1.9 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

বিয়ে না খেয়ে কানাডায় ব্যাক করবে না

বিয়ে না খেয়ে কানাডায় ব্যাক করবে না
ফাইল ছবি

ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার হিতামপুর গ্রামে বিয়ের দাওয়াতে গেলাম অনেকটা জোর করেই। দেশে এসে বিয়ে না খেয়ে কেমনে যাই? কুমার নদীর ধারে ছোট্ট গ্রামে হলুদ বিস্তীর্ণ সর্ষে ক্ষেতের লাগোয়া মাটির বাড়ি। দূরসম্পর্কের বন্ধুর ভাতিজার বিয়ের দাওয়াত জোগাড় করেছি। তার ওপর চিশতীর অনুরোধে তাকেও সাথে করে এনেছি লাজলজ্জার মাথা খেয়ে, যেচে। ও যে একদম আনইনভাইটেড গেস্ট, তা অবশ্য না। সেই বন্ধুর অনুমুতি নিয়েই তাকে এনেছি।

সেও পন করে এসেছিল দেশের বিয়ে না খেয়ে কানাডায় ব্যাক করবে না। তাকে সাথে নেবো শুনে সে এতই খুশি হয়েছিল যে, আমাকে ছয় হাজার টাকা দিয়ে আড়ং থেকে তসর সিল্কের পাঞ্জাবি, এপেক্স থেকে আঠারো’শ টাকার চামড়ার স্যান্ডেল স্যু কিনে দিয়েছে। আবার শর্তও জুড়ে দিলো গিফট কেনা আর যাতায়ত খরচও সে দিতে চায়।
আমি দুবার “না থাক.. না থাক” বললেও শেষে খুব একটা আপত্তি করিনি।
মিডিয়াম সাইজের বিয়ে।
দেড়শ’র মতো মানুষ আসবে। বাড়ির উঠোনে শামিয়ানা টাঙিয়ে রং-বেরঙের ত্রিকোনাকার কাগজ ঝুলানো দড়ির সাথে। আমি এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করে, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে এসে বন্ধুকে ফিসফিসিয়ে বললাম- দোস্ত, দুইটা বিরাট সাইজের খাসি বাধা। সেইরকম ত্যালতেলে, কুঁচকুঁচে কালো খাঁটি সিরাজগঞ্জের ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট!
– রিপন রে, কতদিন খাসির সিনার সাথেকার কচকচে সাদা চর্বি খাই না। আজ চেয়ে নিবো খাইজলদারির কাছে
– তোকে চাইতে হবে কেন? আমি ব্যবস্থা করতেছি বন্ধুকে বলে
– তাহলে গুর্দা, নলি, হার্টও দিতে বলিস তো? গুষ্টি কিলাই ভদ্রতার!
– আর দোস্ত, দুই খাঁচা দেশি মোরগ রাখা। বেশ কয়েক প্যাকেট ছোলার ডাল দেখলাম। আমি শিওর গীলা-কলিজা, চামড়া দিয়ে মজার ডাল রান্না হবে। আর ফুলকপি, গাজরের সবজি হবেই..
– পারলে এরকম দাওয়াত আরও দুই চারটা জোগাড় করিস তো? খরচ-পাতি সব আমার। আচ্ছা, তোর মুসলমানি যেন কবে?

- Advertisement -

মুসলমানির কথাটা সে ইচ্ছে করে কিছুটা জোরেই সবাইকে শুনিয়ে বলল। কয়েকজন ভাবি বিস্ময়ে আমার দিকে চাইলো। সে ভাবছে এটা খুব উচ্চস্তরের রসিকতা করে ফেলছে। ফাইজলামির একটা লিমিট থাকে। আজকের বিয়ে নিয়েও সে গত এক সপ্তাহ ধরে আমাকে জিজ্ঞেস করতেছে- “তোর বিয়ে যেন কবে?” আমার ভাতিজার মুসলমানি, আর সে কয়েকদিন পরপর জিজ্ঞেস করা শুরু করছে- “তোর মুসলমানি যেন কবে?” সেটাও মেনে নেওয়া যায় যদি আড়ালে বলে। তাই বলে বিয়ে বাড়িতে ভাবীদের সামনে? সে ভাবছে এসব শুনে লোকে হাসবে। আসলে খুব খুব নিম্নস্তরের রসিকতা। আমার মুড অফ করে দিলো। চুপ মেরে গেলাম।

হঠাৎ সে চিন্তিত মুখে বলল, খাসি এখনো জ্যান্ত ক্যা? রাতেই না সাইজ করে রাখার কথা?
– তাই তো!
– দুপুর একটা বাজে; কখন জবাই করবে, কখন রান্না হবে?
– তাই তো!
– দেখে আয় তো ঘটনা কী?

দূরসম্পর্কের বন্ধুকে খুঁজে, আলাপ করে যেটা জানলাম, সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। বিয়ে আদৌ হবে কিনা সন্দেহ। তাই মেয়ে কবুল না বলা পর্যন্ত নাকি চুলা ধরাবে না। গ্রিন সিগনাল পেলে তবেই ছাগল জবাই হবে। দোস্ত, এ কেমন বিচার? চল পালাই
– ক্যা?
– ঘটকালি আমি করছি রে.. মেয়ের প্রেমিকা ঝামেলা করতেছে। পকেটে ইঁদুর মারা বিষ নিয়ে ঘুরতেছে। মেয়ে কবুল বললে নাকি সবার সামনে খাবে। তখন লোকে আমাদের ধরবে
– “আমাদের” মানে কী? ধরলে তোকে ধরবে?
– তুইও তো আমার সাথে..

চিশতী আমাকে বাঁশঝাড়ের আড়ালে নিয়ে গিয়ে পকেট থেকে বা হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এক হাতে কৌশলে ঝাকি দিয়ে একটা সিগারেট শলা বের করে মুখে পুরে ঘ্যাচাং করে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে ধোঁয়া তুলে বলল, মেয়ে বিয়েতে রাজি?
– রাজি ছিল, কিন্তু সুইসাইড করার কথা শুনে পিছায়ে গেছে
– তার প্রেমিকের সাথে বিয়ে হচ্ছে না কেন?
– ছেলে বিয়ে পাস, গরিব, বেকার
– বেকার ছেলের এতো বিয়ে করার শখ ক্যা? পকেটে ইঁদুর মারার বিষ নিয়ে ঘুরতেছে, এ কোন ধরনের বদমাইশি?
– সত্যি সত্যি যদি খায়ে ফেলে?
– জীবনেও খাবে না। তার লোভ জমিজমার ওপর। খাবে না, ভয় দেখাচ্ছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা মনে করে তার ডার্লিংয়ের থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারের সাথে বিয়ে হয়ে গেলে আর বাঁচবে না। আসলে মরে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাসতে বলবে, বেঁচে গেছি! তারপর স্টার কাবাবে গিয়ে কাচ্চি খেয়ে আসে। তুই ঘটকালি করছিস, আর ঝামেলা হয়নি, এরকম ইতিহাসে নাই। ছেলে দেখার আগে মেয়ের সাথে আলাপ করিসনি?
– দোস্ত রে, বিয়ে ভাঙলে খাওয়ার পাবো না?
– আচ্ছা পাবলিক! মানুষ মারা যাচ্ছে; আর তোর খাওয়ার চিন্তা?

তার কিছু এক্সট্রিম, পেসিমিস্টদের মতো চিন্তাভাবনা আছে। যেমন- প্রেমের বিয়ে নাকি টেকে না, পয়সা না থাকলে নাকি ভালবাসা খিড়কি দিয়ে পালায়, কেউ কারও না, সাড়ে তিন হাত মাটি ছাড়া নাকি দুনিয়ায় আর কিছু নাই; ইত্যাদি যত সব আজেবাজে নেগেটিভ কথা।

আমি আবারও লেটেস্ট খবর এনে বন্ধুকে গিয়ে বললাম- দোস্ত রে, মেয়েকে জোড় করে এনে বিয়ে পড়াচ্ছে! মেয়ের মা বলছে এই বিয়ে না হলে উনার মরা মুখ দেখতে হবে। খেলা জমবে!
আমরা সেখানে হাজির হলাম। সবাই অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে মেয়ের মুখে কবুল শোনার জন্য। মেয়ে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। আশপাশ থেকে আত্মীয়-স্বজনরা বলতে লাগল, মা বলো? কবুল বলো?

আমি মনে মনে খুব রাগ করে বললাম- “এই ছেমড়ি, কবুল বলা শিখিসনি? তোর জন্য হাঁড়ি বন্ধ, দেড়’শ মানুষ খিদের জ্বালায় ছটফট করতেছে। ছাগলগুলা আর কতক্ষন ওয়েইট করবে? তোর ঐ তালপাতার সেপাই, বেকার ছেলের মধ্যে পাইছিসটা কী? হবু বর থকে ইতালি, কত পয়সাওয়ালা। বল কবুল, শিগগির!

মেয়ের কান্দাকাটির মধ্যে কে যেন বলে উঠল, এইতো কবুল বলছে!
হুজুর আশেপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেশ করল, আপনারা শুনছেন?
কয়েকজন পাশ থেকে বলল, শুনছি!
মেয়েকে আরও দুইবার কবুল বলতে বলা হলেও মুখ দিয়ে শুধু কান্দাই বের হতে লাগলো। হঠাৎ তার মামা এসে মেয়েকে বলল- “মা, তোমার কাছে হাত জোড় করে বলি, এ বিয়ে না হলে তোমার মা বাঁচবে না। একজনের জীবন নির্ভর করছে তোমার রাজি হবার ওপর।”
দূর থেকে এক লোক বলে উঠলো, মেয়ের মায়ের জীবনের দাম আছে, আর আমাদের বেকার ছেলের জীবনের দাম নাই? এ বিয়ে হবে না! সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আমরা আঙ্গুল বাঁকা করবো! বিয়ে বন্ধ করেন!

এ পর্যন্ত শুনে চিশতী আমাকে টান দিয়ে বের করে এনে বলল- রিপন, চল কেটে পড়ি। মারামারি বাঁধতে পারে। কানাঘুষা শুনলাম বেকার ছেলে নাকি ঝামেলা করার পায়তারা করতেছে। লাঠিয়াল বাহিনী আনতেছে। তুই আবার ঐদিক কোই যাস?
– গিফট বক্সটা ফেরত নিয়ে আসি..
আমরা অটোতে করে যাবার সময় দেখি একটা ভটভটি নসিমন গাড়িতে প্রায় বিশ জনের লাঠিয়াল বাহিনী এগুচ্ছে বিয়ে বাড়ির দিকে!

আমরা পালিয়ে গাড়াগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে ফরিদা হোটেলে ঢুকে ঢেঁড়স ভাজি, পাবদা মাছ আর মশুরের ডাল অর্ডার দেই। পেট খিদেয় চোঁ চোঁ করছে। আমি দুই নলা ভাত মুখে দিয়ে বললাম, দোস্ত কত মজা রে..
– ডিম নিবি?
– দে?
– বিয়ে বাড়ির রিচ ফুড আসলে ভাল জিনিস না। হার্ট ব্লক করবে, কলেস্টেরল বাড়াবে
– ঠিক
– আসল কথা হলো; পোলাউ, খাসির রেজালা খাওয়ার সময় ভাল লাগে ঠিকই, কিন্তু খাওয়ার পরে এতই খারাপ লাগে রে..। ঘুম পায়, প্রেশার বাড়ে..। আর এই ডাল-মাছ-সাদা ভাত দেখ যত খুশি খাওয়া যায়।
এই, এখানে আরও দুই হাফ ভাত দে তো..
.
আমরা গাড়াগঞ্জ থেকে কুষ্টিয়ার বাস ধরি। সব বাস মানুষে টইটম্বুর। অনেকক্ষন অপেক্ষার পর একটা বাসে সিট খালি আছে শুনে আমরা উঠে পড়ি। একদম শেষের সারির সিট। রাস্তা খুব খারাপ, বাস এতই ঝাকি দিচ্ছে, মাথা ছাদে বাড়ি খাওয়ার মতোই পরিস্থিতি। শেষের সারিতে ধরার কিছু থাকে না, ঝাকুনি খেয়ে মেঝেতে পড়ে হেল্পারের পায়ের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় পড়ার বিরাট সম্ভাবনা। তাছাড়া হার্ড ব্রেক করলে আমরা নিশ্চিত ছুটে গিয়ে গাড়ির সামনের উইনশিল্ডে বাড়ি খাবো। আমাদেরর পায়ের তলায় সবজির সিম আর বেগুনের বিশাল বিশাল বাঁশের ঝুড়ি। হাঁটু ভেঙে বসে থাকতে থাকতে পা ব্যাথায় টনটন করতে লাগলো।

বিপদ যখন আসে, তখন মাটি খুঁড়ে, হাওয়া থেকেও ঝামেলা বের হয়।
আমার বন্ধু বিয়ে বাবদ বারো হাজার টাকা খরচ করলেও শেষে মাত্র দশ টাকার জন্য বাসের কন্ডাক্টরের সাথে জুড়ে দিলে তুমুল ঝগড়া।
আমি না ঠেকালে এতক্ষন নিশ্চিত হাতাহাতি চলতো..

কুষ্টিয়ায় বাস্ট্যান্ডে বাস চালু অবস্থায়ই আমাদের ঠেলে নামিয়ে দিলো। চাকার তলায় পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম। আমার সাধের তসর পাঞ্জাবিটা বাসের বডির টিনে বেঁধে ফরফর শব্দে বিরাট এক ফাটলের সৃষ্টি করলো..
কন্ডাক্টর অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে, মুঠি মেরে ঘুষি দেখিয়ে, বিশেষ আঙ্গুল আকাশে উঁচিয়ে চলে গেলো..

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles