
পুরো নাম এস. এম. সাখাওয়াৎ হোসেন। লোকে তাকে শওকত সাহেব, সাখায়েত সাহেব, সাকা ভাই বলে ডাকে। কারো বা তিনি খালুজান, কারো হন মামা অথবা চাচা। এত ডাকের মধ্যে যে ডাকটা তিনি বেশি পছন্দ করেন সেটা হলো নানা-ভাই। কত মানুষের যে তিনি নানা হন তা হয়তো তিনি নিজেও জানেন না। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকটিই হলো আমার প্রিয় মানুষ।
আমার প্রিয় মানুষের সাথে আমার রয়েছে এক অদ্ভুত সম্পর্ক। আমরা কেউ কারো দিকে কখনও চোখ তুলে কথা বলতাম না। তিনিও লজ্জা পেতেন, আমিও। চোখে চোখ রেখে কথা না বলাটাকে হয় লজ্জা না-হয় অতি ভালবাসা বলে মনে হতো। এমনও অনেক সময় গেছে যখন আমরা দু’জন ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যক্তি উপস্থিত ছিল না কিন্তু কথা বলতাম তৃতীয় ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে। যেমন ছিল আমার প্রশ্ন, তেমনি ছিল তাঁর উত্তর। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে না-পারার কারণ আমার জানা নেই। সম্ভবত কোনদিনই জানতে পারবো না। এ বোধহয় সম্পূর্ণ এক ব্যতিক্রমী বন্ধন।
আমার প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে কত কথাই না বলতে পারি, প্রশ্ন হলো, কোনটা রেখে কোনটা বলি। একান্ত ব্যক্তিগত কথাগুলো তো আর বলা যাবে না, সকলের কাছে বলা যায় তেমন দু’একটা বললে দোষেরও কিছু হবে না।
যে লোকটি আমার এত প্রিয় সেই লোকটির আবার প্রিয় লোক ছিল বঙ্গবন্ধু। একই স্কুলে পড়তেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন উপরের ক্লাসের ছাত্র। তাই তাঁকে মুজিব ভাই বলতেন। এই মুজিব ভাইকে নিয়ে তাঁর প্রায় কয়েকশত কথা আমার জানা আছে। আওয়ামী লীগের কিংবা বঙ্গবন্ধুর আপন কেউ মারা গেলে বঙ্গবন্ধু বলতেন ‘সাকারে খবর দাও’। আমার স্পষ্ট মনে আছে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মারা গেলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
দেশ স্বাধীন হলে (বঙ্গবন্ধু তখনো দেশে ফিরে আসেননি) তিনি গেলেন বেগম মুজিবের সাথে দেখা করতে। তাঁর সাথে দেখা করে ফিরে এসে বর্ণনা করলেন কেমন হলো সাক্ষাৎকার। তিনি বললেন, ভাবী বললো, “মরতে তো ভয় পেতাম না। পাকিস্তানীরা মেরে ফেললে করার কিছু ছিল না কিন্তু মনে মনে দুঃখ পেতাম সাকা-ভাইয়ের হাতে মাটি তো পাবো না।” সেদিন বেগম মুজিবের কথাগুলো বলতে গিয়ে তিনি চোখে পানি রাখতে পারেননি। আমি দূরে দাঁড়িয়ে তাঁর চোখ থেকে গড়িয়ে-পড়া ভালবাসা দেখেছি। আমি এক ভালবাসার সাক্ষী হয়ে আছি।
আজ সেই ‘সাকা-ভাইয়ের’ পাকস্থলীর চর দখল করে নিয়েছে সর্বনাশা রোগ। দিনে দিনে মৃত্যুর পয়গাম ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর শরীরের সর্বত্র। অবশ হয়ে যাচ্ছে তাঁর হাত পা। নিস্তেজ হয়ে আসছে চোখের চাহনি। কাছের লোকের দিকে এমনভাবে তাকান যেন অনেক দূরের কাউকে চেনার চেষ্টা করছেন। আমার এই প্রিয় মানুষটি এখন একা একা হাঁটতেও পারেন না। দু’দিক থেকে দু’জন ধরে ধরে তাঁকে হাঁটায়। ‘সাকা ভাইয়ের হাতের মাটি’ কথাটি কত মায়াবী !
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়েছিলাম নিরাপদ আশ্রয় নিতে এবং যোদ্ধা হতে। আমাদের দলের প্রধান আকর্ষণ ছিল আমার প্রিয় মানুষটি। তাকে হাতে পেলে পাকিস্তানীরা সোনার কলস পেয়ে যেত। এত বড় শিকারে হায়েনারা দাঁতে মুখে রক্ত মাখিয়ে ভারতনাট্যম করতো। আমরা তাই সবসময় একটা আতঙ্কে থাকতাম তাঁর জন্য শেষে পুরো দলটা না শক্র“র থাবায় পড়ে যায়। আমার প্রিয় মানুষটারে ঘিরে সেই যুদ্ধকালীন সময়ের দু’টি কথা শোনাতে ইচ্ছে করছে।
প্রথমটি হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারত যাত্রার একটি ঘটনা। একদিন খুব ভোরের দিকে হাঁটু পরিমাণ কাদার ভেতর দিয়ে সারারাত চলতে চলতে একটি গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম। সম্ভবত যশোরের কোন এক গ্রাম ছিল সেটা। সেই গ্রামের মানুষ রাস্তার দু’দিকে হারিকেন, কুপি জ্বালিয়ে ছোটখাটো দোকান সাজিয়ে বসেছিল। এই গ্রামটার উপর দিয়ে তখন কয়েক হাজার শরণার্থী প্রতিদিন ভারতে যেত। সেই সমস্ত খুচরো ব্যবসায়ীরা রাতারাতি বড়লোক হয়ে না গেলেও তাদের দিন মন্দ যাচ্ছিল না। এমন এক রুটি-গুড় দোকানীর কাছে আমরা তিন চারজন কিছু খাব ভেবে বসে পড়লাম। আমার প্রিয় লোকটি দোকানীকে প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা ভাই, এখানে কোনো মসজিদ আছে ?’ দোকানী বললো ‘হ্যাঁ আছে’ তারপরে সে হাতের ইশারায় কোনদিকে গেলে মসজিদটি পাওয়া যাবে বলে দেয়। তিনি মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে না আসা পর্যন্ত আমাদেরকে দোকানীর সাথে কথা চালিয়ে যেতে হলো। দোকানী বললো, প্রতিদিন এত লোক এই পথ দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই প্রথম কেউ মসজিদের কথা জিজ্ঞেস করলো। আজো আমি দোকানীর সেই কথাটি ‘এই প্রথম কেউ…’ মনে করে রেখেছি। কেননা সেই বিপদের দিনে আমি আল্লাহুর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম তোমার এক ফরেজগার বান্দা আমাদের সাথে আছে, আমাদের যাত্রা তার উছিলায় নিরাপদ করে দিও। আমি সেই সমস্ত ভাগ্যবান ব্যক্তিদের মধ্যে একজন স্বয়ং আল্লাহ যার একটি প্রার্থনা কবুল করেছিলেন।
দ্বিতীয় ঘটনা, আমাকে একবার কোলকাতা যেতে হয়েছিল দাঁতের চিকিৎসার জন্য। শ্রী রাধা কিশোর ঘোষ আমাকে ক্যাম্প থেকে তাঁর সাথে কোলকাতা নিয়ে গিয়েছিলেন। শ্যামবাজারে তাঁর একটা ভাড়া বাসা ছিল। গ্রাম থেকে কোলকাতা এসে তিনি এখানে এসে উঠতেন। যুদ্ধের সময় সেই বাসাটি দিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশী কয়েকটি ছেলেকে যারা কোলকাতায় বিভিন্ন কাজ করতো এবং যাদের থাকার কোন জায়গা ছিল না। শুধু কোলকাতার বাসাটি নয়, ঘোষ বাবুর জমিদারি অঞ্চলটি অর্থাৎ তাঁর গ্রামের বাড়িঘর, স্কুল, মন্দির, পুকুর ঘাট যেখানে ছিল সেখানে গড়ে উঠেছিল মুক্তিবাহিনীর বিখ্যাত এক ক্যাম্প, যার নাম বাকুন্ডিয়া ক্যাম্প। বাবুর শ্যামবাজার বাসাটিতে যে সমস্ত ছেলেরা থাকতো তাদের একজনের নাম ছিল মতিন। একদিন ঢাকার কিছু ছেলে এলো মতিনের সাথে দেখা করতে। মতিন নিজে ঢাকার ছেলে ছিল না। সেই ছেলেগুলোর সাথে বাবু আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, “এই ছোট্ট ছেলেটি তোমাদের ঢাকার ছেলে।” ওদের মধ্যে কে যেন জিজ্ঞেস করলো ঢাকাতে তোমাদের বাসা কোথায় ? আমি বললাম গ্রিন রোডে। ওরা জিজ্ঞেস করলো, গ্রিন রোডে কোথায় ? আমি বললাম, ক্রিসেন্ট রোডে। বাবু আমাদের কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। তাদের একজন জিজ্ঞেস করলো, ক্রিসেন্ট রোডে থাকো, সাখাওয়াৎ সাহেবের বাসার কোনদিকে তোমাদের বাসা ? আমার বুক গর্বে ভরে গেল। এই মৃত্যুঝরা দিনগুলোতে শত শত মাইল দূরে অন্যদেশে অন্যর আশ্রয়ে আছি তবুও আমাকে চিনতে আমাকে জানতে যে লোকটির নাম বলা হলো, যার বাড়ির কথা বললে বুঝতে পারবে আমার ঠিকানা, সে লোকটি আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। খুশি আর গর্বে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। হাসি হাসি মুখ নিয়ে ঘোষ বাবুর মুখের দিকে তাকালাম। তাঁর মুখেও একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল। তিনিও চিনতেন আমার প্রিয় মানুষটিকে। বাকুন্ডিয়ার পাশের গ্রামটিতে মুক্তিবাহিনীর একটি নতুন ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। শাঁকচুড়া নামে সেই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন আমার প্রিয় মানুষটি। যার হাতে মাটি না পাবার আশঙ্কায় আফসোস করেছিলেন বেগম মুজিব। আর সত্যি সত্যি যখন বেগম মুজিবের কবরে দোয়া পড়ে এক মুঠো মাটি দেয়ার প্রয়োজন ছিল তখন তিনি এক মুঠো মাটি দিতে পারেননি বলে বাচ্চা ছেলের মত কেঁদেছিলেন। আজ তিনি নিজেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন মাটির স্বাদ নিতে।
ছেলেবেলা মুরুব্বীদের দোয়া করেতে শুনেছি এভাবে যে, “আমার মাথায় যত চুল আছে ততো বছর বেঁচে থাকো”। পড়ালেখা না-জানা ঐ সমস্ত নানী, দাদীর কথার মূল্য কতখানি ছিল জানি না। এত বছর কেউ বেঁচে থাকতে পারে কিনা তাও জানি না। আজ মনে হচ্ছে তাঁদের সেই দোয়া যেন সত্যি হয়। আমার প্রিয় মানুষটি যেন আমার মাথায় যত চুল ততগুলো বছর আরো বেঁচে থাকেন। দাদী, নানীদের দোয়া সত্যি না হলে আমি এতিম হয়ে যাবো। শ্যামবাজারের বাবুর বাসায় বসে ১৯৭১ সালে মতিন ভাইয়ের বন্ধুকে বুক ফুলিয়ে বলেছিলাম আপনি যে সাখাওয়াৎ সাহেবের কথা বললেন আমি তাঁর একমাত্র পুত্র সন্তান। আমার সেই ফুলে-থাকা বুক থেকে এক ঝাঁক দীর্ঘশ্বাস আকাশে উড়ে গেলে বড় কষ্ট পাবো। এতিম হওয়ার মধ্যে কোন সুখ নেই, শুধু বুকভরা কষ্ট আর কষ্ট।
স্কারবোরো, কানাডা