1 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

কিং আব্দুল আজিজ এয়ারপোর্টে যাত্রাবিরতি ও স্বাবলম্বী আছিয়ার কাহিনী

কিং আব্দুল আজিজ এয়ারপোর্টে যাত্রাবিরতি ও স্বাবলম্বী আছিয়ার কাহিনী
রিমি রুম্মান

বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্ক ফিরছিলাম। জেদ্দায় কিং আব্দুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে দীর্ঘ যাত্রাবিরতি ছিল। এয়ারপোর্টের ভেতরে ইনফরমেশন ডেস্কে সৌদি এয়ারলাইন্স অফিসে অনেকটা সময় কেটে গেল হোটেল পাবো কিনা, খাবার পাবো কিনা, এর জন্যে বাড়তি অর্থ গুনতে হবে কিনা… এমন নানাবিধ কথোপকথনে। অফিসার জানালো, এয়ারপোর্টের ভেতরে হোটেল বা লাউঞ্জ নিতে হলে মোটা অংকের অর্থ গুনতে হবে। তারচেয়ে বাইরের কোনো হোটেল কম খরচে পেয়ে যাবে।

আমার পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। কোনো প্রশ্ন করলে আরব দেশের মানুষজন ইংরেজি ঠিকমত বুঝতে কিংবা বোঝাতে পারে না। ভাষাগত সমস্যায় আবার না হারিয়ে যাই! তারচেয়ে বিশাল রাজকীয় এয়ারপোর্টের ভেতরটা, গিফট শপ, নানান দেশের যাত্রীদের একস্থান থেকে অন্যস্থানে ছুটোছুটি দেখতে দেখতে সময় কেটে যাবে। সঙ্গে আছে বই ও সেলফোন। এমন ভাবনার মাঝে এয়ারলাইন্স অফিসের সামনে আরও দুইজন যাত্রী এসে হাজির। ভারতীয় তরুণ-তরুণী। তাদের সমস্যা, ফ্লাইট মিস করেছে। অফিসার আশ্চর্যবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায়, ‘কীভাবে?’ তরুণী খুব দুঃখিত স্বরে বলল, ‘আমরা ভেজিটেরিয়ান। ফুডকোর্টে গিয়েছিলাম পিৎজা কিনতে। যাত্রাবিরতি ছিল মাত্র একঘণ্টা। খাবার কিনে নির্ধারিত গেটের সামনে যেতেই দেখি প্লেনটি চোখের সামনে দিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে।’ আমরা উপস্থিত সকলেই তরুণীর হাতে থাকা পিৎজার বাক্সের দিকে তাকালাম। অফিসার মুচকি হেসে কম্পিউটারের মনিটরে মনযোগী হলেন। জানালেন, ২৪ ঘণ্টা পর তাদের পরবর্তী ভারতগামী ফ্লাইট। এবং এজন্যে তাকে টিকেটের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। তরুণ-তরুণীর মাথায় হাত। প্রায় কেঁদে ফেলার দশা! তাদের সমস্যার কাছে নিজের সমস্যাটিকে নিতান্তই সামান্য মনে হলো।

- Advertisement -

সত্যিই সময়টা বেশ কেটে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালের ওপাশে প্লেনের আসা-যাওয়া দেখে, বই পড়ে, নয়তো হেঁটে-হেঁটে খাবারের দোকানগুলো দেখে। খাবার অর্ডার দিতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধল। সঙ্গে থাকা ডলারে কাজ হচ্ছে না। ভাঙ্গিয়ে রিয়েল বানাতে হবে। দুপুরের খাবার কোন রেস্তরাঁয় খাওয়া যায়, এমনটি ভাবতে ভাবতে ওয়াশ রুমের বেসিনে হাত ধুচ্ছিলাম। কলের জলে দুই হাতে সাবানের ফেনার গড়িয়ে পড়া দেখছিলাম। কেউ একজন হাত শুকানোর মেশিনের দিকে ইঙ্গিত করে কিছু বললেন ভাঙা আরবি ভাষায়। হিজাব পরিহিতা, মাঝারি গড়ন, দুধেআলতা গায়ের রঙের ২২/২৩ বছরের এক নারী। ওয়াশ রুমের নারীকর্মী। যাত্রীদের অনেকেই দ্রুতলয়ে ওয়াশরুমে আসছে, যাচ্ছে। নারীকর্মী সকলকেই সালাম দিয়ে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে যাচ্ছে। কারও কিছু লাগবে কিনা জানতে চাচ্ছে। ভীষণ উচ্ছল, অমায়িক। ইতস্তত করছিলাম, কথা বলা ঠিক হবে কিনা ভেবে। কারও সঙ্গে কথা বলতে হলে এতো ভাবাভাবির কিছু নেই। তবুও আমি ভাবছি। কেননা, এক মাস আগে নিউইয়র্ক থেকে দেশে যাওয়ার পথে এখানেই ছয় ঘণ্টার যাত্রাবিরতি ছিল। ওয়াশ রুমে পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত এক বাংলাদেশি নারীর সঙ্গে সেই সময়ে হালকা আলাপ হয়েছিল। সে টয়লেট, বেসিন, মেঝে পরিষ্কার করছিল। আমি মুখ ধুয়ে ক্রিম দিচ্ছিলাম। চুল আঁচড়াচ্ছিলাম। কথা প্রসঙ্গে নিজের জীবনের কিছু গল্প বলেছিল সে। বাংলাদেশে স্বামীর ঘরে নির্যাতন, নিপীড়নের গল্প। ভয়ার্ত চোখে বার বার ওয়াশ রুমের বাইরের দিকে তাকাচ্ছিল। বলেছিল, চার মাস আগে এখানে চাকুরি নিয়েছে। কাজের সময়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে দেখলে সমস্যা হবে।
এবার তাই একটু সচেতন হলাম। জায়গাটা নিরিবিলি হলে মাঝারি গড়নের রূপবতী নারীকে উদ্দেশ্য করে জানতে চাইলাম সে বাঙালি কিনা। মেয়েটি বিস্ময়ে উচ্চস্বরে টেনে টেনে বলে উঠল, ‘আপনে বাঙালি? আমি ভাবছিলাম আপনে বিদেশি!’ তার চোখেমুখে আলো খেলে গেল যেন! নিজের দেশের কাউকে পেলে আমার এমন আনন্দ হতো প্রবাসের প্রথমদিকের দিনগুলোতে। আমরা পরিচ্ছন্ন সুবিশাল ওয়াশ রুমের ভেতরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। এরমাঝে যাত্রীরা আসছে, যাচ্ছে। সে সকলকে সালাম দিচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে টয়লেট মুছে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। আবার এসে গল্প জুড়ে দিচ্ছে। তার সম্পর্কে জানতে আমি আগ্রহী হয়ে উঠলাম। এটা সেটা প্রশ্ন করছিলাম। বিরক্তির উদ্রেক নেই। বরং বেশ স্বতঃস্ফূর্ত। বলল, দালালের মাধ্যমে আড়াইলক্ষ টাকার বিনিময়ে আট মাস আগে জেদ্দা এসেছে সে।’ এত টাকা কোথায় পেলে? জায়গাজমি বিক্রি করে এসেছো? দালাল যদি তোমার টাকা মেরে দিত!’ আমার এক সঙ্গে এত প্রশ্ন শুনে মুখের মাস্ক সরিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘ দালাল আমার মামা। মা’র জ্যাঠাত ভাই। এক লক্ষ টাকা সংসার খরচ বাঁচায়ে তিল তিল করে জমানো। বাকি দেড় লক্ষ টাকা ঋণ। প্রতি মাসে কিছু কিছু করে ঋণ পরিশোধ করতেছি।’

তার নাম আছিয়া। এই ভিনদেশে কীভাবে, কোথায়, কার সঙ্গে থাকছে, খাচ্ছে, কত বেতন পাচ্ছে, সঞ্চয় করা যাচ্ছে কি, দেশে পিছুটান আছে কি? এমন প্রশ্নে জানায়, ওরা ৭০০ জন নারী একটি বিশাল বিল্ডিং এ থাকে। এর মধ্যে ৭৫ জন বাংলাদেশি। বাকিরা ভারত, পাকিস্তান, ইস্তাম্বুল, ইন্দনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে এসেছে। প্রতি মাসে বেতন পাচ্ছে ৮০০ রিয়েল। অর্থাৎ ২২ হাজার টাকা। সঞ্চয় করা যাচ্ছে সহজেই। দেশে ছোট দুটি ছেলেমেয়ে আছে। তারা নানীর কাছে থাকে। মানে আছিয়ার মায়ের কাছে। বিধায় দেশে খরচ দিতে হয়।’ বাচ্চারা বাবার কাছে থাকে না?’ জিজ্ঞেস করতেই ঝলমলে দ্যুতি ছড়ানো মুখে আঁধার নেমে এলো। বলল, ‘হেয় আবার বিয়া করছে। তার লগে আমার কী কাম? রাইন্দা-বাইড়া খাওয়ান, আর এক লগে ঘুমান। ঘুম ভাঙলেই যায় গা নতুন বউ’র কাছে। আমার কী লাভ? আমার ত কোনো লাভ নাই।’ প্রসঙ্গ এড়াতে বলি, তোমার মায়ের কাছে বাচ্চারা ভালো আছে? এবার দীর্ঘশ্বাস আরও ঘন হয়ে আসে। ‘মা-বাপের উপ্রে আমার ম্যালা কষ্ট। হেরা আমারে ল্যাদাকালে বিয়া দিয়া দিছে। জীবনডা নষ্ট করলো না? আমি তাগোরে কোনোদিন মাফ করতে পারুম না।’ বললাম, মা-বাবা তো কন্যার বিয়ে দেয় দায়িত্বের জায়গা থেকে। এতে এতো অভিমানের কিছু নেই। আছিয়া ক্ষোভে জ্বলে ওঠে। ‘শুধু এইডা না, আরও অনেক কাহিনী আছে।’ তার কষ্ট আর বাড়াতে চাই না, পাছে তা সংক্রমিত হয়ে পড়ে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলাম, এখানে কেমন আছো? দেশের চেয়ে ভালো, না মন্দ? আছিয়ার চোখে খুশির ঝলক। বলল, ‘ভালো আছি। অনেক ভালো। আট মাস হয় এই দ্যাশে আছি। বড় একটা রুমে ৩ জন থাকি। ইচ্ছা করলে ছয়জনও থাকা যাইত। কোম্পানির গাড়ি এয়ারপোর্টে নিয়া যায়, নিয়া আসে। সপ্তাহে একদিন বাজারে নিয়া যায়। যাওয়া-আসার খরচ নাই।’ কোম্পানি কারা, জানতে চাইলে বলে, ‘যারা আমাগরে এই দ্যাশে নিয়া আইছে, তারা। শুধু সমস্যা একটাই। এর বাইরে আর কোথাও যাওয়ার অনুমতি নাই।’ পর মুহূর্তেই মুচকি হেসে বলে, ‘এইটা অবশ্য একদিকে ভালোই হইছে। বাইরে যাওয়ার অনুমতি থাকলে মেয়েগুলা খারাপ হইয়া যাইত। কোম্পানির বদনাম হইত, দ্যাশের বদনাম হইত।’ আছিয়ার কথার যুক্তি আছে। সে মেয়েদের নিরাপত্তার কথা বোঝাতে চেয়েছে। বললাম, সব সময় তো পত্রিকায় দেখেছি বাংলাদেশের মেয়েরা আরব দেশে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। আছিয়া ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে ওঠে, ‘ওইগুলা তো বাসা বাড়িতে কাজ করে যারা, তাগো কথা।’

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে। খেতে হবে কিছু একটা। বললাম, আমাকে কি দেখিয়ে দিবে কোথায় ডলার ভাঙাতে পারবো? সে সচেতন হয়ে ওঠে। জানালো, তার বাইরে যেতে মানা। সুপারভাইজার দেখলে সমস্যা হবে। জানতে চাইলাম, কতদিন থাকবে এই দেশে? তোমাকে নিয়ে লিখতে চাই। সে সম্মতি জানালো। দুই বছরের কন্টাক্ট এ এসেছে। মেয়াদ শেষ হলে আবার বাড়ানো যাবে। এতে তাকে বাড়তি অর্থ গুনতে হবে না।

চলে আসার আগে আছিয়া সত্যিই ভালো আছে, এমনটি শোনার প্রবল বাসনা নিয়ে আবারো বলি, তাহলে এখানে তুমি ভালোই আছো? সে দৃঢ়তার সঙ্গে বলে ওঠে, সত্যিই ভালো আছে। যে যাত্রীরা ওয়াশরুম ব্যবহার করে, তারা অধিকাংশই আছিয়ার ব্যবহারে খুশি হয়ে বখশিশ দিয়ে যায়। মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেয়। বলল, যাত্রীদের কেউই তার চেনা মুখ নয়। রোজই নতুন মুখ। তাদের প্রায় সকলেরই ব্যবহার অমায়িক। তার প্রতি দয়াশীল। আচমকা আছিয়ার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একপাশে ছোট্ট একটি বিশ্রামাগারে বসার টুলে কিছু রিয়েল! গুনে দেখে সে। ৩০ রিয়েল। কেউ একজন আছিয়াকে গল্পে মশগুল দেখে বিরক্ত না করে টুলের উপর বখশিশ রেখে গিয়েছে। সে তা পকেটে রাখতে রাখতে আটমাস আগে মধ্যপ্রাচ্যে যখন নতুন এসেছে, তখনকার কথা স্মরণ করে বলে ওঠে, ‘জানেন, একবার এক যাত্রী ১০০ ডলার বখশিশ দিছিল। চিন্তা করছেন, এ-ক-শ ডলার! দ-শ হাজার টাকা!’ টেনে টেনে কথাগুলো বলার সময় তার প্রবল উচ্ছ্বাস আর আনন্দমুখর মুখ দেখে আমি ভাবছি অন্য কথা। যিনি আছিয়াকে ১০০ ডলার বখশিশ দিয়েছিলেন, তিনি হয়তো জানেই না যে, সুদূর বাংলাদেশের সহজ সরল এক প্রান্তিক মানুষের জীবনে কী ভীষণভাবে গেঁথে আছেন তিনি। যতবার আছিয়া এই গল্প করবে তার সহকর্মীদের সঙ্গে, স্বজনদের সঙ্গে, কিংবা আমার মতো অচেনা কারো সঙ্গে, ততবার তার চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয় কিনা জানতে চাইলে মুহূর্তেই তার বিষাদে ভারাক্রান্ত মুখ নীল হয়ে ওঠে। চোখে অজানা উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা। আরব দেশের বুকে বসে এক বাংলা মায়ের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা আমায় ব্যথিত করলো। ‘আমার চোখের দিকে দ্যাখেন, কালি পড়ছে না? তাগো কথা মনে পড়লে চোক্ষের পাতা এক করতে পারি না।’ ধরা গলায় আছিয়ার এমন কথায় আমি তার চোখের দিকে তাকাই। চোখে কালি পড়েনি। অল্প বয়সের নির্মল, সতেজ ভাব মুখাবয়বে। চতুর্দিকে ঝলমলে আলো, তবুও কী নির্মম নিরবতা চোখের তারায়! অসীম এক শূন্যতা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আছিয়া। হাসিমুখে যাত্রীদের সেবা দিচ্ছে, নিজে অর্থ উপার্জন করছে, স্বনির্ভর হয়েছে। এটি তার একরকম পূর্ণতা।

আমার ফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমাকে যেতে হবে। আমি যাচ্ছি ৩৭এ গেইটের দিকে। যেখান থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে প্লেনটি ছেড়ে যাবে। গত এক মাসেরও অধিক সময় আমিও যে আমার সন্তানদের দেখিনি। স্পর্শ করিনি। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরিনি। সেই মুহূর্তে পথটিকে আমার কাছে পৃথিবীর দীর্ঘতম পথ মনে হলো!

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles