জীবিকা নির্বাহের জন্য রাজধানী ঢাকায় রিকশা চালাতে এসে বনে যান ‘ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্সার কামরুল’। প্রতিষ্ঠা করেন একটি ড্যান্স ক্লাব। যেটির আড়ালে শতাধিক নারীকে দেশের বাইরে পাচার করেছেন তিনি ও তার চক্রের সদস্যরা। শনিবার দুপুরে এ বিষয়ে র্যাব-৪ এর প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন হয়।
ওই সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডর খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তারকৃত কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল চক্রটির মূলহোতা। এই চক্রের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানব পাচার মত অপরাধ করে আসছিলো। তারা দেশের বিভিন্ন জেলা হতে কমবয়সী মেয়েদের প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে এবং প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করত। প্রথমে চক্রটি ভিক্টিমদের ড্যান্স শিখানোর নামে প্রত্যন্ত অঞ্চলের থেকে সুন্দরী মেয়েদের ঢাকায় নিয়ে আসত। তাদেরকে বেপরোয়া জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে ফেলা হত। পরবর্তীতে তাদের পার্শ্ববর্তী দেশে বিভিন্ন চাকুরীর কথা বলে প্রলুব্ধ করে পাচার করতো। এইভাবে এই চক্রটি গত ২-৩ বছরে প্রায় শতাধিক মেয়েকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে।
ভিক্টিমদের পার্শ্ববর্তী দেশে মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ লোভনীয় চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করত। মূলত পার্শ্ববর্তী দেশে অমানবিক এবং অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে তাদের পাচার করা হতো। এই চক্রটি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে বলে জানিয়েছ র্যাব।
গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের কথা উল্লেখ করে র্যাব জানায়, ভিক্টিমদেরকে সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। এই চক্রের সাথে পার্শ্ববর্তী দেশের সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশের চক্রের সদস্যরা ভিক্টিমদের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে। অতঃপর বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন শহরে/প্রদেশে অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে বিক্রয় করে দিত। এরপর থেকে ভিক্টিমদের আর কোন সন্ধান পাওয়া যায় না।
কে এই ডিজে কামরুল?
গ্রেপ্তারকৃত মোঃ কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল ২০০১ সালে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় পাড়ি জমায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সে বাড্ডা এলাকায় রিকশা চালক হিসেবে জীবিকা শুরু করে। কিছুদিন পর সে একটি কোম্পানির ডেলিভারি ভ্যান চালক হিসেবে কাজ নেয়। তারপর সে ড্যান্স গ্রুপের সাথে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সে হাতিরঝিল এলাকায় ‘ডিজে কামরুল ড্যান্স কিংডম’ নামে একটি ড্যান্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। উক্ত ড্যান্স ক্লাবের মাধ্যমে সে বিভিন্ন উঠতি বয়সী মেয়েদের বিনোদন জগতে প্রবেশের নামে প্রলুব্ধ করত। একপর্যায়ে তাদের উচ্চ বেতনে চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করত।
পাশের দেশে ডিজে কামরুলের গোপন সখ্যতা
গ্রেপ্তারকৃত কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল বেশ কয়েকবার পার্শ্ববর্তী দেশে ভ্রমণ করে। পার্শ্ববর্তী দেশের নারী পাচারকারী চক্রের সাথে গোপনে সখ্যতা গড়ে উঠে। ২০১৯ সালে এপ্রিল মাসে সে তার ড্যান্স ক্লাবের এক নারীকে পার্শ্ববর্তী দেশের বিউটি পার্লারে বেশি বেতনে চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে। ওই ঘটনায় ভিক্টিমের বোন তার বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করলে, সে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাড্ডা থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। ওই মামলায় ৩ মাস কারাগারে ছিল এই কামরুল। পরবর্তীতে জামিনে বেরিয়ে আবারও নারী পাচারের কাজে লিপ্ত হয়।
নারীদের সেইফ হাউজ, নেপথ্যে আরও যারা
চক্রটি প্রলোভনের শিকার নারীদের পরিকল্পনা মোতাবেক বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায় অবস্থিত সেইফ হাউজে অবস্থান করাত। পরবর্তীতে সেইফ হাউজে থাকা অবস্থায় তাদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হত। এরপর সুবিধাজনক সময়ে এই চক্রের সদস্যরা নারী ভিক্টিমদের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। এই চক্রের গ্রেপ্তারকৃত রিপন, সেলিম এবং শামীম নারী পাচারের অবৈধ কাজে মূলহোতাকে সহায়তা প্রদান করত বলে স্বীকার করে।
পাশের দেশের দালালদের ‘ওকে রিপোর্ট’
গ্রেপ্তারকৃত রিপন মোল্লা ডেলিভারী ম্যান হিসেবে কাজ করে। সে মূলহোতার পক্ষে মানবপাচারে পার্শ্ববর্তী দেশের দালালের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। সে পাচারযোগ্য নারীদের ছবি পার্শ্ববর্তী দালালের কাছে পাঠিয়ে দেয়। পার্শ্ববর্তী দেশের দালালদের ‘ওকে রিপোর্ট’ অনুযায়ী পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করা হত।
গ্রেপ্তারকৃত মোঃ আসাদুজ্জামান সেলিম বর্তমানে উত্তরা এলাকায় ব্যবসা করে এবং পাশাপাশি মূলহোতা কামরুলের মানব পাচারসহ অন্যান্য অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করত। গ্রেপ্তারকৃত নাইমুর রহমান ওরফে শামীম সীমান্ত এলাকায় সেইফ হাউজ পরিচালনা, অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার ও পার্শ্ববর্তী দেশের দালালের কাছে ভিক্টিমদের হস্তান্তর করে।