4 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

কবরী > আমার প্রথম নায়িকা

কবরী > আমার প্রথম নায়িকা
অনন্তযাত্রা শান্তিময় হোক প্রিয় কবরী

আমার ছেলেবেলাটা ঝাপসা আর ধুসর হয়ে যাচ্ছে। ঝাপসা আর ধুসর হয়ে যাচ্ছে আমার কৈশোরটা। আমার যৌবনটা। আমার বর্ণালি শৈশব আর স্বর্ণালি যৌবনের অংশীরা একে একে চলে যাচ্ছেন। আমি একা হয়ে যাচ্ছি।

ডানা ঝাপটাচ্ছে আমার স্মৃতির জোনাকিরা। ক্রমশ নিভে যাচ্ছে তাদের থোকা থোকা আলো। আমাকে ছেড়ে যাচ্ছেন আমার বর্ণাঢ্য জীবনে দীপ্তি ছড়ানো অপরূপ মানুষগুলো।

- Advertisement -

আজ সারাদিন আমি স্মরণ করেছি কবরীকে। আমার জীবনের প্রথম নায়িকাকে।

আমার মোবাইল ফোনে ইউটিউব যুক্ত আছে। আর মোবাইলের সংগে যুক্ত আছে ৬০ইঞ্চি আকারের টিভি পর্দা। সেখানে সারাদিন ধরে কবরীর লিপে জুড়ে থাকা একের পর এক মন প্রসন্ন করা পুরনো দিনের বাংলা সিনেমার বিখ্যাত গানগুলো শুনছিলাম আর দেখছিলাম। আহা কী সুন্দরই না ছিলেন কবরী!

আজ দিনভর আমার টিভিস্ক্রিনে সচল ছিলো যে গানগুলো, আমি নিশ্চিত–আমার পাঠক বন্ধুদের বিরাট একটা অংশই সেই গানগুলোর অনুরাগী। তালিকাটা ছিলো এরকম—

ফুলের মালা পরিয়ে দিলে আমায় আপন হাতে(আগন্তুক),

গুন গুন গুন গান গাহিয়া নীল ভ্রমরা যায়, সেই গানের টানে ফুলের বনে ফুলের মধু উছলায় উছলায়(সুজন সখী),

গান হয়ে এলে, মন যেনো বলে, সারাবেলা এতো সুর নিয়ে, নিজেরে কেমনে বলো রাখি লুকিয়ে(নীল আকাশের নীচে),

সে যে কেনো এলো না, কিছু ভালো লাগে না, এবার আসুক তারে আমি মজা দেখাবো(রংবাজ),

প্রেমের নাম বাসনা সে কথা বুঝি নি আগে(নীল আকাশের নীচে) এবং–

মনেরও রঙে রাঙাবো, বনেরও ঘুম ভাঙাবো, সাগর পাহাড় সবাই যে কইবে কথা(মাসুদ রানা)।

০২

মাত্র ক’দিন আগেই লিখেছিলাম আমার প্রথম নায়িকার স্মৃতিকথা। ওখান থেকে খানিকটা উদ্ধার করি–

[ ”ঊনিশ শ চৌষট্টি সালে ‘সুতরাং’ নামে একটা সিনেমা রিলিজড হলো গুলিস্তানে। আমি তখন খুব ছোট। ৫/৬ বছরের বালক।

রেডিওতে সুতরাং সিনেমার একটা গান তখন মাঝে মধ্যেই বাজে। গানটা ছিলো–‘এমন মজা হয় না/গায়ে সোনার গয়না/বুবুমনির বিয়ে হবে/ বাজবে কতো বাজনা।’

বাবার কাছে বায়না ধরলাম–আমাকে সুতরাং সিনেমাটা দেখাতে নিয়ে যেতে হবে।

বাবা রাজি হলেন। নিকটবর্তী একটা শুভ দিন নির্ধারিত হলো।

অফিস থেকে বিকেলে ফেরেন বাবা। সিদ্ধান্ত হলো আমাকে নিয়ে যাবেন সন্ধ্যার শো দেখাতে।

নির্ধারিত দিনে দুপুরের পর থেকেই ফিটফাট বাবুটি সেজে আমি তৈরি হয়ে থাকলাম। সেদিন বাবা ফিরলেন রাতে। আমি তাঁর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এক বুক অভিমান নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। রাত ন’টার পর বাড়ি ফিরে আমাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে বাবা যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।……। বাবা আমাকে টেনে তুললেন। বললেন–কাল অবশ্যই নিয়ে যাবো। সন্ধ্যা ৬টার শোতে যাবো। তুই রেডি থাকিস।

পরদিনও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত অবষণ্ণ হয়ে এক বুক অভিমান নিয়ে আটটার পর সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লাম। বাবা ফিরলেন সাড়ে আটটায়। বিছানা থেকে ঘুমিন্ত আমাকে তড়িঘড়ি টেনে তুলে একটা রিকশায় বসিয়ে বাবা চললেন গুলিস্তান সিনেমা হলের দিকে। ছোট্ট বালক আমার মনে তখন একশোটা পঙ্ক্ষিরাজ আর দুইশোটা রাজহাঁস ডানা ঝাপটাচ্ছে।

গুলিস্তান হলের সামনে ঝুলছে বিশাল হোর্ডিং(হোর্ডিংই তো নাকি?) সুতরাং। চিত্রনাট্য পরিচালনা সুভাষ দত্ত। সঙ্গীত সত্য সাহা। শ্রেষ্ঠাংশে–কবরী, রানী সরকার, মেসবাহ, বেবী জামান, খান জয়নুল, সুভাষ দত্ত।

মুগ্ধ বিস্ময়ে আমি বিশাল পর্দায় ফ্রক পরা এক বালিকাকে নেচে নেচে গাইতে দেখলাম–এমন মজা হয়না/ গায়ে সোনার গয়না/ বুবুমনির বিয়ে হবে বাজবে কতো বাজনা/…ও বুবু দ্যাখ দুলাভাইয়ের কত্তো বড় দাড়ি/ তার সঙ্গে কালকে যাবি মজার শশুর বাড়ি…।

শাদাকালো সিনেমা সুতরাং-এর কবরী নামের কিশোরী নায়িকাটি আমার মন জয় করে নিলো। আহা কী সুন্দর তার হাসি!”]

সুতরাং চলচ্চিত্রে তাঁর অভিষেকের সময় চট্টগ্রামের মীনা পাল নামের কিশোরী মেয়েটির নতুন নামকরণ হয়েছিলো কবরী। নামটি রেখেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক।

০৩

তাঁর চেহারা তাঁর হাসি তাঁর শারীরিক গঠন ব্যক্তিত্ব আর অনিন্দ্য সুন্দর রূপ সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন ‘পাশের বাড়ির মেয়েটি’র মতো স্নিগ্ধতার আবেশ ছড়ানো।

সব পোশাকেই মানানসই ছিলেন। অনন্দ্যসুন্দর হাসির কারণে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিশেবে।

মিষ্টি মেয়ে কবরীর সঙ্গে দোতলা চুলের সুদর্শন রাজ্জাকের জুটি বাংলাদেশের সেরা জুটি হিশেবে আজও প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের কাছে এই জুটি ছিলো অনেকটা উত্তম-সুচিত্রা জুটির মতোই আপন। কবরীর আহ্লাদী কণ্ঠস্বরটি ছিলো বাঙালির খুবই প্রিয় একটি কণ্ঠস্বর। কবরীর ভুবনজয়ী হাসিটি ছিলো বাঙালির মন প্রসন্ন করা হাসি।

কবরী হাসলে আমিও আমার দুঃখ ভুলে যেতাম নিমেশেই!

বিরামহীন ‘কবরীর গান’ শোনা শেষ করে দেখতে বসলাম কবরী-রাজ্জাক জুটির সাড়া জাগানো সিনেমা ‘ময়না মতি’। ময়না মতি দেখতে গিয়ে বুকের মধ্যে কঠিন একটা ধাক্কা খেলাম।

১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ময়না মতি চলচ্চিত্রের প্রায় সব শিল্পী-কুশলীই মারা গেছেন বলতে গেলে!

এই সিনেমায় অভিনয় করা শিল্পী রাজ্জাক, কবরী, আনোয়ার হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, ইনাম আহমেদ, জাভেদ রহীম, চিত্ত চৌধুরী, রহিমা খালা, জরিনা, ওয়াহিদা, সবিতা, হাসমত, রওশন আরা–সবাই আজ মৃত! মারা গেছেন এই সিনেমার শিল্পী কৌতুক অভিনেতা সাইফুদ্দিন, খান জয়নুল, আবদুল জলিল, টেলি সামাদ, পরান বাবু এবং আবুল!

ময়নামতির নেপথ্য কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে মারা গেছেন বশীর আহমেদ, মঞ্জুশ্রী রায় এবং আনোয়ার উদ্দিন খান!

মারা গেছেন ময়না মতির পরিচালক–কাজী জহির! মারা গেছেন এই সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক–বশীর আহমেদ, এবং কাহিনী সংলাপ ও গীত রচয়িতা–সৈয়দ শামসুল হকও!

আহা কী বিষণ্ণ থোকা থোকা নাম!

কবরী স্মরণে আজ নতুন করে ময়নামতি সিনেমাটি দেখবার সময় বারবার আমি বেদনার্ত হয়েছি। আমার শৈশব কৈশোর আর যৌবনকে রাঙিয়ে দেয়া এইসব প্রয়াত সংস্কৃতিজনদের ঝলমলে প্রাণবন্ত উপস্থিতি আমাদের লিভিং রুমের ভেতরটা কুয়াশাচ্ছন্ন করে ফেলছিলো বারবার! সবাইকে ছাপিয়ে বারবার অশ্রুসজল হয়েছি কবরীকে দেখে। কেনো এমনটা হলো? কবরী আমার কে ছিলেন? কী সম্পর্ক ছিলো তাঁর সঙ্গে আমার!

অই যে আগেই বলেছি, সুতরাংকাল থেকেই কবরীই আমার প্রথম নায়িকা! পরে আমি বড় হয়েছি দিনে দিনে। পত্র-পত্রিকা আর বিটিভির কল্যাণে আমার নাম আর চেহারাটা মোটামুটি পরিচিত ছিলো। তখন সামনা সামনি দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। তিনি আমাকে আপনি সম্বোধনে কথা বললে আমি বাঁধা দিয়েছিলাম, না আপা তুমি করে বলুন। আপনি আমার শৈশবের নায়িকা। কিন্তু তিনি সেটা মানতে চাননি–আপনি আমাদের দেশের বিখ্যাত ছড়াকার। আপনাকে তো আমি তুমি করে বলতেই পারি না রিটন!

২০০৬/২০০৭ সালে স্বামীসহ কানাডার টরন্টো শহরে এসেছিলেন কবরী। আমি অটোয়ায় থাকি তাই আমার সঙ্গে দেখা হয়নি তাঁর। ২০০৮/২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা হলে যখন জানলেন আমি কানাডায় থাকি তখন টরন্টোর এক মাঝারি লেখকের নাম বলে জানতে চেয়েছিলেন–চিনি কি না ওকে। বলেছিলাম চিনি। আমাকে চমকে দিয়ে কবরী আপা বলেছিলেন–ও তো একটা নরকের কীট! জানেন টরন্টোয় আমার স্বামীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নষ্ট করতে কী জঘন্য ভূমিকা সে রেখেছিলো বন্ধুর বেশে! কবরীকে নিয়ে আজ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের একটি স্মৃতিগদ্যে সেই ঘটনার বয়ান দেখলাম।

শেষদিকে কবরী কেমন পালটে যাচ্ছিলেন দিন দিন। কথায় আচরণে খানিকটা বেপরোয়া ভঙ্গি। বিশেষ করে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে এম্পি হবার পর সেটা বৃদ্ধি পেয়েছিলো দৃষ্টিকটু ভাবে। সিনিয়র পরিচালক চাষী নজরুল কিংবা আমজাদ হোসেন কিংবা নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে টিভির টকশোতে এসে রীতিমতো ধমকের সুরে কথা বলতেন। কবরীকে সমঝে চলতেন তাঁরা সবাই।

এক জীবনে চলচ্চিত্রজগতের মানুষেরা তাঁর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কবরীর সঙ্গে যে সীমাহীন অন্যায় আচরণ করেছেন দিনশেষে কবরী মনে হয় তারই শোধ তুলতেন। কেউ তাঁকে ঘাঁটাতো না।

জীবন তাঁকে সুখ আর স্বস্তি দেয়নি।

আক্ষেপ করে কবরী বহুবার বলেছেন–সারা জীবনে একজনও ভালো বন্ধু তিনি পাননি।

শিল্পীরা বোঝেন না যে এম্পি কিংবা মন্ত্রী হওয়াটাই জীবনের সবচে বড় সাফল্য নয়। এটা হতে গিয়ে তারা রাজনৈতিক দল আর রাজনীতিবিদদের দাসানুদাসে পরিণত হন। কবরী তাঁর শেষ জীবনে সেটাই ফের জানিয়ে গেলেন সবাইকে।

০৪

সন্ধ্যায় কবরী অভিনীত ‘সুজন সখী’ সিনেমাটা দেখলাম। আহা, সুজন ফারুক আর সখী কবরী জুটির মহা জনপ্রিয় এই সিনেমাটা দেখতে গিয়ে যুগপৎ আনন্দ ও বিষাদে ভারাক্রান্ত হলো মন। দু’দিন আগে সখীরূপী নায়িকা কবরী মারা গেছেন! যে মুহূর্তে সখী মারা যাচ্ছেন সেই মুহূর্তে সিঙ্গাপুরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন সুজন অর্থাৎ নায়ক ফারুক!

জীবন কতো রহস্যময়! কতো নাটকীয়তায় ভরা! নিজে করোনায় আক্রান্ত হবার সময় সখী জানতেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে তাঁর সুজন। কিন্তু সুজন জানতেই পারেননি তাঁর সখী চলে গেছেন চিরদিনের জন্যে!

আপনার অনন্তযাত্রা শান্তিময় হোক প্রিয় কবরী।

অটোয়া ১৮ এপ্রিল ২০২১

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles