14.3 C
Toronto
মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৩, ২০২৪

তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে অপহরণ-প্রলোভন

তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে অপহরণ-প্রলোভন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশ হত্যা মামলার তদন্তে এখনো খুনের কারণ ও খুনিদের চিহ্নিত করতে পারেনি র‌্যাব-পুলিশ। তবে ডাকাতির জন্য অপহরণ কিংবা প্রলোভনে ফেলে নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া বস্তিতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে ধারণা করছে পুলিশ। ঘটনার রাত তিনটা পর্যন্ত বস্তি এলাকায় তার মোবাইলের ফেসবুক মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা চালাচালি হয়। ফারদিন হত্যায় সন্দেহভাজন চনপাড়া বস্তির চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী শাহীন র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

- Advertisement -

এদিকে, ফারদিনের বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। তবে হত্যাকা-ের প্রাথমিক তদন্তে বুশরার কোনো সংশ্লিষ্টটা পায়নি র‌্যাব-পুলিশ।

দুই বিষয়ে সামনে রেখে হত্যার তদন্ত করা হচ্ছে জানিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হচ্ছে তিনি কোনো ট্যাপে পড়েছিলেন। প্রলোভনে ফেলে তাকে কৌশলে চনপাড়া এলাকায় নিয়ে মারধর করা হয়। সেই মারধরে তার মৃত্যু

হলে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয় অপরাধীরা। এ ছাড়া অপহরণকারীরা অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রাস্তা থেকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে মারধরও করতে পারে। মারধরে মারা গেলে তার লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হতে পারে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বুয়েট ছাত্র ফারদিন গত ৪ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে রাজধানীর রামপুরায় বান্ধবী বুশরাকে রিকশা থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর প্রথমে জুরাইন এলাকায় যান। রামপুরা ব্রিজের কাছে পৌঁছানোর কিছু সময় আগে থেকে ইফাত জাহান মোমো নামে এক বান্ধবীর সঙ্গে চ্যাটিং করছিলেন। বান্ধবী বুশরাকে রামপুরা রেখে যাওয়ার পর থেকে ছয়টি ফোন নম্বরে কথা বলেন ফারদিন। এর মধ্যে বেশিরভাগই তার বন্ধুবান্ধব। বুশরা রিকশা থেকে নেমে যাওয়ার পর একটি মোটরসাইকেলে করে কেরানীগঞ্জ ও জনসন রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ান। সবশেষ জনশন রোড থেকে চনপাড়া এলাকায় যান। এ সময়ের মধ্যে মোমোর সঙ্গে চ্যাটিং চালিয়ে গেছেন। মোমো তাকে দুটি ফানি ভিডিও পাঠান। সেগুলো দেখে, ‘আই সি দ্যা ভিডিও’ লিখে রিপ্লাই দিয়েছেন। ১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত মোমোর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ফারদিন। রাত ২টা ৩৫ মিনিটে তার অবস্থান চনপাড়ায় পাওয়া যায়।

গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, ঘটনার রাতে চনপাড়া এলাকায় মাদকের গডফাদার শাহীনসহ মাদককারবারিরা একজন যুবককে মারধর করে। ধারণা করা হচ্ছে, সেই যুবকই ফারদিন। তাদের মারধরেই ফারদিন মারা যায়। মৃত্যুর পর লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেওয়া হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে কী কারণে এবং কেন তিনি চনপাড়া এলাকায় গিয়েছিলেন সেটি এখনো স্পষ্ট নয় তদন্তকারীদের কাছে।

এদিকে, এ ঘটনায় শাহীনকে টার্গেট করে গ্রেপ্তার করতে চনপাড়া যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক দল। তার আগেই র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নিহত হন ২৩ মামলার আসামি কুখ্যাত সন্ত্রাসী শাহীন ওরফে ছিপি শাহীন। বন্দুকযুদ্ধের শাহিনের মৃত্যুর ঘটনা স্বীকার করা হলেও র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বুয়েট ছাত্র ফারদিন খুনের সঙ্গে শাহিনের কোনো সংশ্লিষ্টতার কথা জানে না র‌্যাব।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সিটি শাহীনকে একমাস আগেও গ্রেপ্তার করতে বস্তিতে অভিযান চালিয়েছিল র‌্যাব। তখন র‌্যাবের ওপর হামলা চালালে কয়েকজন আহত হয়। একইভাবে বৃহস্পতিবার অভিযানে গেলে র‌্যাবের ওপর গুলি চালালে র‌্যাবও গুলি চালায়। তার পায়ে গুলি লাগলে মুগদা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি মারা যান।

বুয়েট ছাত্র হত্যায় সিটি শাহীনের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে র‌্যাব তার অভিযানের ধারাবাহিকতায় চনপাড়া বস্তিতে অভিযান চালিয়েছে।

র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোনেম গণমাধ্যমেক জানিয়েছেন, শাহীন দুটি হত্যা মামলাসহ ২৩টি মামলার আসামি। তাকে আগে থেকেই চোখে চোখে রেখেছিল র‌্যাব। সবশেষ গতকাল তাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। আত্মরক্ষার্থে র‌্যাব গুলি চালালে শাহীন গুরুতর আহত হয়। আর তার অন্য সহযোগীরা গুলি করতে করতে পালিয়ে যায়। পরে শাহীনকে উদ্ধার করে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে পাঠালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়েছে। র‌্যাবের এ অভিযানের পেছনে বুয়েট ছাত্রের ঘটনার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। শাহীন ওই হত্যাকা-ে জড়িত কিনা তাও আমরা জানি না।

তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রাজীব আল মাসুদ বলেন, সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ সম্পর্কে এখনো আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে দুটি বিষয় নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি দ্রুতই রহস্য উন্মোচন হবে।

হত্যার ঘটনায় করা মামলাটি রামপুরা থানা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবিতে) হস্তান্তর করা হয়েছে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ বলেন, ফারদিন ৪ নভেম্বর নিখোঁজ হন, ৫ নভেম্বর তার বাবা রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এর পর থেকেই আমরা ছায়া তদন্ত শুরু করি। ৭ নভেম্বর তার লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার হয়। এর দুই দিন পর গতকাল রাতে তার বাবা বাদী হয়ে রামপুরা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় বুশরা নামের এক শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়। তিনি ফারদিনের বান্ধবী। তাকে এর আগেও আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। মামলা হওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছি। তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

ফারদিন হত্যাকা-ের পেছনে পারিবারিক, সামাজিক কোনো কারণ ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়ে ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই-বাছাই চলছে। পারিপার্শ্বিক বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে হত্যার কারণ ও হত্যাকারী সম্পর্কে এখনো আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত না। মামলার অভিযোগের ব্যাপারে রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ফারদিন নূরের বান্ধবীসহ অজ্ঞাতনামা আসামিরা তার ছেলেকে হত্যা করে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে নদীতে ফেলে দিয়েছেন।

গত বুধবার দিবাগত রাতে রামপুরা থানায় মামলা দায়ের করেন নিহতের বাবা কাজী নূরউদ্দিন। তিনি মামলার এজাহারে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, ফারদিন নূরকে ৪ নভেম্বর রাত ১০টার পর থেকে ৭ নভেম্বর বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত যে কোনো সময়ে রামপুরা এলাকা বা অন্য কোথাও হত্যাকারীরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। তার ছেলের নিখোঁজ হওয়া ও মৃত্যুতে আমাতুল্লাহ্ বুশরার ইন্ধন রয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। এ অবস্থায় তার ছেলের হত্যার নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার নিশ্চিত করতে এজাহার দাখিল করেন তিনি।

এদিকে, সাত দিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি করে ঢাকার মহানগর হাকিম মেহেদী হাসান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী বুশরাকে ৫ দিন হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো বুশরার কাছে বিচারক জানতে চান, তার কোনো আইনজীবী উপস্থিত আছেন কি না। বুশরা উত্তরে শুধু বলেন ‘না’। শুনানির বাকিটা সময় তিনি চুপচাপ ছিলেন। আইনজীবী না থাকায় তার পক্ষে কেউ রিমান্ডের বিরোধিতাও করেননি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন ফারদিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। পরিবারের সঙ্গে ডেমরার কোনাপাড়া এলাকায় থাকতেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। আর তার বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরা পড়েন ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে। রামপুরা বনশ্রীতে তার বাসা। বছর পাঁচেক আগে এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ফারদিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

বুশরা পুলিশকে জানিয়েছে, গত ৪ নভেম্বর ফারদিন বাসা থেকে বের হওয়ার পর তারা দুজন ধানম-ি সিটি কলেজ এলাকায় মিলিত হয়েছে। এর পর সেখান থেকে তারা দুজন নীলক্ষেত ও ধানমন্ডি এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে। পরশ ও বুশরা ওই দিন বিকাল আনুমানিক পাঁচটার দিকে সাত মসজিদ রোডে ‘ইয়াম চা ডিস্ট্রিক্ট’ রেস্তোরাঁ খাবার খেয়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে। এর পর তারা দুজনে রাত ১০টার দিকে রিকশায় করে রামপুরা টেলিভিশন ভবন এলাকায় আসে।

সূত্র : আমাদের সময়

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles