10.1 C
Toronto
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

ব্যাসগুহা

ব্যাসগুহা
ফাইল ছবি

ছবিটি ব্যাসগুহার। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। বলা হয়েছে ভারতের উত্তরখণ্ডের মানাতে অবস্থিত এই গুহাতেই বেদব্যাস মহাভারত রচনা করেছিলেন। যদিও দেখতে পাচ্ছি, একই নামে ভারতের বিভিন্ন স্থানে আরো কয়েকটি গুহার অস্তিত্ব রয়েছে। আচ্ছা, ফরিদপুরের যেই স্টেশনটির নাম ব্যাসপুর, সেটি নামকরণের উৎস কেউ কি জানেন?

গতবছর ‘কৃষ্ণনির্মাতা বেদব্যাস নিয়ে সংশয়’ নামে নিচের লেখাটি পোস্ট করেছিলাম। লেখাটি পড়ে যে বন্ধুরা মন্তব্য করেছিলেন, তাদেরকে কৃতজ্ঞতা। আজকের মেমরিতে লেখাটি এসেছে। লেখাটি নিচে দিলাম। এর নিচে কয়েকটি মন্তব্যও দিয়ে রাখলাম।
কৃষ্ণনির্মাতা বেদব্যাস নিয়ে সংশয়

- Advertisement -

সংস্কৃত মহাগ্রন্থ মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ওরফে ব্যাসদেব। ইউরোপীয় সমাজে ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে পাঠকপ্রিয় এ মহাভারতের লেখক ব্যাসকে নিয়ে অনেক বাঙালি পাঠকের দ্বিধার শেষ নেই। সে দ্বিধার অন্যতম কারণ কৃষ্ণদ্বৈপায়নের রচনার বিশালতা। এত পাহাড় প্রমাণ কাজ, এত তীক্ষ্ম মেধার কাজ একজনের পক্ষে সম্ভব কি না সে প্রশ্ন অস্বাভাবিক নয়। কেননা বেদ সংকলন, মহাভারত রচনা ছাড়াও কৃষ্ণদ্বৈপায়নের লেখক স্বীকৃতি রয়েছে ভাগবত ও ভগবদগীতাতেও। ১৮ টি পুরাণের সিংহভাগই তাঁর নামে রচিত। আর হয়তো সে কারণেই সমালোচকদের এমন ভাবনা যে বেদব্যাস প্রকৃতপক্ষে কোন একজন লেখকের নাম নয়।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রামমোহন ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য’ (প্রথম প্রকাশ ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ, পুনর্মুদ্রণ ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ, বিশ্বভারতী, কলকাতা) গ্রন্থে বেদব্যাস উপাধির একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর মতে প্রাচীন ভারতে ‘আর্য’ নামে যে জাতির কল্পনা করা হয় তাদের আদি যুগের মানুষদের রচিত গান, কবিতা, লোকসঙ্গীত ইত্যাদি ‘ঋক’ নামে সংগৃহীত হয়েছিল। যাঁরা ‘ঋক’ সংগ্রাহক তাঁদেরকেই বলা হতো ‘বেদব্যাস’। লেখক জানিয়েছেন ‘ব্যাস’, ‘বেদব্যাস’ উপাধিধারী লোক এখনও ভারতীয় সমাজে বর্তমান। বেদের শ্লোক সংগ্রাহকদের সামাজিক ও ধর্মীয় চিত্রটি সে গ্রন্থে স্পষ্ট। ‘বিলুপ্ত জনপদ: প্রচলিত কাহিনী’ (কলকাতা, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০০১) গ্রন্থে দীপংকর লাহিড়ী ‘ব্যাস কথাটা এখনো পশ্চিমভারতে পদবীরূপে বর্তমান’ বলে জানিয়েছেন (পৃ. ৭৯)। তেমন ভাবনার বিকাশ বাংলা ভাষার অনেক বড় লেখকের মধ্যেও ঘটেছিল বলে ধারণা হয়।

রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্যদ্বয়ে ‘ভারতবর্ষের সহস্র বৎসরের হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হইয়া আসিয়াছে’ বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রাচীন সাহিত্য গ্রন্থের ‘রামায়ণ’ অংশে। লেখাটি প্রকৃতপক্ষে দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়ণী কথা’-র ভূমিকা রূপে ১৯০৩ সালে রচিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সেখানে লিখেছিলেন ‘বস্তুত ব্যাস-বাল্মিকি তো কাহারও নাম ছিল না। ও তো একটা উদ্দেশ্যে নামকরণমাত্র। এতবড়ো বৃহৎ দুইটি গ্রন্থ, আমাদের সমস্ত ভারতবর্ষ জোড়া দুইটি কাব্য, তাহাদের নিজের রচয়িতা কবিদের নাম হারাইয়া বসিয়া আছে – কবি আপন কাব্যের এতই অন্তরালে পড়িয়া গেছে।’ কিন্তু তা দিয়ে কি প্রমাণ হয় রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের কবির পরিচয় অস্বীকার করলেন? অনেক পড়াশোনা করা মানুষকেও দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের ঐ উক্তির ভিত্তিতে যুক্তি দাঁড় করাতে যে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস আসলে কোন লেখক ছিলেন না।

মহাভারতসহ অন্যান্য পুরাণেও কৃষ্ণদ্বৈপায়নের নামের ব্যাখ্যা এবং বংশ লতিকা দেওয়া আছে। ব্যাস যদি পেশাগত একটি পদবী হয়ও তাতেও প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ কোথায় যে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন আলাদা কোন ব্যক্তি নাম নয়! কালো বর্ণ দ্বীপে জন্মগ্রহণের কারণে নামের এমন অর্থবহতা পাঁচ সহস্রাব্দ আগে! আর বংশ লতিকার কথা যদি বলি: দক্ষের পুত্র অদিতি, তার পুত্র বিবস্বান, তার পুত্র মনু, মনুর পুত্র ইলা, তার পুত্র পুরুরবা। পুরুরবার পুত্র আয়ু যার জন্ম স্বর্গের অপ্সরা উর্বশীর গর্ভে। আয়ুর পুত্র নুহুষ, তার পুত্র যযাতি। যযাতির দুই স্ত্রী – দেবযানী এবং শর্মিষ্ঠা। দেবযানীর পুত্র যদু এবং তুর্বসু। শর্মিষ্ঠার পুত্র পুরু। কৃষ্ণ যদু বংশীয় আর কুরুপাণ্ডবদের আদি পুরুষ পুরু। পুরুর অষ্টাদশ প্রজন্মের একজন দুষ্মন্ত যিনি বিশ্বমিত্রের কন্যা শকুন্তলাকে বিয়ে করেন। সেই দুষ্মন্তের পুত্রের নাম ভরত। ভারত উপমহাদেশ ব্যতিরেকেও আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং পারস্য পর্যন্ত যার সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়েছিল। সেই ভারত খ্যাত পৌরাণিক পুরুষ ভরতের বংশ পরম্পরায় শান্তনুর জন্ম যার দ্বিতীয় স্ত্রী সত্যবতী। সত্যবতী ও শান্তনুর দ্বিতীয় পুত্র বিচিত্রবীর্য যিনি ধুতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতা। সেই সত্যবতী হলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়নের মাতা। আর দ্বৈপায়নের পিতা হলেন পরাশর। পরাশরের বাবার নাম শক্তি মুনি যিনি বশিষ্টের পুত্র। ঋষি বশিষ্ট হলেন সপ্তর্ষির একজন। এমন একটি বংশ লতিকা প্রাগ-ঐতিহাসিক কাল থেকে ভারতবর্ষীয় গ্রন্থগুলোতে বহুলভাবে প্রচারিত। বিভিন্ন গ্রন্থে সে লতিকা উপরের দিকে সামান্য হেরফের হলেও কৃষ্ণদ্বৈপায়নের পাঁচ/ছয় পুরুষে কখনও পরিবর্তিত হয়নি।

কলকাতার ‘বোধ’ পত্রিকার ‘মহাভারত’ সংখ্যায় (অক্টোবর ২০০১) মনিন্দ্র গুপ্ত ‘মহাভারতের শুরু’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন বদরিনাথ থেকে মাইল পাঁচেক দূরে ভারতের শেষ গ্রাম মানায় যাবার পথে একটি গুহা আছে যার নাম ‘ব্যাসদেব গুহা’। চিন সীমান্তের সেখান থেকেই সরস্বতীর নদীর উৎস। ঐ গুহাতেই বসে ব্যাস বলেছেন আর গণেশ লিখেছেন। গুহার মধ্যে আছে ব্যাস আর গণেশের মূর্তিও – কালো ব্যাস আর হলদে গণেশ। সে ব্যাসগুহার কথা উল্লেখ আরও বিভিন্ন গ্রন্থ-প্রবন্ধে পাওয়া যায়। এখানেই নাকি ঋষি মার্কেণ্ডেয় এবং শ্রীকৃষ্ণ তপস্যা করেন।

যে কৃতী মানুষটি তাঁর কৃতিকে এতই উচ্চমার্গীয় করে তুলেছিলেন যে তিনি নিজেই হয়ে পড়েছিলেন পৌরাণিক এক চরিত্র। সাধ্যাতীত ইতিহাসের বাইরে বলেই কি তাঁর ব্যক্তিসত্ত্বাকে তুচ্ছ করে তাঁকে একটি উপাধিধারীর একজন বলে তাঁর ব্যক্তিত্ব পরিচয় নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা। একজন সৎ লেখক কি তাঁর পূর্বসূরী কোন লেখককে এত অবজ্ঞা করতে পারেন? পারেন না বলেই হয়তো পৌরাণিক সে লেখককে নিয়ে এবং তাঁর রচিত সাহিত্যিক গ্রন্থ মহাভারতকে আশ্রয় করে একবিংশ শতাব্দির প্রারম্ভেও প্রকাশিত হয় নতুন নতুন গ্রন্থ।
বিশ্বজুড়ে মহাভারত-চর্চা এখন ক্রমবর্ধমান। ইতিহাসের প্রতি বিশ্ব-মানবতার যে ঐকান্তিকতা এবং ধর্মনির্বিশেষ জ্ঞানচর্চার যে আগ্রহ সাম্প্রতিক দশকগুলোতে স্পষ্টতর তার পরিণতিতে হয়তো নিকট ভবিষ্যতেই প্রমাণিত হবে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন নামের মহাকবির বাস্তব অস্তিত্ব। দ্বৈপায়নের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব তাকে মানুষ বানিয়ে নতুন সহস্রাব্দেও বাংলা অঞ্চলে মহাভারতের ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। একজন ব্যাসের ব্যক্তি-পরিচিতিতে সন্দেহ করা চলে, তবে যে ব্যাসের নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন তার ব্যক্তি পরিচিতি তো সুস্পষ্ট। তাহলে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের ব্যক্তিক অস্তিত্ব নিয়ে এমন প্রশ্ন নিরর্থক নয় কি? এই বেদব্যাস লিখেছিলেন বলেই আমরা কৃষ্ণকে পেয়েছি। তাই তাকে আমার ‘কৃষ্ণনির্মাতা’ বলতে ভালো লাগে। তিনি কৃষ্ণনির্মাতা ছিলেন বলেই কৃষ্ণের মতোই তিনি নিজেও হয়ে উঠেছিলেন ভগবানের আরেক অবতার।

আগ্রহী পাঠককে জানিয়ে রাখতে চাই দ্বৈপায়নের বাবা পরাশরকে নিয়েও তো কম প্রশ্ন নেই – তিনি একজন নাকি বহুজন! প্রশ্ন তো

একারণেই যে পরাশরও সৃষ্টি করেছেন অতলস্পর্শী গ্রন্থরাজী।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles