কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া অঙ্গরাজ্যে বন্ধ এক আদিবাসী আবাসিক স্কুল থেকে ২১৫ শিশুর দেহাবশেষ উদ্ধারের ঘটনায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, এটি খুবই বেদনাদায়ক ও দেশের ইতিহাসে লজ্জাকর এক অধ্যায়। একটি টুইট বার্তায় তিনি লেখেন, এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। এটা আমদের দেশের ইতিহাসে একটি কালো, লজ্জাজনক আর নির্মম অধ্যায়কে মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমি এই দুঃসংবাদে প্রভাবিত সমস্ত মানুষের কথা ভেবে চিন্তিত। আমি আপনাদের জন্য আছি।
পঞ্চদশ শতকে স্পেনীয় অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন, তখন তিনি ভুলক্রমে ভেবেছিলেন যে ভারতে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান’ হিসেবে। গায়ের রঙে লালচে ভাব থাকায় সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয় আদিবাসীদের ‘রেড ইন্ডিয়ান’ জাতি নামেই চিনে আসছে বিশ্ববাসী।
কানাডার কামলুপস এলাকাটি রেড ইন্ডিয়ানদের বিভিন্ন গোত্র অধ্যুষিত। যে শিশুদের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে তারা সবাই সেখানকার টিকেমলুপস টে সেকওয়েপেমেক গোত্রভূক্ত ছিল বলে জানিয়েছেন সেই গোত্রের বর্তমান প্রধান রোসান্নে ক্যাসিমির।
শুক্রবার এক বিবৃতিতে ক্যসিমির জানান, ‘মৃতদের মধ্যে ৩ বছর বয়সী শিশুদেরও মরদেহ পাওয়া গেছে। এটা এমন এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যা কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে; এবং আরো দুঃখজনক হলো এ ধরনের নিপীড়ণের ঘটনাগুলোর কোথাও লিপিবদ্ধ হয়নি।’
দেশটির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে যখন কানাডায় দলে দলে ইউরোপীয় বসতকাররা (সেটলার) আসতে থাকে তখন স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান গোত্রগুলোর সঙ্গে তাদের বেশ কিছু সংঘাত হয়েছিল। ইউরোপীয় বসতকারদের হাতে উন্নত অস্ত্র ও প্রযুক্তি থাকায় সবগুলো সংঘাতেই শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল রেড ইন্ডিয়ানদের।
পরাজিত এই রেড ইন্ডিয়ানদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তকরণ ও ‘অধিকতর সভ্য’ করে তুলতে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে কানাডাজুড়ে বিভিন্ন আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা শুরু করে ইউরোপীয় সেটলাররা। দেশটির আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সে সময় কানাডায় ১৩৯ টি এ রকম আবাসিক স্কুল ছিল। ক্যাথলিক খ্রিস্টান মিশনারিরা এই স্কুলগুলো পরিচালনা করতেন।
প্রায় দেড় লক্ষাধিক রেড ইন্ডিয়ান, ইনুইট ও মেটিস জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের জোর-জবরদস্তি করে ভর্তি করা হয়েছিল আবাসিক স্কুলগুলোতে। স্কুলগুলোতে ভর্তি হওয়া শিশুদেরকে ব্যাপকভাবে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও জীবনযাপন নিয়ে কটাক্ষ ও ব্যাঙ্গ করাও ছিল সেই স্কুলগুলোর নিমিত শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ।
রোসান্নে ক্যাসিমির জানান, কামলুপসের যে স্কুলটি থেকে এই দেহাবশেষগুলো উদ্ধার করা হয়েছে, সেটি ছিল ১৩৯ টি আবাসিক স্কুলের মধ্যে সবচেয়ে বড়। স্কুলটিতে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ১০০ জন।
১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্কুলটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ক্যাথলিক খ্রিস্টান মিশনারিরা। তারপর কামলুপসের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এর প্রায় ১০ বছর পর ১৯৭৮ সালে স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কানাডার আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১৫ সালে জানিয়েছে, ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে দেশটিতে ইউরোপীয় সেটলাররা বসতি স্থাপনের পরবর্তী ১০০ বছরে এই আবাসিক স্কুলগুলোতে মারা গেছে ৩ হাজার ২০০রও অধিক শিশু এবং এদের প্রত্যেকেরই মৃত্যুর কারণ খাদ্যাভাব জনিত কারণে অপুষ্টি, প্রহার ও শারীরিক নির্যাতন এবং ধর্ষণ।
স্থানীয় আদিবাসীদের নির্যাতনের জন্য ২০০৮ সালে যদিও ক্ষমা চেয়েছে কানাডার সরকার। তবে গত এক শতাব্দিতে দেশটির আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোর ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, এমনটি বলার উপায় নেই।
কানাডার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটির আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলো এখনও দারিদ্র, বেকারত্ব, পারিবারিক ও গোষ্ঠিগত সহিংসতা ও উচ্চ মাত্রায় আত্মহত্যা প্রবণতার মতো সমস্যায় ধুঁকছে।