1.6 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

সরস্বতী পূজার শ্রেষ্ঠ স্মৃতি

সরস্বতী পূজার শ্রেষ্ঠ স্মৃতি
সবাইকে পূজার শুভেচ্ছা মা সরস্বতীকে মনে করে এই সত্যভাষণের জন্যে আশা করি বন্ধুরা আমাকে প্রশংসা করবেন

১৯৭৯ সাল। আমরা তখন ক্লাস টেনে পড়ি। আমাদের পাখনা গজাতে শুরু করেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে একটা-দুটো সিগারেট খাওয়া হয়ে গেছে ততোদিনে। আমরা ছেলে আর কারা কারা মেয়ে সেটাও জেনে ফেলেছি। থুতনিতে ব্লেড না লাগলেও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লোম গজালো কি না সেই গবেষণা শুরু হয়েছে। অমুক স্যার কেন মাতব্বরি করবে, স্যারকে দেখিয়ে দিতে হবে– এইসব পুরুষভাবও আসতে শুরু করেছে।

আমাদের স্কুলের তখন নিয়ম ছিল ক্লাস টেনের ছাত্ররাই পূজার দায়িত্ব পালন করবে। অর্থাৎ আমরা মহান নেতা বনে গেলাম। এবং পড়বি পড় মালির ঘাড়ে, ছাত্রদের মধ্যে আমাকেই প্রতিনিধি করা হলো যে কি না স্যারদের সাথে প্রয়োজনমতো মতবিনিময় ইত্যাদি করবে। আমার কাছে থাকবে টাকাপয়সার হিসাবও।

- Advertisement -

সুতরাং প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে প্রথম পিরিয়ডে হাজিরা দেবার পর আমার দায়িত্ব হলো কয়েকজন সহপাঠীকে নিয়ে রশিদবই হাতে চাঁদা তুলতে যাওয়া। চাঁদা তোলার এলাকা বাজার ছাড়িয়ে কামারখালী ফেরিঘাট পর্যন্ত প্রসারিত হলো। আমরা কষ্ট করে চাঁদা তুলবো, কিন্তু টাকা জমা রাখতে হবে সুধীর স্যারের কাছে সেটাও আমাদের অসল্যে লাগতে শুরু করলো।
মাসখানেক ধরে এইসব চাঁদাবাজি করে পূজা শেষ হলো। বোধ করি ভালোই হলো। কিন্তু তখনও আসল মজা আসেনি। আসল মজা হলো যখন বন্ধুরা সবাই পরামর্শ করলাম আমাদের ঘামফেলা টাকা কিছুতেই স্যারদের হাতে দেওয়া যাবে না। তো কী করা যায়! সিদ্ধান্ত হলো মুরগি খাওয়া হবে। সেকালে মুরগিই ছিল আমাদের কাছে সর্বোচ্চ কাঙ্ক্ষিত খাবার। ব্যবস্থা করা হলো। এক সন্ধ্যায় এক বন্ধুর বাড়িতে আমরা পুরুষশ্রেষ্ঠরা সাফল্যের চূড়ায় উঠলাম। মনে হতে লাগলো মুরগি খেয়ে আমরা বিশ্বজয় করে ফেলেছি। কিন্তু আকাশ ভেঙে মজা পড়লো পরদিন, যখন দফতরি ক্লাসে এসে বললেন, হেডস্যার ডাকছেন।

সে সময় আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। অত্যন্ত রাশভারী ছিলেন তিনি। ইংরেজির জাহাজ। তাঁর ঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি পূজার খোঁজখবর নিলেন। বললেন তাড়াতাড়ি পূজার হিসাবটা দিয়ে দিতে।

হিসাব যে দিতে হবে সে চিন্তাই তো আগে আসেনি। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। কিছুতেই তো মুরগির হিসাব মেলাতে পারি না। রশিদে যতোই কাটাকুটি করি, খরচে যতোই কলম লাগাই মুরগির ডাক আর থামাতে পারি না।

যেদিন হেডস্যারের সামনে হিসাব নিয়ে দাঁড়ালাম, বন্ধুরা কেউ সাথে যেতে রাজি হলো না। স্যার চাঁদাবই উল্টান আর প্রশ্ন তোলেন, দুইটাকা কেটে একটাকা কেন, বা বইয়ের মাঝে একপাতা উধাও কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। যতক্ষণ স্যারের সামনে ছিলাম মিথ্যা কথা বলতে বলতে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। মুরগি খেলে যে এমন মিথ্যাবলার রোগ হবে সেটা যদি আগে জানতাম!
এই ঘটনার ঠিক দশ বছর পর আমি এমএ পরীক্ষা দেই। দিয়ে বাড়ি আসতেই গ্রামের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের অনুরোধে জয়েন করলাম কামারখালী কলেজে। অর্থাৎ গ্রামের ভাষায় ইংরেজির প্রফেসর। কলেজের গা-লাগানো আমার কৈশোরের স্কুল। প্রথম দিনেই ক্লাসের ফাঁকে স্কুলে গেলাম। তখনও রাজ্জাক সাহেব হেডস্যার। কলেজে জয়েন করার কথা বললাম। অনেক আনন্দ প্রকাশ করলেন। সামনের চেয়ারে বসতে বললেন তিনি। স্যারের সামনে চেয়ারে বসতে সে যে কী অস্বস্তি! একসময় স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “সুব্রত, সরস্বতী পূজার হিসাব কি মিলেছে?” বলেই স্যারের যে কি অট্টহাসি।

যে যাই খারাপ বলুক, মুরগি না খেলে কি সেই সরস্বতী পূজার স্মৃতি আমার জীবনে এতো গুরুত্বপূর্ণ হতো? বন্ধুরা মিলে এই অপকর্মটি করেছিলাম বলেই তো হেডস্যারের মতো গুরুগম্ভীর মানুষের অমন হাসি আমি দেখতে পেয়েছিলাম!

সবাইকে পূজার শুভেচ্ছা। মা সরস্বতীকে মনে করে এই সত্যভাষণের জন্যে আশা করি বন্ধুরা আমাকে প্রশংসা করবেন। কারণ আমি যে সৎ সেটা জেনেই কিন্তু দেবী আমাকে সামান্য হলেও কিছু জ্ঞান দিয়েছেন। বন্ধুদেরকে অনুরোধ করবো প্রত্যেকে নিজের নিজের দুষ্কর্মের কথা আজ স্বীকার করবেন ফেসবুকে। করলে আপনিও দেবীর নিকট থেকে জ্ঞানলাভের নিশ্চয়তা পাবেন।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles