দেশের বিনোদন জগতে নজরুল ইসলাম রাজের বিচরণ শুরু ২০১৪ সালে। ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া’র কথিত কর্ণধারও তিনি। নায়িকা পরীমনিকে চিত্রজগতে নিয়ে আসেন এই রাজ। মিডিয়াপাড়ায় গুঞ্জন রয়েছে, সিনেমায় নাম লেখানোর আগে পরীমনি দীর্ঘদিন প্রযোজক রাজের কাছেই ছিলেন।
রাজধানীর বনানীর ৭ নম্বর সড়কের জি ব্লকের ৪১ নম্বর বাসায় ছিল রাজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের অফিস। সেখানে মডেলিং কিংবা অভিনয়ের জন্য আসতেন উঠতি বয়সী তরুণীরা। তাদের আরও স্বপ্ন নাটক-সিনেমায় অভিনয় করবেন। কিন্তু রাজ তাদের ফাঁদে ফেলে অনৈতিক কাজে বাধ্য করতেন। আবার এসব দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করে রাখতেন।
গত বছরের ৪ আগস্ট বনানীর ওই অফিসে অভিযান চালায় র্যাব। সেখানে পাওয়া যায় বিকৃত যৌনাচারের একটি সুরক্ষিত কক্ষ। উদ্ধার করা হয় বিকৃত যৌনাচার সরঞ্জাম, মাদক, পর্নোগ্রাফি তৈরির বিভিন্ন কনটেন্ট।
এ ঘটনায় প্রযোজক রাজের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে এবং মাদক আইনে দুটি মামলা করে র্যাব। তদন্ত শেষে এই মামলার প্রতিবেদন দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
রাজ এখন কোথায়? মিডিয়াপাড়ায় কি এখনো তার বিচরণ আছে? তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর অগ্রগতি কত দূর? এখনো কি সিনেমা তৈরি করতে আগ্রহী তিনি? এসব বিষয়ে জানার আগ্রহ মিডিয়া জগতের অনেকের।
কে এই রাজ
১৯৮৯ সালে খুলনার একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল শেষ করেন নজরুল ইসলাম রাজ। যদিও তার দাবি, পরে তিনি গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। রাজ ঢাকায় এসে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। ঠিকাদারিও করতেন।
এরপর মিডিয়ায় প্রবেশ ঘটে। ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া’ গড়ে অনৈতিক কাজের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান রাজ।
কোথায় আছেন রাজ? তার বিরুদ্ধে হওয়া মামলার অগ্রগতি কী?
গ্রেপ্তারের পর রাজের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
জামিনে থাকা রাজকে প্রতি মাসেই আদালতে হাজিরা দিতে হয়। তাছাড়া মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ থাকায় একটি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। এরই মধ্যে রাজের ব্যাংকের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
গেল বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর মাদক ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত ১৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে রাজের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাছাড়া অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কেনা রাজের দুটি গাড়ি জব্দ করে সিআইডি।
সম্প্রতি যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট মুক্তি পাওয়ার পর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এদিন রাজকে সেখানে দেখা যায়। বর্তমানে তিনি রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়।
তার বিরুদ্ধে হওয়া অভিযান ও মামলা সাজানো দাবি করে নজরুল ইসলাম রাজ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব মামলা দেওয়া হয়েছে, সবই মিথ্যা। প্রতিপক্ষরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাকে হয়রানি করছে। প্রতি মাসে একাধিকবার আদালতে হাজিরা দিতে যেতে হয়। তাছাড়া আমি নাকি বিদেশে টাকা পাচার করেছি। যদি তাই করতাম তাহলে তো আমি দেশে থাকতাম না।’
নতুন করে সিনেমায় প্রযোজনা করবেন কি না জানতে চাইলে রাজ বলেন, ‘অনেক দিন কারাগারে থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ ছিল। নতুন করে শুরু করছি। একটি প্রজেক্টে বালু দিতাম, সেটা বন্ধ এখন। কারণ, সেখানে থেকে অনেক টাকা আসত।’
রাজ সিন্ডিকেটে যারা
বিলাসবহুল গাড়িসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার শরফুল হাসান মিশু, মাসুদুল ইসলাম জিসান ও নজরুল ইসলাম রাজ ১০-১২ জন তরুণী নিয়ে একটি অপরাধচক্র তৈরি করেন। তারা গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ডিজে পার্টির আয়োজন করতেন। র্যাবের হাতে তিনজন গ্রেপ্তারের পর এমনটি জানায় বাহিনীটি।
সে সময় র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিশু-জিসান ও রাজ চক্র মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিল। অভিজাত এলাকায় তাদের পার্টিতে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে মোটা অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করা হতো। এভাবেই রাজসহ চক্রের অন্যরা রাতারাতি বিপুল অর্থের মালিক হন। এ ছাড়া সিন্ডিকেটটি বিদেশেও ‘প্লেজার ট্রিপের’ আয়োজন করত।
একেক সময় একেক পরিচয়ে চলাফেরা করতেন রাজ। কখনো চিত্রপরিচালক, কখনো ব্যবসায়ী আবার কখনো রাজনীতিবিদ। ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া’র নামে অনৈতিক কাজ ও ডিজে পার্টি দিয়ে মাদক ব্যবসার মাধ্যমে যেসব অর্থ উপার্জন করতেন, তা নিজের আমদানি, ঠিকাদারি, বালুভরাটসহ বিভিন্ন ব্যবসায় লগ্নি করতেন।
রাজ প্রথমে নামে-বেনামে বিভিন্ন নাটক, সিনেমা প্রযোজনা করতেন, যা ২০১৪ সালের ঘটনা। ২০১৮ সালে রাজ তার রাজ মাল্টিমিডিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এই বাসাতেই পর্নোগ্রাফি বানানো হতো বলে জানায় র্যাব।
জি কে শামীমের সঙ্গে সখ্য
ঠিকাদারি কাজের ডন হিসেবে পরিচিত জি কে শামীমের সঙ্গেও সখ্য আছে রাজের। জি কে শামীমকে কারাগারে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতে তদবির করছিলেন এই রাজ। শামীমের বোন সুবর্ণা মোস্তাফার সঙ্গে তিনি প্রতি সপ্তাহে নানা বিষয়ে শলা-পরামর্শ করতেন বলেও অভিযোগ আছে।
রাজের অফিসে বিকৃত যৌনাচার কক্ষ
রাজের বাসায় একটি রুম পায় র্যাব। সেখানে একাধিক নারী-পুরুষের সমন্বিত বিকৃত যৌনাচারে ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি ছিল। এটি রাজের ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশন হাউজের’ একটি কক্ষ বা বিশেষ বিছানা হিসেবে পরিচিত ছিল।
রাজের বাড়িতে অভিযানে বিদেশি ১৪ বোতল মদ উদ্ধারের পাশাপাশি দুটি সিসা সরঞ্জাম, ৯৭০টি ইয়াবা, বিকৃত যৌনাচারে ব্যবহৃত ১৪ সেট বিভিন্ন সরঞ্জাম, তিনটি মেমরি কার্ড জব্দ করে র্যাব।
মুনিয়া ইস্যুতে প্রকাশ্যে আসেন রাজ
রাজধানীর গুলশানে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়া নামের এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধারের পর আলোচনায় আসেন চলচ্চিত্র প্রযোজক রাজ। তার সঙ্গে মুনিয়ার একাধিক ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ছবিতে দেখা যায় মুনিয়ার পাশে বসে রাজ ‘চুম্বন’ দিচ্ছেন।
পরীমনির বাসায় অভিযান দেখে পালানোর চেষ্টা ছিল রাজের
রাজের বাসায় অভিযানের আগে বনানীর ১৯ নম্বরের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পরীমনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার তথ্যের ভিত্তিতেই ৭ নম্বর সড়কে রাজের বাসাতে অভিযান চালানো হয়। অভিযানের খবর পেয়ে রাজ তার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে, তার বাড়ির সামনে র্যাব সদস্যদের উপস্থিতি থাকায় তিনি পালাতে পারেননি।
রাজের সঙ্গে পরীমনির ঘনিষ্ঠতা ছিল। প্রায় পরীমনির বাসায় তারা মদের আড্ডা জমাতেন। রাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মাদকের আসর বসিয়ে সেখানে আসা বিত্তবান ব্যবসায়ী ও উচ্চবিত্তের সন্তানদের ভিডিও ধারণ ও ব্ল্যাকমেলিং করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতেন।
সূত্র : ঢাকাটাইমস