14.9 C
Toronto
শনিবার, মে ১৮, ২০২৪

চার স্বামীসহ ১২ জনকে খুন করেন যে সিরিয়াল কিলার

চার স্বামীসহ ১২ জনকে খুন করেন যে সিরিয়াল কিলার
ন্যানি তার দ্বিতীয় স্বামীকে হত্যা করেছিলেন ১৯২৯ সালে ছবি বিবিসি থেকে নেওয়া

তাকে ‘হাস্যময়ী ন্যানি’ সম্বোধন করলে কোনো ভুল হতো না। ভারী শরীরের এই ন্যানি সবসময় হাসতেন। কিন্তু সেই হাসির পিছনে ছিল আড়াই দশক ধরে করা অনেকগুলো খুনের ইতিহাস।

ন্যানি ডস একজন আমেরিকান নারী সিরিয়াল কিলার। তিনি ১৯২০ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে অন্তত ১২ জনকে খুন করেছিলেন।

- Advertisement -

১৯০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাব্যামা রাজ্যের এক কৃষক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জন্মের পর বাবা-মা তার নাম রেখেছিলেন ন্যান্সি হ্যাজেল। তার অপরাধের আনুষ্ঠানিক বিবরণীতে লেখা আছে, পাঁচ বছর বয়স থেকেই তাকে ‘ন্যানি’ নামে ডাকা হতো।

জেমস ও লুইসা হ্যাজেলের ছিল পাঁচ সন্তান, ন্যানিসহ সবাই বাড়িতে কাজ করতেন এবং কৃষিকাজ করতেন। জেমস প্রায়ই তাদের মাঠে কাজ করতে পাঠাতেন। এমন পরিস্থিতিতেও ন্যানি ও তার ছোট ভাইবোনরা সামান্য শিক্ষা লাভ করতে পেরেছিলেন।

পাম জোন্স নামে অ্যালাব্যামার অপরাধ বিশেষজ্ঞ গবেষণা করে দেখেছেন যে, জেমস হ্যাজেল বেশ বদরাগী ছিলেন এবং অনেক বকাঝকা করতেন। তিনি ন্যানির জন্মদাতা পিতা নাও হতে পারেন, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

জোন্স লিখেছেন, জেমস অন্য কিশোরদের সঙ্গে ন্যানিকে কোনো রকম যোগাযোগ করতে দিতেন না। মেয়েকে মেক-আপ করতে দেয়া, সুন্দর কাপড় পরা কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যাওয়ার সুযোগ- কোনটাই দিতে রাজি হতেন না জেমস। এমনকি গির্জার বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায়ও মেয়ের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তার পারিবারিক গল্প থেকে জানা যায়, ন্যানি রাতে লুকিয়ে যুবকদের সঙ্গে দেখা করতেন।

সাংবাদিক উইলিয়াম ডি লংয়ের মতে, কিশোরী বয়সে ন্যানি ভবিষ্যতে তার স্বামীর সঙ্গে একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতেন। তার অবসর সময় কাটত রোমান্স ম্যাগাজিন, বিশেষ করে ‘একাকী হৃদয়’ ধরনের কলাম পড়ে। সম্ভবত তার বাবার নানা কঠোর আচরণের কারণে তিনি এই রোম্যান্স ম্যাগাজিনেই আশ্রয় খুঁজতেন।

একের পর এক বিয়ে

জোন্স লিখেছেন, ১৬ বছর বয়সে ন্যানি চার্লস ব্রিগস নামে স্থানীয় টেক্সটাইল কোম্পানিতে কাজ নেন। কর্মস্থলেই এক সহকর্মীর প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। দেখা হওয়ার কয়েক মাস মধ্যেই তারা বিয়ে করেন। ছয় বছরের সংসার জীবনে অর্থাৎ ১৯২৭ সালের মধ্যে তাদের চারটি কন্যা সন্তান হয়।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ জোন্স ন্যানি সম্পর্কে চার্লসের বক্তব্য তুলে ধরেছেন, ‘ন্যানি সুন্দরী ছিলেন। তার সঙ্গে খুব ভালো সময় কেটেছিল। আমাদের দাম্পত্য জীবন খুব ভালোভাবে শুরু হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর পর ন্যানি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে।’

এই সুখী দম্পতি চার্লসের মায়ের সঙ্গে থাকতেন, যিনি তার বাবার মতোই ন্যানির সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন। সম্ভবত এ কারণেই তাদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছিল। যা ন্যানিকে তার প্রথম খুনের দিকে ধাবিত করেছিল।

নারী খুনিদের নিয়ে ‘ডেডলিয়ার দ্যান মেন’ বইয়ে টেরি ম্যানার্স লিখেছেন, ‘বিয়ের প্রথম কয়েক বছর ন্যানি ও তার স্বামী দুজনই মদে আসক্ত হয়ে পড়েন। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের দিকে ঝুঁকে যান। যে বছর তাদের কনিষ্ঠ কন্যা ফ্লোরেন্স জন্মগ্রহণ করে, তার মেঝো ও সেঝো কন্যা সন্দেহজনক খাদ্য বিষক্রিয়ায় অপ্রত্যাশিতভাবে মারা যায়।’

সে সময় দুটি মৃত্যুকেই আকস্মিক বা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বলে অভিহিত করা হয়। তবে পরিবারের সদস্য এবং পুলিশের ধারণা এই দুটি মৃত্যু মূলত ন্যানির কয়েক দশক ধরে চালানো ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের সূচনা ছিল।

দুই সন্তানের কবরের মাটি শুকানোর আগেই চার্লস তার বড় মেয়ে মেলভিনাকে নিয়ে কোথাও চলে যান। তখন ছোট ফ্লোরিন তার মায়ের সাথেই থাকত। এভাবে ১৯২৮ সালে ন্যানির প্রথম বিয়েটি বিচ্ছেদে গড়ায়।

চার্লস ১৯২৮ সালের শেষের দিকে মেলভিনা এবং তার নতুন স্ত্রীকে সাথে নিয়ে ফিরে আসেন। তখন ন্যানি তার দুই মেয়েকে নিয়ে তার বাবা-মায়ের কাছে চলে যান। নিজের ও তার সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য স্থানীয় একটি তুলা কলে কাজ করা শুরু করেন। তাই চার্লস ভাগ্যবান যে তার জীবন রক্ষা পেয়েছিল।

জোন্স লিখেছেন, দ্বিতীয় স্বামীর সন্ধানে ন্যানি এক নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করেন। ভবিষ্যতের সঙ্গী খুঁজে পেতে সে সময় সিঙ্গেল ক্লাবগুলোয় বিজ্ঞাপন দেয়া যেতো। ফ্রাঙ্ক হ্যারেলসন একটি কবিতা ও ছবি দিয়ে ন্যানির বিজ্ঞাপনের উত্তর দেন।

ওই চিঠির উত্তরে ন্যানি যৌন অভিমুখতার নানা কথা ও একটি ছবি পাঠান। খুব দ্রুতই ১৯২৯ সালে তাদের বিয়ে হয়। ফ্রাঙ্ক ছিলেন একজন মদ্যপ ব্যক্তি ও তার আচরণও ছিল খারাপ। যিনি তার বিবাহিত জীবনের একটি বড় অংশ স্থানীয় কারাগারে মাদক সেবন করে কাটিয়েছেন। ন্যানি টানা ১৬ বছর ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করেছিলেন। পরে তিনি বুঝতে পারেন যে তার দ্বিতীয় স্বামী তার উপর বোঝা ছাড়া আর কিছুই না। তবে ফ্রাঙ্ককে হত্যা আগে ন্যানি তার ভাগ্নে ও ভাগ্নিকে হত্যা করেছিলেন।

নাতনিকে হত্যা

ন্যানির বড় মেয়ে মেলভিনা ১৯৪০-এর দশকের গোড়ার দিকে বিয়ে করেন। তিনি প্রথমে একটি পুত্র এবং দুই বছর পরে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন।

জোন্সের মতে, মেলভিনা এবং তার স্বামী হাসপাতালের কেবিনে ঘুমানোর সময় ন্যানি তার নাতনিকে দোলাতে শুরু করেন। এর এক ঘণ্টার মধ্যে নবজাতকের মৃত্যু হয়।

মাতৃত্বকালীন ওষুধের প্রভাবে মেলভিনা ভেবেছিলেন, তিনি তার মাকে একটি কলম দিয়ে তার নবজাতককে আঘাত করতে দেখেছেন। বিষয়টি মেলভিনা তার পরিবারের অন্যদের জানালেও কেউ ন্যানিকে সন্দেহ করেনি। প্রায় ছয় মাস পরে মেলভিনা তার শিশু পুত্র রবার্টকে তার মা ন্যানির কাছে রেখে যান। ওই ছেলেটিও রহস্যজনকভাবে শ্বাসরোধে মারা যায়।

জোন্স লিখেছেন, শিশুটির মৃত্যুর পর ন্যানি শিশুটির নামে ৫০০ ডলার বীমার অর্থ পেয়েছিলেন। তবে এটি শেষবার ছিল না যখন ন্যানি খুন করার মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন।

একের পর এক খুন

এবার স্বামী ফ্রাঙ্কের পালা। গবেষক গর্ডন হার্ভির মতে, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা বন্ধুদের সাথে পার্টি করে এক রাতে বাড়িতে ফেরেন। আদালতে ন্যানির দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, সেই রাতে ফ্রাঙ্ক জবরদস্তি করে তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন। পরের দিন স্বামীর মদের মধ্যে ইঁদুরের বিষ মিশিয়ে দেন ন্যানি। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ১৯৪৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। ডি লং লিখেছেন, মানুষ ধরে নিয়েছিল যে, ফ্রাঙ্ক খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মারা গেছেন।

এদিকে, ন্যানি এক টুকরো জমি এবং একটি বাড়ি কেনার জন্য ফ্রাঙ্কের মৃত্যুর পর তার জীবন বীমার অর্থের যথেষ্ট পরিমাণ তুলে নেন। ন্যানি তখন নর্থ ক্যারোলাইনায় হাজির হন। সেখানে তিনি আবার ‘লোনলি হার্ট’ বিজ্ঞাপনে প্রেম এবং জীবনসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দেন।

আর্লি ল্যানিং নামের একজন শ্রমিক দলের নেতা মাত্র দুই দিন দেখা করার পর মধ্যবয়সী ন্যানিকে বিয়ে করেন। জোন্স লিখেছেন, নর্থ ক্যারোলিনায় বসবাস করার সময় ন্যানি একজন সম্মানিত বিবাহিত নারী হিসাবে জীবনযাপন করেছেন। স্থানীয় মেথডিস্ট চার্চের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি।

সবাই জানত যে তার স্বামী শহরে পতিতাদের কাছে যেতেন। তাই বমি মাথা ঘোরা এবং অন্যান্য উপসর্গে ভুগে যখন আর্লি ল্যানিং মারা যান তখন তারা শোকার্ত বিধবাকে সন্দেহ না করে ভালো ব্যবহার করেছেন। ন্যানি তার বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের বলেছিলেন, তার স্বামীকে সকালের নাস্তা ও কফি খাওয়ানোর পরেই তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। চিকিৎসকরাও হার্ট অ্যাটাকের কারণ হিসেবে মদপানকে দায়ী করেছেন।

হার্ভে লিখেছেন, ওই সময় ফ্লু ভাইরাসও ছড়িয়ে পড়েছিল। সব মিলিয়ে ন্যানির তৃতীয় স্বামীর মৃত্যুকে সন্দেহজনক বলে মনে করা হয়নি। তাই মৃতদেহের কোনো ময়নাতদন্ত করা হয়নি।

ন্যানি যখন জানতে পারেন তার প্রয়াত স্বামী বাড়িটি নিজের বোনকে লিখে দিয়ে গেছেন, তখন তিনি তার টেলিভিশনসহ অন্যান্য মালপত্র গুছিয়ে শহর ছেড়ে চলে যান। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাড়িটি পুড়ে ছাই আর কয়লায় পরিণত হয়। ন্যানি এরপর কাছে এক শহরে তার প্রয়াত স্বামী আর্লির মা অর্থাৎ তার শাশুড়ির সাথে থাকতে শুরু করেন। কয়েক সপ্তাহ পরে আর্লির নামে একটি ফায়ার ইনস্যুরেন্স চেক আসে। উইল অনুযায়ী এই ইনস্যুরেন্স আর্লির বোনের পাওয়ার কথা। কিন্তু বোন চেকটি পাওয়ার আগেই আর্লির মা হঠাৎ মারা যান। ন্যানি অবৈধভাবে চেকটি নগদ করেন। আবার তার টেলিভিশন ও জিনিষপত্র গুছিয়ে ওই শহর ছেড়ে চলে যান।

এরপর ন্যানি তার বোন ডিউইয়ের যত্ন নেওয়ার জন্য অ্যালাবামায় চলে আসেন। তিনিও কিছুদিন পরে হঠাৎ করে রহস্যজনকভাবে মারা যান। জোন্সের মতে, বিয়েতে তিনটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ন্যানির হৃদয়ে তখনও সম্ভবত ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল।

১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে, ন্যানি ডায়মন্ড সার্কেল ক্লাবে যোগদানের জন্য ১৫ ডলার ফি প্রদান করেন। এটি ছিল পত্রমিতালির একটি পরিসেবা, যেখানে চিঠির মাধ্যমে নারী-পুরুষরা যোগাযোগ করতেন।

এই চিঠির মাধ্যমে ন্যানির সঙ্গে তার চতুর্থ স্বামী রিচার্ড মর্টনের পরিচয় হয়। পরে তারা দেখা করেন। কানসাসের এই অবসরপ্রাপ্ত বিক্রয়কর্মী ন্যানির আগের তিন স্বামীর চাইতে অনেক আলাদা ছিলেন। তিনি ছিলেন বেশ আমুদে লোক এবং স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন।

কিন্তু ডি লং লিখেছেন, রিচার্ড মর্টন ন্যানির সাথে বিবাহিত থাকা অবস্থায় বিভিন্ন সময় অন্য নারীদের সাথে সময় কাটিয়েছিলেন। জোনসের মতে, বিয়ের দুই মাসের মধ্যে ন্যানি তার পরবর্তী স্বামীর খোঁজ করতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। এর মধ্যে ন্যানির বাবা মারা গেলে তার মা অ্যালাবামা থেকে মেয়ের কাছে চলে আসেন। কিন্তু আসার কয়েক দিনের মধ্যে লু হ্যাজেল গুরুতর পেটের সমস্যার ভুগে মারা যান।

ডি লং লিখেছেন, মা মারা যাওয়ার সাথে সাথে ন্যানি তার ‘প্রতারক’ স্বামীর দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেন। জোন্স লিখেছেন, রিচার্ড বিষাক্ত কফি পান করার কারণে মারা গেছেন।

বলা হয়েছিল, এক থামোর্ফ্লাস্ক ভর্তি বিষাক্ত কফির পান করেছিলেন রিচার্ড। তবে এ মৃত্যুর ঘটনা দুর্ভাগ্য বয়ে আনে ওকলাহোমার স্যামুয়েল ডসের জন্য। কেননা ন্যানির পরবর্তী লক্ষ্য তিনিই ছিলেন।

স্বামীকে খুনের সন্দেহে ন্যানি

ডস একজন স্পষ্টভাষী এবং অত্যন্ত রক্ষণশীল মানুষ ছিলেন। সময় ও অর্থ নষ্ট করতে পছন্দ করতেন না। ডি লং এর মতে, স্যামুয়েল মদপান বা গালিগালাজ কোনটাই করতেন না। তার একটাই দোষ ছিল- তিনি তার স্ত্রীকে শুধুমাত্র শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে ম্যাগাজিন পড়তে বা টেলিভিশন শো দেখার কথা বলেছিলেন।

জোন্স লিখেছেন, এই বিধিনিষেধের কারণে ন্যানি তার স্বামীকে ছেড়ে অ্যালাবামায় চলে আসেন। স্যামুয়েল তার রাগান্বিত স্ত্রীকে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ জানান। এমনকি তিনি ন্যানিকে তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের অংশীদারও বানিয়েছিলেন। স্ত্রীর নামে তিনি দুটি জীবন বীমা পলিসি নিয়েছিলেন।

একদিন ন্যানি তাকে ঘরে তৈরি কেক খেতে দিলেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার পেটে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। তিনি কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এবং তারপর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।

স্বামীর বাড়ি ফেরা উদযাপনের জন্য ন্যানি তাদের জন্য একটি বিশেষ খাবার তৈরি করেন। তবে এর আগে ন্যানি তার স্বামীর রুচি বাড়াতে বিষ মেশানো কফি খাওয়ান।

ডি লং এর মতে, এই বিষাক্ত কফিই ছিল স্যামুয়েলের শেষ পানীয়। এখানেই ন্যানি ভুল করেছেন। যে ডাক্তার তার পঞ্চম এবং শেষ স্বামীর চিকিৎসা করেছিলেন, তিনি ‘কিছু একটা হয়েছে’ বলে আগে থেকেই সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু তার হাতে কোনো প্রমাণ ছিল না। ন্যানি যখন তার স্বামীর মৃত্যুর পর দুটি জীবন বীমার অর্থ তোলার চেষ্টায় ছিলেন তখন চিকিৎসক ন্যানিকে তার স্বামীর ময়নাতদন্ত করাতে রাজি করান। চিকিৎসক স্যামুয়েল ডসের শরীরে প্রচুর পরিমাণে আর্সেনিক দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেন। এরপরই ১৯৫৪ সালে ন্যানি গ্রেপ্তার হন। তবে ন্যানির কাছ থেকে স্বীকারোক্তি পেতে তদন্তকারীদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।

ন্যানির স্বীকারোক্তি

জোন্স লিখেছেন, তিনি ‘রোমান্টিক হাট’ নামে এক ম্যাগাজিন পড়ায় নিমগ্ন ছিলেন। আর ওই ম্যাগাজিনের মাধ্যমেই ন্যানির দৃষ্টি আকর্ষণ করে পুলিশ।

ন্যানি তখন তাদের সঙ্গে কিশোরী মেয়ের মতো হেসে হেসে ফ্লার্ট করেছিল। শেষে জিজ্ঞাসাবাদের কক্ষে কয়েক ঘণ্টা পরে ন্যানি তার শেষ স্বামীকে বিষ প্রয়োগের কথা স্বীকার করেন।

পুলিশ জিজ্ঞাসা করে, তিনি কেন এমন করেছেন?

ন্যানি সহজভাবে উত্তর দেন, ‘তিনি আমাকে আমার প্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখতে দিতেন না। গরমের রাতে ফ্যান চালু করতে দিতেন না।’

ন্যানি পুলিশকে বলেন, তিনি তার অন্য স্বামীদের সম্পর্কে তখনই কথা বলবেন যখন তারা তার ম্যাগাজিন ফেরত দেবে। ম্যাগাজিনটি ফেরত পেয়ে তিনি তিনজনকেই হত্যার কথা স্বীকার করে।

স্বামীকে খুনের অভিযোগে ন্যানির স্বীকারোক্তিতে দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তবে তাকে তখনও সদা হাস্যময়ীই দেখা গেছে। এ কারণেই কেউ কেউ তাকে ‘হাস্যময়ী ন্যানি’ বলে ডাকতেন। এক পত্রিকায় তাকে ‘সেলফ মেড উয়িডো’ অর্থাৎ ‘স্বেচ্ছায় বিধবা’ বলেও সম্বোধন করা হয়।

ন্যানি তার পাঁচ প্রাক্তন স্বামীর মধ্যে চারজনকে হত্যার কথা স্বীকার করলেও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার দায় তখনও স্বীকার করেননি। তদন্তকালে তার সন্দেহভাজন হত্যার শিকার আটজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ময়নাতদন্তে ন্যানির অন্য তিন মৃত স্বামী ও তার মায়ের দেহাবশেষে বিষ পাওয়া যায়। বাকিদের মধ্যে শ্বাসরোধের লক্ষণ পাওয়া গেছে। সবমিলিয়ে কর্তৃপক্ষের সন্দেহ যে, ন্যানি প্রায় ১২ জনকে হত্যা করেছেন, যাদের বেশিরভাগই ছিল তার নিকটাত্মীয়।

সব মিলিয়ে দেখা গেছে, ন্যানি তার চার স্বামী, দুই সন্তান, দুই বোন, দুই নাতি এবং একজন শাশুড়িকে হত্যা করেছেন। ন্যানি তার এমন আচরণের পেছনে ছোটবেলায় তার মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়াকে দায়ী করেন। তিনি দাবি করেন, এ কারণে তার সারাজীবন মাথাব্যথা হয়েছে।

তিনি তার স্বামীদের কীভাবে খুন করেছেন সেটি ব্যাখ্যা করতে গিয়েও বারবার হেসেছেন। তবে ন্যানি জানান, তিনি কাউকেই জীবন বীমার টাকার জন্য খুন করেননি। ন্যানির নিজের ভাষ্যমতে, রোম্যান্স ম্যাগাজিনগুলো তার মানসিকতার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি বলেন, ‘আমি একজন নিখুঁত সঙ্গী খুঁজছিলাম, সত্যিকারের রোম্যান্স চাইছিলাম।’ তার স্বামীরা যখন ‘বিপথে’ চলে গিয়েছিল তখনই তিনি তাদের হত্যা করেছেন। এরপর তিনি আবারও ভালোবাসার খোঁজ করেছেন। অথবা তার নতুন শিকারের সন্ধান করেছেন।

মানসিক সমস্যা ও মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তি

হার্ভে গবেষণা থেকে জানা যায়, ওকলাহোমা রাজ্য ন্যানিকে হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে। উত্তর ক্যারোলাইনা, কানসাস ও অ্যালাবামার রাজ্যের বিচার বিভাগও তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে আনে। কিন্তু ওকলাহোমার বাইরে তার বিরুদ্ধে কখনো কোনো বিচার হয়নি।

আটচল্লিশ বছর বয়সে ন্যানি মৃত্যুদণ্ড পেতে বৈদ্যুতিক চেয়ারের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে যদি সেটি হতো ওকলাহোমার ইতিহাসে তিনিই প্রথম মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নারী হতেন। কিন্তু দুই বছর পর একজন বিচারক তাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত ঘোষণা করেন। ফলে তিনি মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি থেকে রক্ষা পান। বিচারক পরে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তিনি একজন নারী। বিশেষ করে একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিকে ফাঁসি দিয়ে ‘খারাপ নজির’ স্থাপন করতে চাননি।

১৯৬৫ সালের দোসরা জুন লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ন্যানি মারা যান। ১৯৫৫ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার দুই বছর পর তিনি চেয়েছিলেন তাকে যেন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ন্যানি তার প্রফুল্ল স্বভাব বজায় রেখেছিলেন।

কারাগারে তার জীবন সম্পর্কে এক সাক্ষাতকারে ন্যানি অভিযোগ করেছিলেন যে, তাকে সেখানে কেবল লন্ড্রি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি রান্নাঘরে কাজ করার প্রস্তাব দিলেও কারাগার কর্তৃপক্ষ তা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে। বোধহয় জেলে গিয়েও খাবারে বিষ মেশানোর অতীত তাকে তাড়িত করছিল!

সূত্র: বিবিসি বাংলা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles