ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে স্মার্ট আইডি কার্ড দেওয়া হয়েছে। তবে উপযুক্ত অবকাঠামো গড়ে না তোলায় এই কার্ড শিক্ষার্থীদের কোনো কাজেই আসছে না। তাই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। যদিও স্মার্ট কার্ড বাবদ গত ছয় বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২ কোটি ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৪০০ টাকা আদায় করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার উদ্যোগের অংশ হিসাবে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের স্মার্ট কার্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। ২০১৭ সালে কার্ড বিতরণ শুরু হয়। এরপর নানা জটিলতায় তিন বছরেরও বেশি সময় স্মার্ট কার্ড প্রদান কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ২০২০ সালে পুনরায় কার্ড বিতরণ শুরু হয়। এই কার্ডে শিক্ষার্থীদের নাম, নিবন্ধন নম্বর, আইডি কোড, ছবি, বিভাগ, হলের নামসহ ব্যক্তিগত সব তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। বিতরণের সময় জানানো হয়, এই কার্ড ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার নম্বরপত্র ও সনদপত্র তোলা, গ্রন্থাগার, বিভাগ, ইনস্টিটিউট, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস, হল অফিস এবং নিরাপত্তাবিষয়ক বিভিন্ন কাজ করার সুযোগ পাবেন। তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ-এসব সুযোগ-সুবিধার কোনোটিই নিশ্চিত করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী আরাফাত রহমান বলেন, ‘আমি ২০১৬-১৭ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় স্মার্ট কার্ডের জন্য ৫০০ টাকা ফি দিয়েছি। ২০২০ সালে এসে কার্ড হাতে পাই। তবে এখন পর্যন্ত কোনো একাডেমিক কাজে এই কার্ড ব্যবহার করতে পারিনি।’
সরেজমিন পরিদর্শনে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রবেশ, বই ইস্যুসহ কোনো কাজেই এই কার্ডের ব্যবহার দেখা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয়ও এই কার্ডের ব্যবহার দেখা যায়নি। এখনো হলগুলোয় এনালগ কার্ডের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হচ্ছে। স্মার্ট কার্ড থাকা শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ফি দেওয়ার মাধ্যমে নবায়ন করতে হচ্ছে এনালগ হল কার্ড। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মার্ট কার্ডের ব্যবহরের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান বলেন, ‘উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একটি কার্ডে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক, আবাসিক, ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ যাবতীয় তথ্য অন্তর্ভুক্ত থকে। তারা আবাসিক হলে প্রবেশ, লাইব্রেরি, ল্যাব ব্যবহারসহ সব সেবা গ্রহণ করতে স্মার্ট আইডি কার্ড ব্যবহার করে থাকে। তবে উপযুক্ত অবকাঠামো না থাকায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্মার্ট কার্ডের সুবিধা নিতে পারছে না।’
স্মার্ট কার্ডের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটার সঙ্গে সম্পর্ক করে প্রতিটি বিভাগে ডেটবেজ তৈরি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো সিস্টেমটি পর্যায়ক্রমে অটোমেটিক করতে হবে।’
এদিকে সব শিক্ষার্থীকে স্মার্ট কার্ড সরবরাহ না করা হলেও ভর্তির সময় টাকা আদায় অব্যাহত আছে। রেজিস্ট্রার ভবন সূত্রে জানা যায়, স্মার্ট কার্ড বাবদ ২০১৬-১৭ সেশনের ৬ হাজার ৬৬৬ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫০০ টাকা হারে প্রায় ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা আদায় করা হয়। পরের বছর টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয় জনপ্রতি ৬০০ টাকা। ফলে ২০১৭-১৮ সেশনের ৭ হাজার ৫৩ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৬০০ টাকা হারে প্রায় ৪২ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ টাকা, ২০১৮-১৯ সেশনের ৭ হাজার ১২৮ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৬০০ টাকা হারে প্রায় ৪২ লাখ ৭৬ হাজার ৮০০ টাকা, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ৭ হাজার ১১৮ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৪২ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ৭ হাজার ১২৫ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৪২ লাখ ৭৫ হাজার এবং সর্বশেষ ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৬ হাজার ১১০ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৩৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সব মিলে ছয় বছরে স্মার্ট কার্ড বাবদ প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৪০০ টাকা আদায় করা হয়।
এদিকে টাকা নিলেও সঠিক সময়ে স্মার্ট কার্ড না দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিরুদ্ধে। ২০২০-২১ সেশনের আরেফিন সুলতান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি ভর্তির সময় স্মার্ট কার্ডের জন্য ৬০০ টাকা দিয়েছি। কিন্তু এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমাকে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়নি।
স্মার্ট সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ভর্তি কমিটির আহ্বায়ক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের কাজ ছিল কার্ড ইস্যু করা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এটা নিয়েই আমরা অনেক হিমশিম খেয়েছি। ২০১৯-২০ সেশন পর্যন্ত সবাইকে দেওয়া হয়েছে। ২০২০-২১ সেশনের কার্ড দেওয়া এখন শুরু হবে। এটাকে অন্য জায়গায় ব্যবহার করা যেমন: লাইব্রেরিতে হাতে করে হলেও ব্যবহার করছে তারা। লাইব্রেরিতে ডিজিটাল গেটের জন্য সফটওয়্যারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দুই মাসের মধ্যেই হয়তো এটা চালু হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, হল, বিভাগে এটা ব্যবহার করা হবে কি না, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। যদি কোনো হল চায় তাহলে তারা স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে সেবা দিতে পারবে। এটা হলের এখতিয়ার। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই কিংবা নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি।
সূত্র : যুগান্তর