9.2 C
Toronto
বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

আলো-ঝলমলে দুবাইয়ে ‘দাসত্বের জীবন’

আলো-ঝলমলে দুবাইয়ে ‘দাসত্বের জীবন’ - the Bengali Times

কাতারের পর এবার আলো-ঝলমলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাইয়ে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ইউএইতে বর্তমানে চলছে আন্তর্জাতিক মেলা ‘দুবাই এক্সপো ২০২০’। বিশ্বের ১৯২টি দেশ থেকে আড়াই কোটি দর্শনার্থী এ মেলা পরিদর্শন করবেন বলে ইউএইর ধারণা। এই আয়োজনে ইউএইর ব্যয় হয়েছে কয়েক শ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু এই বিশাল আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন ঠেকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে আরব আমিরাত।

- Advertisement -

করোনার কারণে পিছিয়ে যাওয়া এই মেলার উদ্বোধন করা হয় গত বছরের ১ অক্টোবর। এই মেলা ১৮২ দিন চলবে বলে জানিয়েছে আয়োজক দেশটি।

আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। এ নিয়ে কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও অনুসন্ধানমূলক খবর প্রকাশ করেছে। কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, চলমান দুবাই এক্সপো নিয়ে সর্বশেষ ২ ফেব্রুয়ারি ৩৭ পৃষ্ঠার গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক শ্রমিকদের অধিকারবিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইকুইডেম। এতে এই মেলা আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানির শ্রমিকদের বেতনবৈষম্য ও অতিরিক্ত খাটানোর বিষয়টি উঠে আসে।

এর আগে কাতার ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনকে কেন্দ্র করেও শ্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল। বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে ১০ বছর ধরে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১২ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে কাতার বিশ্বকাপ আয়োজন উপলক্ষে স্টেডিয়াম ও বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে। এই শ্রমিকেরা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার নাগরিক। এর মধ্যে পাকিস্তান বাদে ৪টি দেশে গার্ডিয়ান তাদের নির্ভরযোগ্য সূত্র ও দেশগুলোর সরকারি হিসাবের বরাত দিয়ে জানিয়েছিল, বিশ্বকাপ আয়োজন উপলক্ষে ২০১১-২০ সাল পর্যন্ত ৫ হাজার ৯২৭ জন প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ১ হাজার ১৮ জন। আর কাতারে পাকিস্তানের দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ে ৮২৪ জন পাকিস্তানি শ্রমিক সেখানে মারা যান।

কাতার বিশ্বকাপের মতো দুবাই এক্সপোতেও প্রায় একই ধরনের শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের চিত্র উঠে এসেছে ইকুইডেমের প্রতিবেদনে। ইকুইডেমের গবেষকেরা গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাস দুবাই এক্সপো নিয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করেন। এ সময় তাঁরা অভিবাসী শ্রমিকদের ৭০টি সাক্ষাৎকার নেন।

গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাক্ষাৎকারদাতাদের কেউ কেউ আংশিক বেতন পেয়েছেন বা প্রতি মাসে তাঁদের মজুরি পাওয়ার জন্য এক সপ্তাহের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর মধ্যে তাঁদের খাবারের অর্থও আটকে ছিল। শ্রমিকদের প্রায়ই ওভারটাইম ভাতা, কাজ থেকে অব্যাহতিকালীন সুবিধা ও প্রতিশ্রুত বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। করোনা মহামারির দোহাই দিয়ে নিয়োগকর্তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেতন কমিয়েছেন বলে শ্রমিকদের অভিযোগ।

একজন শ্রমিক ইকুইডেম গবেষকদের বলেছেন, ‘তাঁরা (নিয়োগকর্তারা) কর্মীদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করেন, তা দাসের মতো। এটা খুব ক্লান্তিকর। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করি। আমি কখনোই অতিরিক্ত সময়ের জন্য অর্থ (ওভারটাইম পেমেন্ট) পাইনি।’

ইকুইডেমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাক্ষাৎকার দেওয়া বেশির ভাগ কর্মীকে তাঁদের কাজ পেতে অবৈধ নিয়োগ ফি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল, যার পরিমাণ মাঝেমধ্যে তাঁদের মাসিক বেতন ছাড়িয়ে যেত। ইকুইডেম গবেষকেরা যেসব শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগকে তাঁদের পাসপোর্টগুলো নিয়োগকর্তাদের কাছে জমা রাখতে হয়েছে। তাঁদের কেউই প্রয়োজনের সময় বিনা শর্তে এসব পাসপোর্ট নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে নিতে পারেননি। অথচ আরব আমিরাতের আইন অনুযায়ী কোম্পানিগুলো শ্রমিকদের পরিচয় শনাক্ত-সংক্রান্ত এমন নথি নিজেদের কবজায় রাখতে পারেন না।

শ্রমিকদের ভাষ্য, তাঁদের বৈষম্যের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে খাটানো হয়। একজন সাক্ষাৎকারদাতা বলেন, যেখানে ইউরোপীয় ও আরবদের হালকা কাজের বিপরীতে বেশি বেতন দেওয়া হয়, সেখানে ভারী কাজের বিপরীতে এশীয়দের দেওয়া হয় কম বেতন। আবার এশীয়রাই প্রথম চাকরি হারান।

সংযুক্ত আরব আমিরাত এমন একটি দেশ, যেখানে ১৯৬০ সালের আগপর্যন্ত দাসপ্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়নি। কাগজে-কলমে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও এখনো দেশটিতে বর্ণবাদ গভীরভাবে গেঁথে রয়েছে। সেখানে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে যাওয়া কালো বর্ণের কর্মীরা নিয়মিতভাবে তাঁদের সাদা বর্ণের সহকর্মীদের তুলনায় কম মজুরি পাওয়ার কথা জানান।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক্সপো কর্মীরা গবেষকদের জানিয়েছেন, তাঁরা কর্মপরিবেশ ও হয়রানির বিষয়ে কথা বললে নিয়োগকর্তা ও পুলিশের রোষানলে পড়তে হয়। এ জন্য তাঁরা কাজ থেকে বরখাস্ত ও বিতাড়নের মতো প্রতিশোধপরায়ণ কর্মকাণ্ডের ভয়ে থাকেন। শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন ও বিভিন্ন দাবি আদায়ে লোকজনকে একত্র করাকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

অথচ এ আন্তর্জাতিক মেলা উপলক্ষে আমিরাত কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক শ্রম আদায়ের বিরুদ্ধে জোরদার ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তারা এক্সপো কর্মীদের অধিকার রক্ষায় নির্দেশিকা প্রণয়ন করে। শ্রমিকেরা যাতে শোষিত না হন, তা নিশ্চিত করতে সংযুক্ত আরব আমিরাত কোম্পানি পরিদর্শক পর্যন্ত মোতায়েন করে। তবে প্রতিবেদনে নিয়োগকর্তাদের কারও মান মেলার অনুষ্ঠানের মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে মনে হয়নি।

ইকুইডেমের এই প্রতিবেদনের লেখক ও প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কাদরি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সেখানে যেভাবে শ্রম আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে ও জোরপূর্বক শ্রম আদায় করা হচ্ছে, তা দেখে তিনি সত্যিই হতবাক হয়েছিলেন। এটা দেখার পর সংযুক্ত আরব আমিরাতে শ্রমব্যবস্থা আসলে কতটা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, দুবাই এক্সপো দেশটির অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প। তিনি আরও বলেন, ‘এই মেলা আয়োজন উপলক্ষে বহু আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের পেছনে লাখ লাখ ডলার খরচ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, আসলেই আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক শ্রম আদায় ঠেকাতে সত্যিকার অর্থে আন্তরিক কি না; নাকি এটি দেশটির সামগ্রিক খারাপ অবস্থার খণ্ডচিত্রমাত্র।’

এর আগে গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) দুবাই এক্সপো ২০২০-তে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের নিন্দা করেছে। এর কয়েক মাস পরই ইকুইডেমের এ প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। এইচআরডব্লিউ বলছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো ধামাচাপা দিতে নানা প্রচারণা চালিয়ে আসছে। হলো তারই একটি অংশ দুবাই এক্সপো।

এইচআরডব্লিউ বলছে, আমিরাত সরকার জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের ও মানবাধিকারবিষয়ক গবেষকদের এসব বিষয়ে জানাতে কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি। তারা বরাবরই দেশটিতে তাঁদের প্রবেশাধিকার অস্বীকার করে। এ কাতারে সমালোচনাকারী সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদেরাও রয়েছেন। এদিকে গত বছর শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। তারা তখন সদস্যদেশগুলোকে এক্সপো বয়কট করার আহ্বান জানিয়েছিল।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনেক বিদেশি থাকেন, যাঁদের মূলত বেশির ভাগ অভিবাসী শ্রমিক। এই দেশ চলে মূলত অভিবাসী শ্রমিকদের কাঁধে ভর করে। এর মধ্যে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে সেখানে কম মজুরিতে লাখ লাখ শ্রমিক নেওয়া হয়। দেশটির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা, অতিরিক্ত শ্রমঘণ্টা আদায় ও শ্রমিকদের খারাপ আবাসস্থল রাখার অভিযোগ চলে আসছে।

আল-জাজিরার পক্ষ থেকে ইকুইডেমের প্রতিবেদন সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও এক্সপো আয়োজকেরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। অন্যদিকে এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য আল-জাজিরার অনুরোধে সাড়া দেয়নি ইউএই কর্তৃপক্ষও।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles