9.4 C
Toronto
বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

তীব্র শীতের বৃষ্টিভেজা রাত

তীব্র শীতের বৃষ্টিভেজা রাত
জাভেদ ইকবাল

মেয়েটা রাতে আমার কাছে ঘুমাতে এলো। তার ছোট্ট কোলবালিশটা হাতে করে। শনিবার সে আমার সাথে থাকে। ঘুমানোর আগে কত আহ্লাদ করে, গল্প করে। আমি হঠাৎ হেসে উঠতেই সে পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করলো, কী হইছে আব্বু?

– একটা মজার কথা মনে পড়ে গেলো মা..

- Advertisement -

– কী?

– তুই টিকটিকি চিনিস?

– না

– ওটা এক ধরণের লিজার্ড। ওয়াল এ হাঁটতে পারে, দৌড়াতে পারে! পড়ে যায় না! ম্যাজিক!

– ওয়াও!

– বাংলাদেশে আমরা যখন কারেন্ট চলে গেলে রাতে সবাই একসাথে খেতে বসতাম, তখন ক্যান্ডেলের আলোতে অনেক পোকা উড়ে আসতো। মাঝে মাঝে সেই পোকা ধরার জন্য টিকটিকি টেবিলে পর্যন্ত উঠে আসতো। আমার তখন সবাই হুড়মুড় করে পালাতাম খাওয়া রেখে

– হি হি।

তীব্র শীতের বৃষ্টিভেজা রাত।

চারিদিকে হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দ। জানালা একটু খুললেই শব্দ অনেক বেড়ে যেত। আমাদের বিল্ডিং এর পেছনে বিশাল কচু গাছের পাতায় পানির ফোটা পড়বার শব্দ খুব বেশি কানে বাজতো। তবে খুব শ্রুতিমধুর।

.

কত স্মৃতি! কয়েকটা শালিক মূর্তির মতো আম গাছের ডালে বসে ঝিমাচ্ছে। কার্নিশে বেশ বড় একটা প্যাঁচা বসে গম্ভীর গলায় ডাকছে। গা ছমছম করা সেই ডাক! শিমুল তুলার লেপ থেকে বের হলেই হাড়ের মধ্যে ঠান্ডা গিয়ে বিঁধে। অনেকসময় এতই ঠান্ডা লাগতো, সোয়েটার গায়েই লেপের তলায় ঢুকতাম। কী মূল্যবান সেই সোয়েটার। মায়ের হাতে বোনা। কত কষ্ট করে তিলে তিলে গড়ে তোলা সেই সোয়েটার! যেখানে ভালোবাসার কবিতা সাজানো থরে থরে, প্রতিটা বুননে!

কারেন্ট নাই। রাতে দুপুরে বেঁচে যাওয়া ডাল ভালোভাবে গরম করে, কড়াইতে ডিম্ ভাজা চলতো। কী মধুর সেই ডিনার! ডাইনিং টেবিলে সবাই খুব সতর্ক; মোমের শিখার কাছে কিছু পোকা উড়ছে, পাতে পড়লে বিপদ। আলুভর্তা আর ভাত ঠিকই টাটকা বানানো হতো। আলু ভাতের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে সেদ্ধ করা হতো। ঝাঁঝালো পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ আর সরিষার তেল দিয়ে আম্মা সিম্পলভাবে মাখিয়ে ফেলতো। সেটা হলো অরিজিনাল আলু ভর্তা। গরম গরম পেট ভরে খেয়ে নিয়ে বাইরের ঘরে সবার টেলিভিশনের সামনে অপেক্ষা। যারা লেপের ভেতর জায়গা পেতো না, তারা চাদর গায়ে সোফায় বসত। ম্যাকগাইভার শুরুর আগে অবশ্য কারেন্ট চলে আসতো। কোনো মিস নাই!

.

রাতে ঘুমানোর আগে নিজের তৈরী ছোট্ট একটা এমপ্লিফায়ারের ইনপুট-এ কয়েল এন্টেনা লাগিয়ে গ্যাং নামক ছোট্ট যন্ত্রটা ঘুরিয়ে কয়েকটা রেডিও স্টেশন এডজাস্ট করতাম। বেশিরভাগই চাইনিজ, আর কয়েকটা ভারতের কোনো চ্যানেল। যদিও অর্থ বোঝা যেতো না, তবুও নিজের বানানো রেডিও! কী আনন্দ আর বিস্ময়! যেন বিশাল কোনো আবিষ্কার! কষ্ট করে টিফিনের টাকা জমিয়ে প্রতি সপ্তাহেই ‘রেডিও সেন্টার’ নামের ইলেক্ট্রনিক্স এর দোকানে যেতাম পার্টস কিনতে। দোকানদার বাচ্চু ভাইয়ের সাথে খুব শখ্যতা ছিল। ওগুলো বিছানায় নাড়াচাড়া করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম! মেয়েরা যেভাবে পুতুল কোলে ঘুমায়!

আব্বা ক্লাস ফোর এ থাকতে জাপানী রিকো কোম্পানির চাবির হাতঘড়ি কিনে দিয়েছিল। দুইশ আশি টাকা দিয়ে। যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। এতো খুশি মনে হয় না জীবনে হয়েছি। সেটা নিয়েও চলতো গবেষণা। বারবার পেছনের ঢাকনা খুলে, ফাস্ট স্লো করে; জুয়েলগুলা দেখতাম। ইঞ্জিনে কাঁটা কোনটা কত জোরে ঘুরছে দেখতাম। বেশি গবেষণা করতে গিয়ে শেষমেশ নষ্টই করে ফেললাম! কী যে কষ্ট!

বাবা মা সবসমই চায় তার সন্তানেরা যেন কম দুঃখ কষ্টে, কম অভাব-অনটনে মানুষ হয়। কিন্তু সন্তানেরা ঠিক তাদের মতোই ডেকে, যেচে দুঃখ-কষ্ট এনে ঘর বোঝাই করে। বাবা-মা’দের মতোই একই ইতিহাস বরন করে। কেউ কোনোকিছুর উর্ধে নয়। যারা বোকা, তারা ভাবে এসব বুঝি শুধু তাদেরই জীবনে ঘটে। দুঃখ কমাতে অন্যদের বলতে গিয়ে হয় হাসির পাত্র।

.

জীবনটা ঠিক গানের মতো। যেখানে গিটার, তবলা, বেহালা, তানপুরা, হারমোনিয়াম, বাঁশি; সবকিছুর সম্মিলিত প্রয়াসেই গানটা মাধুর্য পায়। কোনো গান হয় সুখের, কোনোটা দুঃখের। একই বাঁশি থেকে কখনো বের হবে করুণ সুর, কখনো খুশির। তবে পৃথিবীতে বেশিরভাগ সংগীতই দুঃখের।

দেশে গিয়ে শেষ কটা দিনে কেন জানি বারবার সিঁড়ি উঠানামা করতাম। ছাদে যেতাম, মায়ের ঘরে বসে থাকতাম। আমার বাড়ির দরজার ছিটকিনি, রড লাইটের স্টার্টার, পর্দার লাঠি, দেয়ালের টিকটিকি, আলনার হ্যাঙ্গার; কিংবা ডাইনিং টেবিলের কর্নার ছেড়া টেবিলক্লথ; সবকিছুই ইম্পরট্যান্ট। এমন কি ওই দূরে অন্য বাড়ির উঠোনের আম গাছ, শিমুল গাছটাও। সবকিছু নিয়েই জীবনের গল্প। আমি এখনো আমার ঘরের সেই বিছানার ওম, উত্তাপ অনুভব করি। নারকেলের ছোবড়া বের হওয়া জাজিমটাও।

বিদায় নেবার মুহূর্তগুলো আমি একদম সহ্য করতে পারি না, একদম না! শুধু চোখে ভাসে ভুরু কুঁচকানো মায়ের অস্থিরতা, দীর্ঘশ্বাস। সময় যে কত মহামূল্যবান! সকাল হলেই আমাকে ঢাকার গাড়ি ধরতে হবে। মায়ের এক গ্লাস পানি ঢেলে দেবার মাঝেও এতো মায়া? এক কাপ চা যেন হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার আধার। আর শেষ আলিঙ্গন? সেটা অপার্থিব। যেখানে আছে জীবনের সবচাইতে বাস্তব আর অর্থবহ আশংকা, অর্থবহ ভালোবাসা। আবার দেখা হবার বাসনা কিংবা না হবার শংকা। কী যে অসহ্য, যন্ত্রনাকাতর সেই মুহূর্ত!!

তারপর! ঝকঝকে যান্ত্রিক একটা অতিকায় দানব মায়ের বুক খালি করে তার সন্তানকে কেড়ে নিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাবে সেই সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে; দ্বিতীয় আবাসে! হায় আমাদের আবাস! নাড়ি ছিঁড়েও আমরা নতুন আবাস খুঁজতে হয়? কত মর্মান্তিক!

মা, তুমি একটু নড়েচড়ে বসো তো? তোমাকে চাঙ্গা, সুস্থ থাকতেই হবে। তুমি জানো না তোমাকে আমাদের কত প্রয়োজন। তুমি ঠিক সূর্যের মতো। তোমাকে ঘিরে, গ্রহগুলোর মতো আমাদের আনাগোনা। তোমার আলোয় আমরা আলোকিত। না হয় কিছুই করতে পারি না; শুধু নিজ স্বার্থ নিয়েই আমাদের ভাবনা…। সূর্য না থাকলে গ্রহগুলো কার ভরসায় ভাসবে?

অনন্তকাল তুমি আমাদের শক্ত করে বেঁধে রেখো তো মা? তোমার আঁচলে?

খুব শক্ত করে!

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles