দেশে ভোর শুরু হবার আগ থেকেই প্রকৃতি জেগে উঠতে থাকে।
ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাসে ভাসে পাখির ডাকাডাকি, শিউলী, বুনো লতা বা ভাঁট ফুলের মিষ্টি গন্ধ। রোদের তাপে ঘাসের ডগায় শিশির কণার বাষ্পীভূত ভ্যাপসা গরমের শুরু। মাটির চুলোয় পাট কাঠি পোড়ানোর ধোঁয়া, পুকুর পানির আঁশটে গন্ধ, ধান সেদ্ধর বুক ভরা ঘ্রাণ।
রান্নাঘর হয়ে উঠতে থাকে পরিবারিক মিলনমেলা।
উঁকি-ঝুঁকি মারা শুরু। পাতলা রুটি মানেই পটল, বেগুন বা মিষ্টি কুমড়া ভাজি। কেউ আবার খুঁজবে ভাত ভাজি। যারা পান্তা খাবে, তারা যোগাড় করতে থাকে কাঁচামরিচ, ঝাঁঝালো পেঁয়াজ, ঘন ডাল। কেউ আবার আগভাগেই খাবার পর্ব শেষ করে অপেক্ষা করে চায়ের জন্য।
আমার মতো।
সকাল এগারোটা নিয়ে আসে প্রচুর বাদাম দেয়া ঝাল চানাচুর, সিঙ্গারা, মিষ্টি বিচি কলা। আর কনডেন্সড মিল্কের সুমিষ্ট চায়ে চুমুক দিয়ে খবর দেখা।
টাইম ফুল নিয়ে আসবে ঝকঝকে রৌদ্রকরোজ্জ্বল চোখ ধাঁধানো দুপুর। নয়নতারাগুলো তীর্থের কাকের মতো চোখ মেলে থাকবে বৃষ্টির অপেক্ষায়। পুকুর ডোবার হেলেঞ্চা শাকের ডগায় বসে ধরাধরি খেলবে এক ঝাঁক ফড়িং। মাছরাঙাগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর ঐ দূরের কারেন্টের তারে বহুক্ষণ ধরে বসে বসে কি জানি ভাববে একটা নিঃসঙ্গ ঘুঘু।
খিদে আসতেই তড়িঘড়ি করে গোসল সেরে কড়া রোদে কাপড় মেলে দিয়ে অনেক আশা নিয়ে তাকাবো আকাশের দিকে; পশ্চিম কোণে যদি কালো একটুকরো মেঘের দেখা পাই!
আহা..
খাবার টেবিলে আবার সবাই একত্রিত।
আগুন গরম মসুরের ডালে ডুবন্ত জাহাজের মতো কাঁচা আমের ফালি। লাল শাক খুঁজে ফেরে কড়কড়ে আলুভাজি। সজনে ডাঁটা দিয়ে কাঁঠাল বিচি চচ্চড়ি আর কিছু ছোট সাইজের লালচে সুমিষ্ট চিংড়ি দেখে মনে হবে যেন কুঞ্জলতা বারান্দার গ্রীল আঁকড়িয়ে ঝুলছে। কুড়মুড়ে ভাজা পুঁটি মাছও অপেক্ষারত; কখন সাদা ধবধবে ভাতের বালিশে মাথা রাখবে..
.
খাওয়ার শেষ পর্যায়েও বাকি থাকবে থালা ভর্তি ডাল।
কেউ কেউ আবার আয়েশ করে থালা কানায় কানায় ডাল দিয়ে ভরে নেবে। প্রথম চুমুকে সার্ফেস থেকে মুখে ছুটে আসবে বাগাড় দেয়া পেঁয়াজের ভাসমান বেরেস্তা, রসুন ভাজা। জোয়ারের পানি ধীরে ধীরে নেমে যেতেই উঁকি দেবে কিছু চিংড়ি খন্ড, কিছু কাঁঠাল বিচির ভগ্নাংশ, লাল শাকের ধ্বংসাবশেষ আর ভাত। সবকিছু আঙ্গুল দিয়ে গুছিয়ে আবার থালা উঁচু..
.
.
সৌভাগ্যক্রমে হয়তো দেখা মিলবে প্রত্যাশিত মেঘের।
বিকাল নিয়ে আসবে প্রচুর কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, সর্ষে তেল দিয়ে মুড়ি মাখানো। বৃষ্টি নিয়ে আসবে সোঁদা মাটি, কদম, মাধবীলতা, কাঠগোলাপ, গন্ধরাজের সুবাস। দমকা বাতাস উপহার দেবে ভাঙা নিমগাছের পাতাযুক্ত শাখা, কৃষ্ণচূড়া দেবে ফুলসহ ডাল। বিদ্যুৎবিহীন সন্ধ্যা উপহার দেবে রহস্যময় ক্ষণ!
.
ঝড় থামলে হাসনাহেনা আর কামিনী নিয়ে আসবে সন্ধ্যার নেশা ধরানো একাকিত্ব। কিশোর কিশোরীরা পছন্দের কাউকে কাছে পাবার তীব্র আকাংখা, নেশায় ডুবে যেতে থাকবে। মিথ্যে অনুরাগ আর অভিমানের ডালা খুলে বসে ইনিয়ে-বিনিয়ে কত-শত অভিমান নিয়ে চোখের পানি ফেলবে! কেউ বা পরীক্ষার পড়া মুখস্ত করতে ব্যস্ত।
.
বাবা মায়েদের ব্যস্ততা কখনও কমে না। বাবা আরেকদফা বাজার নিয়ে ঢুকবে, মা যত্ন করে গুছিয়ে রাখবে। বাবারা নিয়ে বেড়ায় এক গাদা দায়িত্ব। আর মায়ের আঁচলে বাঁধা অফুরন্ত মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা।
.
তারপর আবার সব শান্ত।
ঠান্ডা বাতাস, তারা ভরা আকাশ।
কাঁথা, চাদর, মশারি, আরাম ঘুম।
কি যে এক প্রশান্তি!
অটোয়া, কানাডা