
কিডনি শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। মানুষ যেসব প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তার মধ্যে কিডনি রোগ অন্যতম। শতকরা ৫০ভাগ ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত সাধারণত লক্ষণগুলো ভালোভাবে প্রকাশও পায় না। এই রোগটি নীরব ঘাতক হয়ে শরীরের ক্ষতি করে। তাই কিডনি রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো আগে থেকেই জেনে রাখা জরুরি। সেই সঙ্গে জানা দরকার প্রতিরোধে করণীয়।
কিডনির কাজ
কিডনির মূল কাজ হলো পুরো শরীরের রক্ত পরিশোধিত করা এবং দূষিত বর্জ্য বের করা দেওয়া। হার্ট রক্তকে পাম্প করে কিডনিকে দিচ্ছে, কিডনি পরিশোধিত করে হার্টে পাঠাচ্ছে। এভাবে সার্বক্ষণিক চলছে। পরিশোধিত রক্ত মানুষের পুরো শরীরে শক্তি দিচ্ছে। ফলে মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছে। প্রতিদিন একটি কিডনি ১২০ থেকে ১৫০ লিটার রক্ত পরিশোধিত করে এবং দেড় থেকে দুই লিটার দূষিত বর্জ্য শরীর থেকে বের করে দেয়। পানি হোক, লবণ হোক, দূষিত যে কোনো কিছুই কিডনি শরীর থেকে বের করে দেয়। এসব দূষিত বর্জ্যের ৯৫ ভাগের বেশি প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। বাকি বর্জ্য কিছু ঘামের মাধ্যমে বের হয়, কিছু পায়খানার মাধ্যমে বের হয়, কিছু নিশ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে বের হয়।
কিডনি প্রয়োজনীয় পানি রেখে বাকিগুলো বের করে দেয়। যেমন: একজন মানুষ দশ গ্লাস পানি খেয়েছেন এবং ঘনঘন প্রস্রাব করছেন, এর কারণ হলো-পানি অতিরিক্ত খাওয়া। কিডনি প্রয়োজনীয়টা রেখে বাকিটুকু বের করে দিচ্ছে। আবার কেউ যদি ২৪ ঘণ্টায় একগ্লাস পানি খায় তাহলে সারাদিন তার আর প্রস্রাব হবে না। কারণ, কিডনি প্রয়োজনীয় পানি ধরে রাখবে। শরীরের কার্যক্ষমতা ব্যবস্থাপনার জন্য ন্যূনতম দেড় থেকে দুই লিটার পানি দরকার। সেখানে কোনো মানুষ যদি এক লিটার পানি খায়, দেখা যাবে দিনশেষে তার অল্প একটু প্রস্রাব হবে।
কিডনি রোগ
প্রস্রাবের নালী, প্রস্রাবের থলি, প্রস্রাবের রাস্তা পুরো প্রক্রিয়াকে নিয়ে কিডনি কাজ করে। এসবের যে কোনো জায়াগয় রোগ হলে এটিকে সাধারণত কিডনি রোগ বলা হয়। কিডনি একটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন তৈরি করে। যেটিকে এরিথ্রোপোয়েটিন বলে। এ হরমোন শরীরের রক্ত তৈরি করে। এর ৯০ ভাগ আসে কিডনি থেকে। কিডনি যখন অসুস্থ হয়ে যায় তখন এ হরমোন তৈরি কমে যায়। এতে রক্ত শূন্যতা তৈরি হয়, হার্ট ফেইলিউর হয়, ক্ষুদামন্দা, ও খেতে না পারার কারণে শরীর দুর্বল হয়ে যায়। এসময় শরীরের বর্জ্যগুলো মস্তিষ্কে, হার্টে, হাড়ে জমে যায়। এতে প্রস্রাব কমে যায়, উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায় ও শরীর ফুলে যায়।
কারণ
কিডনি রোগের ৮০ ভাগের কারণ জানা যায়না। যতটুকু জানা গেছে, সারা দুনিয়াতে কিডনি রোগের এক নাম্বার কারণ ডায়াবেটিস। বাংলাদেশে এটি দুই নাম্বার কারণ। উচ্চ রক্তচাপ সারা দুনিয়ায় ২ নাম্বার কারণ, বাংলাদেশে তিন নাম্বার কারণ। আমাদের দেশে কিডনি রোগের এক নাম্বার কারণ নেফ্রাটাইসিস। এরপর পাথর হয়ে প্রস্রাবের নালী বন্ধ হয়ে যায়। আবার কিছু বংশগত কিডনি রোগও আছে। কিডনি অকেজো হওয়ার জন্য ওষুধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ। শরীরে কোনো ব্যথা হলে অনেকে ফার্মেসি থেকে ওষুধ সেবন করে। এটি ম্যাজিকের মতো কাজ করে। কিন্তু ফার্মেসি থেকে ভুল ওষুধ সেবনের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। ফার্মেসির লোকতো জানে না একটি ওষুধের কি পরিমাণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে।
যেখানে চিকিৎসক জানে এ রোগের এ ওষুধ তাও ওষুধ দিচ্ছেন না। সেখানে ফার্মেসি অহরহ ব্যথার ওষুধ রোগীকে প্রয়োগ করে। ব্যথার ওষুধ স্পর্শকাতর। একটি ব্যথার ওষুধই কিডনি অকেজো হওয়ার জন্য যথেষ্ট। অনেক সময় রোগীরা একটি ব্যথার ওষুধ খেয়ে চলে আসে। কারো পিঠে ব্যথা করছে তিনি একটি ওষুধ খেয়েছেন, এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকের কাছে আসার পর ওষুধ বন্ধ করে কিছু ওষুধ দিলে সাথে সাথে ভালো হয়ে যায়। এন্ট্রিবায়েটিকের কারণে কিডনি বিকল হতে পারে এবং নেশা জাতীয় দ্রব্যের কারণে বিকল হয়। পানি শূন্যতার কারণে তাৎক্ষণিক কিডনি অকেজো হয়ে যায়। যেমন: ডায়রিয়া হলে, রক্তক্ষরণ হলে, বমি করলে, সন্তান প্রস্রব পরবর্তী জটিলতায় অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণ হলে। হঠাৎ করে কিডনিতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে কিডনির সেলগুলো অক্সিজেন পায় না। এতে কিডনি বিকল হয়ে যায়। এ ছাড়াও কিছু ইনফেকশনের কারণে কিডনি রোগ হয়। যেমন: হেপাটাইটিস বি, সি ও স্ট্রেপ্টোকক্কাস।
লক্ষণ
কিডনি রোগ হলো নিরব ঘাতক। ৫০ ভাগ অকেজো হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এরপর যেসব লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়-
১. শরীরের ফুলে যায়, আর ফোলাটা যদি শুরু হয় মুখমন্ডল থেকে।
২. প্রস্রাব কমে যায় আবার বেড়েও যেতে পারে। যেমন: ডায়াবেটিস রোগীর বেড়ে যায়।
৩. প্রস্রাবের রঙের পরিবর্তন হওয়া ও প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া।
৪. ক্ষুদামন্দা, বমি করা, খেতে ইচ্ছে না করা, রক্ত শূন্যতা দেখা দেওয়া।
৫. কোনো কাজে আগ্রহ না পাওয়া, শরীর সবসময় চুলকানি থাকে।
৬. কোমড়ের দুই পাশে যদি ব্যথা হয়। এই ব্যথা তলপেটেও হতে পারে।
৭. উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিলে।
যেসব সমস্যা হয়
কিডনি একটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন তৈরি করে, যেটিকে এরিথ্রোপোয়েটিন বলে। এ হরমোন শরীরের রক্ত তৈরি করে। এর ৯০ ভাগ আসে কিডনি থেকে। কিডনি যখন অসুস্থ হয়ে যায় তখন এ হরমোন তৈরি কমে যায়। ফলে রক্ত শূন্যতা তৈরি হয় এবং হার্ট ফেইলিউর, ক্ষুদামন্দা, খেতে না পারা ও শরীর দুর্বল হয়ে যায়। এসময় মস্তিষ্কে, হার্টে ও হাড়ে বর্জ্যগুলো জমে যায়। ফলে প্রস্রাব কমে যায়, উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়। শরীর ফুলে যায়। কিছু পদ্ধতির তারতম্যের জন্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সমস্যার কারণে কিডিনির ছাকনি নষ্ট হয়ে যায়। ছাকনি নষ্ট হলে প্রোটিন লিক করে প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যায়। ছোট ছোট মেমরেইন আছে যেটি দিয়ে প্রোটিন বের হতে পারে না, শুধু দূষিত পানি বের হয়ে যেতে পারে। যখন কোনো রোগের কারণে মেমরেইনটা নষ্ট হয়ে যায় তখন দূষিত জিনিস বের হওয়ার সঙ্গে প্রোটিনটাও বের হয়ে যায়। ফলে রক্তকে রক্তনালীতে আর ধরে রাখা যায় না। রক্তের পানি, প্লাজমা শরীরের বাহিরে চলে আসে। ফলে শরীর বিভিন্ন অংশ ফুলে যায়। এবং ছাকনির মধ্যে যদি পানি জমে যায় তখন লবণও শরীরে জমে যায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়।
প্রতিরোধে করণীয়
যে কোনো ব্যক্তির উচিত চল্লিশ বছরের পরে একবার হলেও পরীক্ষা করা। বছরে দুই একবার ডায়াবেটিস রোগীদের পরীক্ষা করলে কিডনি রোগ ধরা পড়ে এবং আগামী দুই এক বছরে হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা সেটিও বুঝা যায়। ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার ১৫ থেকে ২০ বছর পর কিডনি রোগ হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে সাত থেকে ১০ বছর পরে হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলেও শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ মানুষের কিডনি ফেইলিউর হয়। রোগীরা খুব দ্রুত চিকিৎসা নিলে ৯০-৯৫ ভাগ রোগী এক দুই সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। ডায়রিয়া ও বমি হলে একবারে কিছু না করতে পারলে যে পানি শূন্যতা হলো সেটি রিপ্লেস করে নেওয়া। যেমন: আপনি একটি স্যালাইন খেতে পারেন অথবা স্যালাইন শরীরে দিতে পারেন। এ ছাড়া আরো যেসব করণীয় রয়েছে-
১. ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
২. পরীক্ষা করতে হবে।
৩. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ব্যথার ওষুধ এবং এন্টিবায়েটিক খাওয়া যাবে না।
৪. অল্প থাকতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. নেফ্রাইটিস থাকলে চিকিৎসা করতে হবে।
৬. পাথর যাতে ব্লক করতে না পারে এজন্য চিকিৎসা নিতে হবে।
৭. প্রোস্টেট ব্লক থাকলে সেটি দূর করতে হবে।
৮. ডায়রিয়া ও বমি হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নিতে হবে।
৯. প্রস্রাব কমে গেলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া। এতে ৯০-৯৫ ভাগ স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসে। তবে এক দুই সপ্তাহ চলে গেলে আর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না।
১০. প্রস্রাবকালীন জটিলতা পরিহার করতে হবে। গ্রাম্য দায়ী, অদক্ষদের দিয়ে সন্তান প্রস্রাব করানো যাবে না।
১১. প্রস্রাবের ইনফেকশন যখন রক্তে ছড়ায় তখন এটি কিডনিকে খারাপ করে দেয়। এজন্য ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।