8 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

সেই শামীমাকে সিরিয়া পাচার করেছিল কানাডার গুপ্তচর

সেই শামীমাকে সিরিয়া পাচার করেছিল কানাডার গুপ্তচর

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি গ্রুপ ইসলামিক স্টেট বা আইএসে যোগ দেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্য থেকে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগমকে সিরিয়া পাচার করেছিল কানাডার নিরাপত্তা সংস্থার এক গুপ্তচর। বিবিসি এমন কিছু নথি দেখেছে, যাতে এই গুপ্তচর দাবি করেছেন তিনি শামীমার পাসপোর্টের বিস্তারিত তথ্য কানাডাকে জানিয়েছিলেন। শুধু শামীমা নয় আরও ব্রিটিশ নাগরিককে আইএসের হয়ে লড়াই করার জন্য সিরিয়া পাচার করেন তিনি। কানাডা এবং যুক্তরাজ্য সরকার এই বিষয়টি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বলে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

- Advertisement -

পূর্ব লন্ডনের তিন স্কুলছাত্রী শামীমা, খাদিজা সুলতানা এবং আমিরা আবাসি ২০১৫ সালে সিরিয়ায় পালিয়ে যান আইএসে যোগ দিতে। সে সময় শামীমার বয়স ছিল ১৫ বছর। অপর দুজনের বয়সও ছিল যথাক্রমে ১৬ এবং ১৫। সিরিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার শামীমার নাগরিকত্ব বাতিল করে। অবশ্য তার আইনজীবীরা অবশ্য ব্রিটিশ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, শামীমা পাচারের শিকার হয়েছিলেন।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানায়, যুক্তরাজ্য থেকে পালিয়ে শামীমা ও তার সঙ্গীরা যান তুরস্কে। ইস্তাম্বুলের প্রধান বাসস্টেশনে তাদের সঙ্গে মোহাম্মদ আল রশিদ নামে এক ব্যক্তির দেখা হয়। ওই ব্যক্তিই তাদের সিরিয়ার আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যেতে সাহায্য করেন। আল রশিদ যখন এভাবে সিরিয়ায় লোকজনকে পাচার করছিলেন, তখন তিনি কানাডার একটি নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য পাঠাতেন। বিবিসির কাছে এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কানাডার এক ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি আইএস দমনে একটি আন্তর্জাতিক জোটের অন্তর্ভুক্ত সংস্থায় কাজ করেন।

বিবিসি মোহাম্মদ আল রশিদের ওপর একটি নথি সংগ্রহ করেছে, যাতে তার ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংগৃহীত তথ্যই শুধু নয়, তার কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভ থেকে সংগৃহীত তথ্যও রয়েছে। কীভাবে তিনি কাজ করতেন তার ধারণা পাওয়া যায় এসব তথ্য থেকে। আল রশিদ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, তিনি যাদের সিরিয়ায় পাচার করতে সাহায্য করতেন, তাদের তথ্য আবার জর্দানে কানাডার দূতাবাসের হাতে তুলে দিতেন।

শামীমাকে সিরিয়ায় পাচারের কয়েক দিনের মধ্যেই তুরস্কে গ্রেপ্তার হন আল রশিদ। তখন তিনি তুরস্কের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, শামীমা যে পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভ্রমণ করছিলেন, তিনি সেটির একটি ছবি শেয়ার করেছেন। অর্থাৎ লন্ডন পুলিশ যখন শামীমার সন্ধান করছিল, ততদিনে কানাডার নিরাপত্তা সংস্থার হাতে তার পাসপোর্টের বিস্তারিত তথ্য চলে যায়। তবে শামীমা ততদিনে সিরিয়ায় পৌঁছে যান।

আল রশিদের থেকে পাওয়া নথি থেকে দেখা যায়, শামীমাকে সিরিয়ায় পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল আইএসের নেটওয়ার্কের একটি বড় অংশ। এটি নিয়ন্ত্রিত হতো আইএসের রাজধানী বলে কথিত রাকা থেকে। আল রশিদ ছিলেন এই নেটওয়ার্কের তুরস্কের দিকের অংশের সঙ্গে যুক্ত। শামীমা এবং তার দুই বান্ধবীকে সাহায্য করার আট মাস আগে থেকেই তিনি ব্রিটিশ নারী-পুরুষ-শিশুদের সিরিয়ায় পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

বিবিসি জানায়, তারা অচিরেই ‘আই এম নট এ মনস্টার’ নামে সম্প্রচার করতে যাচ্ছে এমন একটি পডকাস্ট যেখানে কথা বলেছেন শামীমা, সেখানে তিনি বলেছেন, আল রশিদ তুরস্ক থেকে সিরিয়া পর্যন্ত যাওয়ার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করে দিয়েছিল তাদের। তার মনে হয় না পাচারকারীদের সাহায্য ছাড়া কারও পক্ষে সিরিয়ায় যাওয়া সম্ভব ছিল। আল রশিদ আরও বহু মানুষকে সিরিয়া যেতে সাহায্য করেন। ওই ব্যক্তি আমাদের যা যা করতে বলেছিলেন, আমরা তাই করছিলাম। কারণ তিনি সব জানতেন, আমরা তো কিছ্ইু জানতাম না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আল রশিদ যাদের সিরিয়া যেতে সাহায্য করেছিলেন, তাদের সব তথ্য তিনি সংরক্ষণ করতেন। তাদের পরিচয়পত্রের ছবি তুলে রাখতেন, অনেক সময় গোপনে ফোনে তাদের ভিডিও রেকর্ড করতেন। এমন একটি রেকর্ডিংয়ে দেখা যায়, শামীমা এবং তার বান্ধবীরা সিরিয়ার সীমান্তের কাছে একটি ট্যাক্সি থেকে বের হচ্ছেন, এরপর অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠছেন। আল রশিদ আইএস সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করতেন। সিরিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যেসব যোদ্ধা গিয়েছিল, তারা যেসব বাড়িতে থাকত ম্যাপে সেগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করতেন। এ ছাড়া ইন্টারনেটের আইপি অ্যাড্রেস এবং আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যেসব ইন্টারনেট ক্যাফে আছে, সেগুলো খুঁজে বের করতেন। আইএস যোদ্ধাদের সঙ্গে তার যে কথা চালাচালি হতো, সেগুলোরও স্ক্রিনশট রাখতেন তিনি।

একটি রেকর্ডে দেখা যায়, আল রশিদ এমন একজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, যিনি এক কুখ্যাত ব্রিটিশ আইএস যোদ্ধা রাফায়েল হোস্টে। যে তাকে বলেছিল, আমি চাই তুমি আমাদের সঙ্গে কাজ করো। আমি চাই তুমি আমাদের হয়ে লোকজনকে এখানে আনতে সাহায্য করো। জবাবে রশিদ লেখেন, ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করতে পারেন? এরপর রাফায়েল হোস্টে জবাব দেন, এখন যা করছ, সেটাই করবে। কিন্তু তুমি আমাদের হয়ে কাজ করবে। আমাদের জন্য জিনিসপত্র নিয়ে আসবে, আমাদের ভাই-বোনদের এখানে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে। রশিদ উত্তর দেন, ভাই আমি প্রস্তুত আছি।

শামীমাকে পাচারে সাহায্য করার কিছুদিনের মধ্যেই রশিদ তুরস্কের সানলিউরফা শহর থেকে গ্রেপ্তার হন। তখন এক বিবৃতিতে রশিদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানিয়েছিলেন, ২০১৩ সালে তিনি জর্দানে কানাডার দূতাবাসে গিয়েছিলেন আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন জানাতে। তখন ওরা বলেছিল, আমি যদি আইএসের তৎপরতার খবর সংগ্রহ করে দিতে পারি, তারা আমার আবেদন মঞ্জুর করবে। রশিদ যে ২০১৩ সাল হতে ২০১৫ সালের মধ্যে কয়েকবার জর্দানে আসা-যাওয়া করেছেন তা বিবিসি নিশ্চিত করতে পেরেছে।

এদিকে শামীমা বেগমের আইনজীবী তাসনিম আকুঞ্জি বলেছেন, আগামী নভেম্বরে তার মক্কেলের নাগরিকত্ব বাতিল চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা আবেদনের শুনানি হবে। তখন তাদের একটি প্রধান যুক্তি হবে, শামীমা যে পাচারের শিকার হয়েছিলেন সেটি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ বিবেচনায় নেননি। এটা হতবাক হওয়ার মতো ব্যাপার যে, কানাডার একটি গুপ্তচর সংস্থার কেউ একটি পাচার অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এ ব্যাপারে কানাডার নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার একজন মুখপাত্র বলেন, তাদের তদন্ত, কার্যক্রম, কার্যপদ্ধতি বা তৎপরতা সম্পর্কে তিনি প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে পারছেন না, কোনো কিছু স্বীকার বা অস্বীকারও করতে পারছেন না। ব্রিটিশ সরকারের একজন মুখপাত্র বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের অনুসৃত নীতি হচ্ছে নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করা।

শামীমা বর্তমানে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার এক বন্দি শিবিরে আটক আছেন। আইএসের তথাকথিত খেলাফত ধসে পড়ার পর যখন শামীমা প্রকাশ্যে আসেন, তখন ব্রিটিশ সরকার ২০১৯ সালে তার নাগরিকত্ব বাতিল করে।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles