7.3 C
Toronto
বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

দুটি সেতু

দুটি সেতু
ফাইল ছবি

আমার বড় কাকার দু’জন স্ত্রী ছিল। বড় জনকে আমরা ডাকতাম ‘বড় চাচী আম্মা’ আর তার ছোট স্ত্রীকে ডাকতাম ‘ছোট কাকী আম্মা’। খুব ছোট বেলায় গ্রামে গিয়ে ওনাদের দেখা পাই। দুই সতীন কথাটি পূর্বে শুনে থাকলেও দুই সতীনের সাথে সেটাই প্রথম সম্মুখ দর্শন। ওনাদের একসাথে একই ঘরে দেখতে পেয়ে ভালোই হয়েছিল। দুই সতিনের নামে প্রচলিত যত মন্দ কথা শুনেছি সেসব ভুল আমার ছোট বেলাই ভেঙ্গে গেছে। ওনাদের দেখেছি দুই বোনের মতন মিলেমিশে এক সাথে সংসার করতে। আমি যখনকার কথা বলছি তখন দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে সাধারণত সংসারের বড় সন্তানের নামে মা বাবাকে সম্বোধন করা হতো। সে হিসেবে বড় চাচী আম্মাকে ডাকা হতো শহীদের মা (শহীদ ভাইয়ের আম্মা), আর ছোট কাকী আম্মাকে ডাকা হতো দাউদের মা (দাউদ ভাইয়ের আম্মা)।

ছোট কাকী আম্মা আমাদের কাঁঠাল বাগানের বাসাতে যখন আসেন তখন সময়টা ১৯৬৯-৭০ সাল হবে। সেবারই তার প্রথম ঢাকায় আসা। ঢাকায় আসার উদ্দেশ্য গাড়ি দেখা। ঘোড়ার বদলে মানুষ গাড়িতে চড়ে এদিক সেদিক যায় সেই গাড়ি দেখতে কেমন, গাড়ির কয়টা পা, রঙ কী? সেসব দেখার তার খুব আগ্রহ হয়েছিল। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের অনেক মানুষের ভাগ্যে ১৯৬৯-৭০ সালের আগেই গাড়িতে চড়ার কিংবা গাড়ি দেখার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু আমার ছোট কাকী আম্মা ছিলেন গ্রামের সহজ সরল লেখাপড়া না জানা সাংসারিক মানুষ। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে এসে নিজের বাবা মায়ের বাড়িতে খুব যে গেছেন তেমনটা শুনিনি। পাশেই গোপালগঞ্জ মফস্বল শহর। লঞ্চে উঠলেই দিনে দিনেই খুলনা বিভাগীয় শহর তবুও তিনি তার কিছুই দেখন নি। ঢাকায় আসা মানে গোটা পৃথিবী দর্শন ছিল তার কাছে। যখন বাসায় এসে পৌঁছালেন তখন বিকেল হয়ে গেছে। রান্না ঘরে বসে আম্মার সাথে সদর ঘাটের বর্ণনা এবং পথ ঘাটের ভিড়, মানুষের ব্যস্ততা এবং অবশ্যই গাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন। সে সময় তো ইন্টারনেট ছিল না, ফেসবুক ইউটিউব এসব কিছুই ছিল না। তাই শিক্ষার মাধ্যমের অন্যতম উৎস ছিল বড়দের কাছে থেকে শেখা। রান্না ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আমি কাকী আম্মার ঢাকা দর্শনের বর্ণনা শুনে হাসছিলাম। এক সময় সন্ধ্যা নেমে এলে আম্মা বললেন লাইট জ্বালিয়ে দিতে। আমি সুইচ অন করতে কাকী আম্মা অবাক হয়ে গেলেন। অবাক হয়ে তিনি কী বলেছিলেন সেটা হুবহু তুলে ধরছি। কেউ যেন এর মধ্যে কোন অশ্লীলতা খুঁজে না পান। আলো জ্বলে উঠলে তিনি বলেছিলেন, ‘ও মারে মা, কি শলকের শলক! সুঁইয়ের গুদ পর্যন্ত দেখা যায়’। অর্থাৎ এতো আলো (শলক) যে সুঁই এর পেছন দিকটার ফুটোও দেখা যায়।

- Advertisement -

এবার আসি আসল কথায়। আমাদের গ্রামের বাড়ি মধুমতী নদীর তীরে। আব্বার জন্ম সেখানেই, রহমতপুর গ্রামে। আম্মার জন্ম মধুমতীর অন্য পাড়ে। গোপালগঞ্জের দূর্গাপুর ইউনিয়নের খটিয়া গড় গ্রামে। আজ মধুমতী নদীর উপর নতুন একটি সেতু উদ্বোধন করা হলো। পদ্মা সেতু চার লেনের হলেও মধুমতী নদীর উপর নির্মিত সেতুটি ছয় লেনের। বলা হচ্ছে বাংলাদেশে এই প্রথম ছয় লেনের সেতু করা হয়েছে। আমাদের অঞ্চলটা কতটা পিছিয়ে থাকা অংশ ছিল সেটা আমার ছোট কাকী আম্মার কথা থেকেই আন্দাজ করে নিতে পারেন। অথচ এই অঞ্চল থেকেই আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলার অহংকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে মধুমতী নদীর কথা খুব সুন্দর করে বর্ণনা করা হয়েছে। আজ মধুমতী সেতু উদ্বোধনীর দিনে আমি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তাঁর সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারী শ্রমিক সহ সকলকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ।

একই দিনে নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর উপর নির্মিত আরও একটি সেতুর উদ্বোধন করা হলো আজ। যে সেতুর নাম করণ করা হয়েছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমানের নামে। বলতে গর্ব হচ্ছে নাসিম ভাই আর আমি একই ক্যাম্পে, একই ইন্সটেক্টর, লেন্স নায়ক আব্দুর রশিদের কাছে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। তার নেতৃত্বে অনেকগুলো অপারেশন করেছি। আজ আরও একজনের নাম উল্লেখে করতে চাই, যিনি হলেন মধুমতী নদীর তীরে অবস্থিত আমাদের গ্রাম সহ চিতলমারী থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, শেখ হেলাল। যিনি শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই। শেখ হেলালও বাকুন্ডিয়া ক্যাম্পে আব্দুর রশিদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। নাসিম ভাইকে নিয়ে আমি বেশ কয়েকবার লিখেছি। আমার বইতেও তার স্নেহ ভালোবাসার কথা আমি লিখেছি। যুদ্ধের দিনে যিনি মাথায় হাত রেখে আদর করেছেন তিনি যে হৃদয়ের কোন স্থানে বসবাস করেন তা বলে বোঝানো যাবে না। একবার আমার থ্রি নট থ্রি রাইফেল উঁচু করে মজা করে বলেছিলেন তোমার থেকে দেখি এটার ওজন বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার কাছের বন্ধু হয়ে ওঠে নিগার নামের একটি মেয়ে। আমি নিগার, রেণু, ময়না, কামাল এরা একসাথে বসে গল্প করতাম। একদিন গল্পের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠে আসে। আমি নাসিম ভাইয়ের কথা খুব বলে যাচ্ছি। নিগার অবাক হয়ে শুনছে সবকিছু। আমার কথা শেষ হলে বলল, তুমি সেই বাবলু। ভাইয়ার মুখে তোমার কথা অনেকবার শুনেছি। তুমি ক্যাম্পে সব চাইতে ছোট ছিলে তাই না? আমি বললাম, কে তোমার ভাইয়া? ও বলল, তুমি যার কথা বললে সেই নাসিম ভাই আমার বড় ভাই।

নাসিম ভাইয়ের নামে একটি ব্রিজের নাম করণ করা হয়েছে আমার খুশি দেখে কে। একটু আগে নিগারকে ঢাকায় ফোন করলাম। ওদিক থেকে হ্যালো বলতেই বললাম, একটা গানের কথা খুব মনে পড়ছে তাই ফোন করলাম। নিগার বললো কোন গান? আমি বললাম ‘এমন খুশির দিনে কাঁদতে নেই’।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles