-0 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

মা দিবস এবং এক অলৈাকিক হলুদ আলো

মা দিবস এবং এক অলৈাকিক হলুদ আলো
এই যে আমার মা চলে গেলেন কত বছর হয়ে গেলো আজও মায়ের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি কত স্মৃতি ভীড় করে আসে মনে


এক অদ্ভুত আলো আঁধারি সময় পার করছি তখন আমি। এক একটা সময় আসে মানুষের জীবনে। এ রকম হয়। মানুষ যে আসলে কত অসহায় তা বোঝা যায় কখনও কখনও। কেমন শূন্য করে দিয়ে যায় সবকিছু। এই যে মানুষ জন্মাচ্ছে পৃথিবীতে, বেঁচে থাকছে, কাম-ক্রোধ-লোভের হাত ধরে চলেছে এরা তো আসলে জানেনা কেনো জন্ম, কেন এই জীবন, মৃত্যুই বা কেন! তাই পৃথিবীতে রয়েছে সবসময় এক ঘোর অন্ধাকার, কিন্তু মানুষ সেটা বুঝতেই পারে না। তাদেরই মন থেকে অন্ধকার ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীতে। যতটুকু দেখে মানুষ ততটুকু আসলে কিছু নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু যা সে দেখতে পায় না। মানুষের বেদনাগুলোও তাই। দেখা যায় না। আপনজন হরানোর বেদনা বিশেষ করে মা-বাবা বা সন্তান হারানোর বেদনা যে কত তীব্র তা যে হারায় সেই অনুভব করে।

এই যে আমার মা চলে গেলেন কত বছর হয়ে গেলো। আজও মায়ের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি। কত স্মৃতি ভীড় করে আসে মনে। পেয়ারাতলার ছোট্ট খুপরি রান্নাঘরটায় মা নিশ্চল বসে থাকতো। একটু কুঁজো হয়ে কেমন ছেলেমানুষের মতো বসবার ভঙ্গি ছিল মা’র। যেন কোনও কিশোরীবেলার চিন্তায় বিভোড়। সারাদিন কাঠকুড়নির মতো কুঁজো হয়ে হয়ে মা সারা ঘর ঘুরে বেড়ায়, খুঁজে খুঁজে ময়লা বের করে ঘর থেকে, বার বার সামান্য জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখে, বিছানার চাদর টান করে অকারণে, তারই ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ শূন্য হয়ে যায় মার চোখ, শিশুর মতো বোকা হয়ে যায় তোবড়ানো মুখ। যেন চার দিকের এই ঘড়বাড়ি. ছোটখাটো জিনিসপত্র, এই ছোট্ট সংসার- এর কোনও কিছুর অর্থই মা বুঝতে পারে না। হাঁটু মুড়ে ছোটখাটো হয়ে মা সবসময় ঘুমোতো, নিঃসাড় সেই ঘুম, আর মাঝে মাঝে সেই মুখে একটু একটু হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে যেতো। তখন মনে হয় মা স্বপ্ন দেখছে- সেই কিশোরীবেলার স্বপ্ন। এক দূর গঞ্জ কিংবা গাঁয়ের স্বপ্ন, যার সঙ্গে এই চারপাশের জীবনের লক্ষ লক্ষ মাইলের তফাত।

- Advertisement -


অপরাহ্নে এক-একদিন উঠোনে একটা অদ্ভুত আলো এসে পড়ত। শালিখের পায়ের মতো হলুদ তার রং। পাঁচালির ছায়া ঘর ছাড়িয়ে অর্ধেক উঠোন পর্যন্ত চলে যায়। পেয়ারা গাছে ফিরে আসে পাখির ঝাঁক। সেই অলৌকিক হলুদ আলো-আঁধারিতে মা কুঁজো হয়ে সড়সড় করে উঠোন ঝাঁট দেয়, বিড় বিড় করে কী যেনো কথা বলে নিজের সঙ্গে। ঝাঁট দেওয়া শেষ হলে মা ঘটি থেকে পানি ছিটিয়ে দেয় সারা উঠোন। ঠিক সেই সময় দূরে কোথাও বাচ্চা ছেলেদের খেলা ভাঙে- তাদের হাসি চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। কোথা থেকে উঠোনে এসে পড়ে বিষন্ন সব ছায়া আর ছায়া। ভেজা মাটির গন্ধ মন্থর বাতাসে ভারী হয়ে ওঠে। তখন মা ডেকে বলে যা, ঘরে যা, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তখন অপরাহ্নের নিঃশেষ আলোয়, দীর্ঘ গাঢ় ছায়ার দিকে চেয়ে থেকে বহুদুরের এক নিস্তব্দতার কন্ঠস্বর শোনা যায়। তখন ছোট্ট উঠোনটায় শব্দহীন ভাবে শেষ হয়ে যায় এক একটা দিন।
দিন যায়। এভাবেই আমার দিন যায়। মা চলে যাওয়ার পর আমি কেমন নির্ভার হয়ে গেছি। নিজেকে কেমন হালকা মনে হয়। পাখীর পালকের মতো। যখন মা ছিলো তখন কত চিন্তা ছিল মাকে নিয়ে। নিয়ম করে ফোন করতে হবে, ছুটি ছাটার জন্য চেষ্টা করতে হবে। সেলের টিকেট খুঁজতে হবে। মাঝে মাঝে ফোন করা হয়ে উঠতনা। অকস্মাৎ মনে হয় আরে অনেকদিনতো মার সাথে কথা হয় না! শেষ কিছু দিন আমার কথা মা কিছুই শুনতে পেতো না। এই অবস্থায়ই চলে গেলো মা। ওই ছোট্ট ঘরটায় মা আর নেই। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি মা শুয়ে আছেন। মা যে নেই সেই দৃশ্য আমি দেখিনি। আমার কল্পনায় এখনও মা আছেন। তাই ওই শূন্য ঘরের বেদনার্ত হাহাকার অনুভব করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমি সহ্য করতে পারবো না ওই শুন্যতা।


আমি ফোন করি, মা কেমন আছেন! মা বলতেন ভালো নেই। আমি ভালো নেই।
মা ভালো নেই, ভাল থাকার কথাও নয়। শেষ দিকে লাম্বাগো আর বাতে প্রায় পঙ্গু মা ভাল করে হাঁটাচলা করতে পারতো না, প্রায় সময়েই হামাগুড়ি দিয়ে কাজকর্ম করে। মনে আছে অনেক বড় হয়েও আমি মায়ের কাছে ঘুমিয়েছি। শিশুকালে মায়ের বুকের মধ্যে ঘুমানোর অভ্যাস ছিল আমার। বছরান্তে যখন মাকে দেখতে যাই প্রতিবার মনে হয় মার চেহারা আরো পাল্টে গেছে। আরও রোগা কিংবা বুড়ো হয়ে গেছে। মনে হয় যেন মা আরও বোকা হয়ে গেছে। মুখটা সামান্য খোলা, ভ্যাবলা একটা বোধবুদ্ধিহীন দৃষ্টি তার চোখে। আমাকে দেখে নীচের ঠোঁটটা আবেগে সামান্য কাঁপছে। মা তাকিয়ে থাকে। রোগা দুটো হাতে ভর দিয়ে বিছানা থেকে মা উঠবার চেষ্টা করে। একবার কোথাও বসলে মা আর সহজে দাঁড়াতে পারে না, কোমড়ে রস জমে যায়। মা কাপড়ের আঁচলে চোখের পানি মোছে। দৃশ্যটা কতবার দেখা।

অনেক ছোটখাটো কারণেও মাকে অনেকবার কাঁদতে দেখেছি। সব কান্নাই দুঃখের না। সুখেও মানুষ কাঁদে। কষ্টেসৃষ্টে নরবড়ে শরীরটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় মা, ফোকলা তোবড়ানো মুখে অদ্ভুত একটু হাসে। মা যে ঘরটায় থাকে তার খোলা জানালার ওপর সতেজ একটা পেয়ারার ডাল এসে পড়েছে। সিলিঙে ঘুরছে ফ্যানটা। দেয়ালে সেই সূর্যাস্ত আর তিনটে ডিঙি নৌকোর ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার। আমি আচ্ছন্নের মতো মায়ের ঘরটা দেখি। শেষ কয়েকটা মাস মা একেবারেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল। সেটা ছিল কষ্টকর।

যখন কর্মক্ষম ছিলেন তখন মা একাই রাজ্যের কাজ করেছেন। মার যেনো দশটা হাত ছিল। সবকিছু সামলেছেন। মনে পড়ে মা সবসময় আমাকে একটা বাড়ির কথা বলতেন। এটা মায়ের একটা অবসেশন ছিল। বলতেন একটা বাড়ি করবি জলপাই তলায়, পুরো চোদ্দ কাঠা জমির ঘেরওলা, ছ’টা আম, চারটে কাঁঠাল, একটা ডুমুর, সজনে, দশটা সুপুরি আর দশটা নারকোল গাছ লাগাবি, পিছনে থাকবে কলার ঝাড়। কুঞ্জলতা আমার বড় পছন্দ, বুঝলি! বেড়ার গায়ে গায়ে লতিয়ে দেব। তুই তো সিম খেতে ভালবাসিস- একটু সিমের মাচান করবি, গোয়ালঘরের চালের ওপর লকলকিয়ে উঠবে লাউডগা। আরো কত কি বলতেন যার কোনো অর্থ নেই। পারস্পর্যহীন আলতু ফালতু কথা। তাই আমি মন দিয়ে শুনতাম।

মা মারা যাওয়ার পর প্রায় রাতে ঘুম হত না আমার। এখনও এমন হয়। একদিন অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। দেখি.. রেলগাড়ির একটা কামরায় একা খুব দুরে কোথাও যাচ্ছি। হঠাৎ টের পাই রেলগাড়ি থেমে আসছে। বাইরে ধীরে গম্ভীর গলায় কেউ হেঁকে বলছে কিছু। যেনো আমার জন্যই ওই ডাক, ওউ নামোচ্চারন। হঠাৎ খেয়াল হয় এইখানেই নামার কথা, এইখানেই যাত্রা শেষ, এই অদ্ভুত ষ্টেশনে। দেখা যায় গভীর চরাচর, প্ল্যাটফর্ম নেই, স্টেশনের বাতি নেই, লোকজন নেই। শুধু খুব লম্বা কালো পাথরের মতো চেহারার একটা লোক একটা মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমার জন্যেই। যন্ত্রের মতো কিছু বলছে। তার মশালের আলো শরীরের মস্ত ছায়াকে নিয়ে দুলছে। মশালের আলো পড়েছে ধান কেটে নেওয়া খেতে, আলের ওপর বর্ষার ব্যাঙ ডাকছে, সেই ডাক শূন্য মাঠগুলিকে আরো শূন্য করে দিচ্ছে। এখানেই নেমে যেতে হবে। এই স্টেশনে। দেখি মা দাঁড়িয়ে আছে আমার অপেক্ষায়। স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। কষ্টে বুক ভেঙ্গে যায় আমার..।

মায়ের কথা মনে পড়লে অস্থির লাগে আজও। কান্না পায়। ঘরে মন বসে না কিছুতেই। লিখতে পারি না। লিখতে বসলেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পুরনো লেখা পড়ে কাঁদি। শাওয়ারে পানি চোখের পানির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। চলে যাই এখানে ওখানে। দূরে বহু দূরে। পথ থেকে পথে। সাগড়, পাহাড়, লোকালয়। নিজেকে ভুলিয়ে রাখি। শক্ত হই। কিন্তু রাত বাড়লেই স্মৃতি হানা মারে। মায়ের স্মৃতি। ছোট ছোট কথা, দৃশ্যকল্প। আমার মা খুব সামান্য মানুষ ছিলেন। আমিও মায়ের সামান্য সন্তান। সেই সামান্য জীবনের ঘটনাগুলো অসামান্য হয়ে আমার সামনে হামলে পড়ে। আজ মা নেই, মনে হয় আকাশ থেকে মহৎ এক বিষন্নতা হন হন করে হেঁটে আসছে। টের পাওয়া যায়। চারপাশের বিষন্নতা শক্ত মুঠিতে ধরেছে, আকাশের বিষন্নতা তেমন একটা কিছু নয় আর..।

লুৎফর রহমান রিটনের ছড়া দিয়ে শেষ করছি..
দূর প্রবাসে মা দিবসে–
একলা একা কাঁদি বসে।
সঙ্গে আছে মায়ের দোয়া।
মায়ের স্মৃতি মায়ের ছোঁয়া
জড়িয়ে রাখে অষ্টপ্রহর,
মা হলো এক স্নিগ্ধ নহর।
বাঁধন ছিঁড়ে যায় না ছেড়ে
জড়িয়ে থাকে সন্তানেরে।
জড়িয়ে থাকে সন্তানেরে,
বাঁধন ছিঁড়ে যায় না ছেড়ে।
মা হলো এক স্নিগ্ধ নহর
জড়িয়ে রাখে অষ্টপ্রহর।
মায়ের স্মৃতি মায়ের ছোঁয়া–
সঙ্গে আছে মায়ের দোয়া।
একলা একা কাঁদি বসে,
দূর প্রবাসে মা দিবসে।

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles