকম একটি বিয়ের নাচের অনুষ্ঠানে মুজিবকোটকে ড্রেস কোড করা হলো? বিয়ে বা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী ও কালো মুজিবকোট পরার মানে কী? সানি লিওনের পেছনে একদল মানুষ যখন মুজিবকোটের মতো পোশাক পরে নাচলো, তখন অনেকেই বলে উঠলো আওয়ামী লীগের কোনো অনুষ্ঠানে সানি লিওন নাচছে। এটিকে ভয়াবহ অপরাধ বলেই মনে করছি। কারণ মুজিবকোট আমাদের ইতিহাস ও আমাদের পরিচয়ের অংশ।

সবশেষে আসি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাগ ডে উপলক্ষে সেনোরিটা গানটির সঙ্গে যুগল নাচের প্রসঙ্গে। নাচটি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তাদের একটা অংশ সাহসিকতার জন্য এই যুগলকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন। আবার আরেকটি অংশ মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ ধরনের নাচ ঠিক হয়নি।

কোন উৎসবে কী নাচ, গান বা নাটক হবে, সেটা সেই উৎসবের স্থান, কাল, পাত্র বা দর্শক ভেদে নির্ধারণ করতে হয়। আমার জাহাঙ্গীরনগরের বন্ধুদের কেউ কেউ বলল, এই আয়োজনে আশেপাশের গ্রামবাসী, আমজনতাসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ ছিলেন। তাদের অনেকে ছাত্রছাত্রীদের এই নাচ নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করছিল। অবশ্য এ রকম বাজে মন্তব্য কিছু মানুষ সবসময়ই করে থাকে।

সমস্যা হচ্ছে সেই নোংরা মানসিকতার মানুষগুলো যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের এভাবেই দেখতে থাকে এবং ভবিষ্যতে ছাত্রীদের অসম্মান করার দুঃসাহস দেখায়, তখন সেটা হবে খুবই অনভিপ্রেত।

তাই দর্শক-শ্রোতা ও স্থানের চরিত্র নির্ধারণ করে নাচ-গান নির্বাচন করা উচিৎ বলে আমার ব্যক্তিগত মত। নারীর স্বাধীনতা আমি শতভাগ চাই, চাই নারী তার ইচ্ছামতো উড়ে বেড়াক, দাপিয়ে বেড়াক চারিদিকে। কিন্তু চাই না, কোনো অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে নারীকে অসম্মান ও হেনস্থা করা হোক।

সূত্র : নতুন সময়

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles