0.6 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

উড়োজাহাজটা টুপ করে বসে পড়লো মাটিতে

উড়োজাহাজটা টুপ করে বসে পড়লো মাটিতে
ফাইল ছবি

পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উপরে।
শরীরের প্রতিটা কোষের গন্তব্য বাড়ি। আমার ঘর, আলমারি, ধুলো মাখা টেবিল। ছাদের কংক্রিটের উঠোন, লোহার চেয়ার, নয়নতারা, চন্দ্রমল্লিকা, মায়াবী কমিনী। খরগোশের লাফিয়ে বেড়ানো, কাপড় শুকানোর দড়িতে বসে পাখিদের জিরিয়ে নেয়া।

উড়োজাহাজটা টুপ করে বসে পড়লো দেশের মাটিতে।
গাবতলী পেরিয়ে, দূর গঞ্জের ভেতর দিয়ে ছুটলো বাস। কখনো সর্ষে, আখ ক্ষেত। কখনো বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেতে বাতাসের ঝন্ঝনে ধ্বনি। কখনো বা বাজার, হাট। ফুলকপি, মুলা, সিমের পাহাড়। হোটেলগুলো ব্যস্ত। বিরাট ব্রিজ পেরোনোর পর মনটা স্বস্তি পেল। বেজে চলল গন্তব্যের পদধ্বনি!

- Advertisement -

মজমপুর বাস স্ট্যান্ড।
দাঁড়িয়ে আছে রক্তের ভাই। শেষ মুহূর্তে উত্তেজনা আরও বেশি। তর সয় না। যদিও মাত্র এক কিলোমিটার। জাহাঙ্গীর হোটেল, শিল্পী হোটেল ছাড়িয়ে, লেদ মেশিনের দোকানগুলো। জিলা স্কুলের সামনে আসতেই বামে তাকিয়ে স্কুলটাকে দেখবার চেষ্টা। কতটুকু পাল্টালো? তারপর সার্কিট হাউজের ফুলের গাছগুলোর দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে আরেকটু দূরে গলা বাড়িয়ে কলকাকলি স্কুল দেখবার ব্যর্থ চেষ্টা। আশেপাশে ছেলেবেলার কিছু পরিচিত মুখ, যাদের সাথে খেলতাম, শৈশবের মূল্যবান সময় কাটতো। তাদের নাম স্মরণ করবার চেষ্টা..

এবার সাদ্দাম বাজার, পোড়া মোবাইলের দোকান, ডিসি কোর্টের যমজ পুকুর, শহীদ মিনার। সাবধানে গলিতে রিকশা থেকে নেমে যাওয়ার পর নিশ্চিত হলাম পৌঁছে গেছি। অবিশ্বাস্য, কোথা থেকে কোথা! অটোয়াতে কি এখন তুষারপাত হচ্ছে? মাইনাস দশ পনেরো? আমাদের ছোট্ট বাসাটা নিশ্চয়ই তুষারে আবৃত? লাল টুকটুকে কার্ডিনাল পাখিগুলো বাগানে আসছে, যাচ্ছে..। দুষ্টু কাঠবেড়ালিগুলো? চারিদিকে শুধু ক্রিসমাসের মন জুড়ানো আলোকসজ্জা, চোখ ধাঁধানো সাদা।

বাড়ির সামনে অটো থেকে নামি।
ছেলেমেয়েদুটো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না; তারা কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে। কী ঘটতে যাচ্ছে।

চোখ ছলছল করে উঠল।
গেটের সামনে শিউলী গাছটা থেকে তীব্র আবেগময়ী, স্মৃতিচারণের সুবাস বইতে লাগলো। মিলি সেকেন্ডেই যেন ফিরে গেলাম আমাদের নানী বাড়িতে; এ বাড়ি থেকে একদম কাছেই ছিল। সেখানে কুয়োর পাড়ের সেই শিউলি গাছ, নারকেল, বরই, আম। ভোর হলেই ছুটতাম শিউলি ফুল কুড়োতে। মালা গাঁথতাম। নানা-নানীর মায়া মাখানো পবিত্র মুখায়ব চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠলো। চাদর গায়ে উঠোনে বসে তাঁদের রোদ পোহানো। শুরু হয়ে গেলো তাদের আনাগোনা! কত জীবন্ত, ব্যস্ততা, ভালোবাসা ছিল তাঁদের হৃদয়ে!

আমাদের প্রান প্রিয় নাহার ম্যানসন!
সেদিন আমার ছেলে-মেয়ে দুজনকে নাহার ম্যানসনের নাম বলতেই তারা বিস্ময়ে বলল- আমাদের দাদিবাড়ি ম্যানসন? তোমাদের ম্যানসন আছে? শুনে আমরা হো হো করে হেসে উঠি। বললাম, ঐটা মোর দ্যান আ ম্যানসন। বাড়ি ছোট হলে কি হবে, ওটা রাজ প্রাসাদের চাইতেও মহা মূল্যবান, অমূল্য। বাকিংহ্যাম প্যালেসের চাইতেও লক্ষ গুন বড় আর সুন্দর। একটা সামান্য কুঁড়ে ঘরও হতে পারে রাজ প্রাসাদ। যেমন পিতার কাছে তার কন্যা রূপকথার এলসার চাইতেও লক্ষ গুন রূপসী, মায়াবী; আজীবনের বন্ধনে বাঁধা!
.
আমি কল্পনার রাজ্য থেকে বাস্তবতায় ফিরি।
গেট দিয়ে প্রবেশ করতে থাকি। জানি, দোতালার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে আমার মা। তাঁর হাজার বছরের অপেক্ষার ইতি ঘটবে। ভুল বললাম, তাঁর এ অপেক্ষার কোনো শেষ নেই। কিছুক্ষনের মধ্যে আলিঙ্গন করবে, বুকে জড়িয়ে কাঁদবে। যেগুলা থেকে আমরা বঞ্চিত। সেই মমতা, শাড়ির গন্ধ। তীব্র ভালোবাসার আলিঙ্গন, সত্যের মুখোমুখি। এ আলিঙ্গন আজীবনের; নেই মৃত্যু; নেই ক্ষয়, সীমারেখা।
.
আমার হৃদয় জুড়ে হাজারো চিঠি; লিখেছিলাম দেশের জন্য। প্রতিদিনই লিখি। কখনো ধানক্ষেতের পটে আইল দিয়ে লিখা। সর্ষে ক্ষেতের খাতায়। নদীর ঢেউয়ে, নৌকো দিয়ে, বালুচর দিয়ে লিখা সেই চিঠি। কখনো বা আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে, সুতো, নীহারিকা দিয়ে।

আজ থেকে তোমাকে পড়িয়ে শোনাবো চিঠিগুলো।
কোনটা যে কল্পনা, আর কোনটা যে বাস্তবতা; গুলিয়ে ফেলি বারবার..

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles