10.7 C
Toronto
বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

কল্পনা আৱ বাস্তবেৱ মিশেলে এক জীবন

কল্পনা আৱ বাস্তবেৱ মিশেলে এক জীবন
আমার জীবনে কিছুই পরিকল্পনা করে ঘটেনি সবকিছু ঘটেছে আকস্মিক নিজের অজান্তে কল্পনাবিলাস থেকে বিদেশ বলতে আমার কাছে সবসময় মনে হতো লম্বা প্লেন জার্নি করে দূরের কোনো দেশে যাওয়া


আমার কানাডা আসাটা বেশ ইন্টারেস্টিং। একটু বিলাসী ভাবনা ছিল বলা যায়। এমনকি আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমনও তাই। একটা ফ্যান্টাসি কাজ করেছে সবকিছুর মধ্যে। আমার জীবনে কিছুই পরিকল্পনা করে ঘটেনি। সবকিছু ঘটেছে আকস্মিক, নিজের অজান্তে কল্পনাবিলাস থেকে। বিদেশ বলতে আমার কাছে সবসময় মনে হতো লম্বা প্লেন জার্নি করে দূরের কোনো দেশে যাওয়া। এটা মনে হয়েছে বই পড়ে। স্কুলে পড়ার সময়ে শংকরের ভ্রমন কাহিনী এপার বাংলা ওপার বাংলা পড়ে আমি প্রথম আমেরিকা সম্পর্কে জানতে পারি। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম সত্যি ও রকম একটা স্বপ্নের মতো দেশ পৃথিবীতে আছে! তখন থেকেই আমার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল যদি আমি কোনোদিন বিদেশে যাই তাহলে সেটা হবে আমেরিকা। এবং আমি প্রথম যাব নিউইয়র্ক। বিশ্বের রাজধানী নিউইয়র্ক। আমার মাথায় একটা কিছু ঢুকলে আর সহজে বের হতে চায় না। সারাক্ষন ঘুরপাক খেতে থাকে। আমার জন্য যা অসম্ভব তাও মাথায় ঘুরতে থাকে। কল্পনা করতে তো পয়সা লাগে না। কেউ জানতেও পারে না। আমার শৈশব কৈশোর এমনই ঘটনাবিহীন ছিল যে আমি কখনও ঢাকা শহরটা দেখতে পারব কিনা সেটাই জানতাম না। আমেরিকা দেশটা কোথায়, কতদূর তাও জানিনা। বই পড়েই যেটুকু জেনেছি। আমি যেহেতু কল্পনাবিলাসী মানুষ তাই মাথা থেকে কিছু যায় না সহজে। বই-ই আমার কল্পনাকে উসকে দিয়েছে।

যখন আমি স্কুলে পড়ি, তখন থেকেই পত্র পত্রিকা কিনতাম। বিচিত্রা পত্রিকাটা পড়তাম আর ভাবতাম এমন দারুণ একটা পত্রিকায় আমি যদি লিখতে পারতাম! আরও ভাবতাম আমি যদি সত্যি ঢাকা যেতে পারি তাহলে বিচিত্রায় কাজ করব এবং অবশ্যই চেষ্টা করব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে! না জানি ওখানকার স্টুডেন্টরা কেমন, কত নাম ডাক। বিশ্ববিদ্যালয় বলতে শুধু এই নামটাই জানতাম আমি। ছাত্র হিসাবে আমি ছিলাম মধ্যম মানের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা কি আমার হবে! স্কুলে থাকতে আমার কোনো টিউটর ছিল না, গৃহ শিক্ষক ছিল না। টিউটর রাখার কথা কারো মাথায় আসেনি কখনও। তাও ক্লাসে আমি ফার্ষ্ট, সেকেন্ড হতাম। আমার ইমাজিনেশন অনেক ভাল। ওটাই আমাকে সাহায্য করেছে সারাজীবন। অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। বরিশাল বিএম কলেজেও আমি পড়তে চাইতাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে সবগুলো ইচ্ছাই আমার পূরণ হয়েছে। বিএম কলেজ, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে পড়া, বিচিত্রায় কাজ করা সবই ঘটেছিল।

- Advertisement -

আমি আসলে স্বাধীনতা চাইতাম। কারো নিয়ন্ত্রণে থাকতে চাইতাম না। সবার চোখের আড়ালে থাকতে চাইতাম। সেটাও পূরন হয়েছে। মহসিন হলের ৬৫৫ নম্বর রূমে নিঃসঙ্গ জীবন ছিল আমার। বিছানায় শুয়ে বাবুপুরা রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চলা দেখতে দেখতে হঠাৎ ভাবনার উদয় হলো আমার কি কখনও গাড়ি হবে! কেমন করে হবে! কল্পনায় দেখতাম আমি ড্রাইভ করছি আর আমার পাশে সুন্দরী স্ত্রী বসে আছে। আচ্ছা গাড়ি না হোক নিদেনপক্ষে আমার যদি একটা মোটর বাইক থাকত! লাল মোরগের মতো মোটরবাইক। তাহলে আমি আমার প্রেমিকাকে পিছনে বসিয়ে ঢাকা শহর চষে বেড়াব। ওই রকম দুঃসময়েও আমি এসব ভাবতাম, যখন আমার প্রায়ই খাওয়ার পয়সা থাকত না। কাপড় কেনার পয়সা থাকত না। বাংলা সিনেমা দেখে আর বই পড়ে মাথা নষ্ট হয়ে গেছে নির্ঘাৎ। কিন্তু অবাক কান্ড আমি ঠিকই মোটরবাইক কিনেছিলাম। সুন্দরী প্রেমিকাও হয়েছিল। তাঁকে নিয়ে ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছি। সেই প্রেমিকা একদিন স্ত্রীতে রূপাস্তরিত হলো। তারপর একদিন আমার গাড়িও হলো। সেটা ১৯৯৩ সাল। তখন ঢাকা শহরে আমার পর্যায়ের খুব কম মানুষের গাড়ি ছিল। ঝকঝকে টয়োটা স্টারলেট গাড়ি। আমি গাড়ি ড্রাইভ করি আর আমার সুন্দরী স্ত্রী পাশে বসে থাকে। হেমন্তের গান বাজে ক্যাসেটে.. এই পথ যদি না শেষ হয়..।

আমি কিভাবে কানাডা আসলাম সেই গল্প বলার আগে প্রথম বিদেশ আসার গল্পটা বলি। সেটা ২০০০ সালের কথা। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে আমেরিকান এম্বাসী আমাকে এক বছরের মাল্টিপল ভিসা দিল। আমার কল্পনার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ এবং সেটা আমেরিকা এবং অবশ্যই নিউইয়র্কে পদার্পন। তখনও ৯/১১ হয়নি। আমেরিকা তখনও স্বর্গ। ল্যান্ড অব অপরচুনিটি বলে সবাই। আমার বন্ধু আকবর হায়দার কিরন, শফিউদ্দিন কামাল, নাসরিন চৌধুরী এরা নিউইয়র্ক থাকেন । বিচিত্রার জনপ্রিয় প্রবাস পাতায় শফিউদ্দিন কামাল বা নাসরিন চৌধুরী লিখতেন। কিরন ভাই বিচিত্রার প্রতিনিধি। আমি প্রবাস থেকে বিভাগের সম্পাদনার দ্বায়িত্বে তখন। সেখান থেকেই ওদের সাথে যোগাযোগ। কামাল ভাই বললেন, জসিম দেশে ফিরে গিয়ে কি করবেন, থেকে যান! কেউ আমেরিকা আসলে সহজে ফেরে না। আমি বললাম কামাল ভাই, আমি তো ছেলে মেয়ে রেখে থাকতে পারব না। অরিত্রি তখন খুবই ছোট। মাত্র এক মাস আমেরিকা ছিলাম তাও ছেলে মেয়ের কথা মনে হলেই আমার চোখ ভিজে আসে। তিনি বললেন সমস্যা নাই কিছুদিন পর ফ্যামিলি নিয়ে আসতে পারবেন। কিন্তু আমি রাজী হলাম না। কামাল ভাই বললেন, তাইলে একটা কাজ করেন, দেশে গিয়ে কানাডায় ইমিগ্রেশনের জন্য চেষ্টা করেন। তখনও কানাডা সম্পর্কে কিছুই জানি না। কিভাবে ইমিগ্রেশন করতে হয় তাও জানিনা। কামাল ভাইর পরামর্শটা মাথায় ঘুর পাক খাচ্ছিল। আমার মাথায় কিছু ঢুকলে সহজে বের হতে চায় না যে!
আমি এবং জেসমিন তখন ভাল চাকরি করি। অতি ভাল চাকরি। অর্ক অরিত্রি স্কলাস্টিকায় পড়ে। বলতে দ্বিধা নেই তখন আমার দুইটা গাড়ি। আমি কেনো বিদেশ যাব! পাগল না হলে কেউ এসব ভাবে না। একদিন প্রেসক্লাবে বসে কানাডা নিয়ে কথা হচ্ছিল। আড্ডায় ছিল মুকুল ভাই আর রাজা ভাই। রাজা ভাইকে বললাম ইমিগ্রেশনের জন্য কিভাবে এপ্লাই করতে হয় তাইতো জানিনা। তিনি তৎক্ষনাত বললেন, আমার এক বন্ধু আছে সে ইমিগ্রেশন করে। তার ল’ফার্ম আছে। সেখানে গিয়ে কথা বলেন। আমি তাঁকে বলে রাখব। যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন রাজা ভাইর বন্ধু শাহ জহিরের তাজমহল রোডের অফিসে গেলাম। তিনি বললেন, রেজুমি দেন। এসেসমেন্ট করতে হবে। তখন কানাডা ইমিগ্রেশনের জন্য পয়েন্ট দরকার হতো ৭০। স্পাউসের শিক্ষাগত যোগ্যতার পয়েন্ট কাউন্ট হতো না যেটা এখন হয়। আমি পাঁচ পয়েণ্ট বঞ্চিত হলাম। আমার ওয়াইফ মাস্টার্ ছিল। আমার কোনো ব্লাড রিলেটেভও ছিল না কানাডায়। থাকলে আরো পাঁচ পয়েণ্ট পেতাম। এখন যেমন আইইএলটিএস এবং ৬৭ পয়েণ্ট লাগে।
তা সত্ত্বেও আমি কোয়ালিফাই করলাম। আমার একলারই পয়েন্ট হলো ৭২। আমি জার্নালিস্ট ক্যাটাগরিতে এপ্লাই করি। প্রথমে আমার এপ্লিকেশন নয়াদিল্লিতে পাঠানো হলো। বাংলাদেশের সবার এপ্লিকেশন নয়াদিল্লীতে প্রসেস হয় তখন এবং সময় লাগে প্রায় পাঁচ বছর। এতো ধৈৰ্য্য আমার নাই। তখন কানাডা যাওয়ার ইচ্ছা নাও থাকতে পারে। জেসমিনকে বলায় সে বলল এসব পাগলামি বাদ দাও। আমরা বিদেশ যাব না। তাই আমি হতাশ হয়ে বিদেশ যাওয়ার চিন্তা বাদ দিলাম। কিন্তু মাথা থেকে কিছুতেই বের হচ্ছে না। চলে যেতে হবে। দেখিই না কি আছে ভাগ্যে। সেবার নায়াগ্রাফলস গিয়েছিলাম ঘুরতে। ফিরে এসে সাপ্তাহিক২০০০ এ লিখেছিলামও। তখন দেখেছি ওপারেই কানাডা। এদিকে আমার এক বছরের ভিসা শেষ হওয়ার পর পাসপোর্ট ড্রপবক্স করলাম। আমাকে পাঁচ বছরের মালিটপল ভিসা দিল আমেরিকার। সেটা কিভাবে আমি কাজে লাগালাম বলি। আমি কখনও কখনও যে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করি এটা তার প্রমান। আমার এপ্লিকেশন নয়াদিল্লী থেকে ট্রান্সফার করে আমেরিকায় পাঠালেন শাহ জহির। আমেরিকায় কানাডার ভিসা প্রসেস তাড়াতাড়ি হয়। এদিকে ২০০০ সালেই ৯/১১ঘটল। পুরো পৃথিবী ওলট পালট হয়ে গেলো। ইমিগ্রেশন নিয়ম কানুন কঠোর হয়ে গেলো। কিন্তু আমি আশা ছাড়িনি।

আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে এক বছরেরও কম সময়ে আমাকে ইন্টারভিউর জন্য ডাকল। স্থান লসএঞ্জেলেস! আমি অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বে তখন। যাব কি যাব না। জেসমিন খুবই অসহযোগিতা করতে লাগল। সে ধরেই নিয়েছে আমেরিকা গিয়ে ইন্টারভিউ দেওয়ার মতো যোগ্যতা আমার নাই। গেলেও আমি পাশ করব না। খালি খালি টাকার অপচয়। যাওয়ার দরকার নাই। কিন্তু আমার মাথায় কানাডা ঢুকে আছে। বের হচ্ছে না কিছুতেই। অনেকে ভয় দেখাচ্ছিল। এই সময় আমেরিকায় মুসলমানদের ঢুকতে দেবে না। তাও বাংলাদেশের মুসলিম। কিন্তু আমি কোনো বাধাই মানলাম না। আমার বিচিত্রার বন্ধু পিয়ালকে ফোন করে সব খুলে বললাম। পিয়াল অভয় দিল। জসিম ভাই আইসা পরেন। আমি যথাসময়ে লসএঞ্জেলেস পৌঁছালাম। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে নারিতা হয়ে এলএ। এক সুন্দর সকালে দুরু দুরু বক্ষে ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হলাম। তখন ইংরেজি জ্ঞান এবং জব এক্সিপিরিয়েন্স ছিল প্রধান বিষয়। শুরু হলো ইন্টারভিউ।

ইন্টারভিউ শেষে আমার কাছে জানতে চাইল তোমার কোনো প্রশ্ন আছে! আমি বললাম আছে। গ্লাসের ওপার থেকে সুন্দরী অফিসার বলল, বলো কি প্রশ্ন। আমি বললাম, দেখো আমি বারো হাজার কিলোমিটার দূর থেকে এসেছি। শুনেছি কানাডা অনেক সুন্দর দেশ। না হলে এতো দূর আসতাম না। এখন তুমি বলো আমি ইন্টারভিউতে কোয়ালিফাই করেছি কিনা। আমার এতোদুর আসা বৃথা গেছে কিনা। মেয়েটি মিষ্টি হসে বলল, হ্যাঁ তুমি কোয়ালিফাই করেছো। শুনে আমার বুকের ভিতর একশটা ব্যঙ লাফ মারল। আমি থ্যাংকস বললাম। মেয়েটি আবার বলল, তুমি চাইলে এখনই ল্যান্ডিং ফি দিয়ে যেতে পার। চার জনের জন্য ল্যান্ডিং ফি ছিল ১২০০ আমেরিকান ডলার। অবাক কান্ড আমার পকেটে যথেষ্ট পরিমান ইউএস ডলার ছিল। আমি সাথে সাথে রাজী হলাম। মেয়েটি বলল, চার নম্বর কাউন্টারে জমা দাও। টাকা জমা দিয়ে আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে আমি সপরিবারে কানাডা যাচ্ছি।

সব ঘটনা অতি দ্রুত ঘটতে লাগল। আমি সেবার প্রায় তিন সপ্তাহের মতো মতো লসএঞ্জেলেস পিয়ালের কাছে ছিলাম। লাসভেগাস গেলাম। ফিরে আসার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সবার পাাসপোর্ট চেয়ে পাঠাল। পাসপোর্ট পাঠানোর দুই মাসের মধ্যে ভিসা হয়ে পাসপোর্ট ফেরতও আসল। তাহলে সত্যি সত্যি কানাডা যাচ্ছি! অর্ক রীতিমতো কানাডা নিয়ে গবেষনায় বসে গেলো। ছোট্ট অরিত্রি স্কুলের বন্ধুদের রেখে কিছুতেই বিদেশে যেতে চায় না। জেসমিনও বিরাট অনিশ্চয়তায়। বিদেশে গিয়ে কি করবে! আমার উপর বিন্দুমাত্র আস্থা নাই তার। তারপরও ২০০৩ সালের ২৮ জুন পিয়ারসন এয়ারপোর্টে নামলাম আমরা। ঢাকা থেকে ব্রিটিশএয়ারওয়েজে হিথ্্রো। তারপর ডিরেক্ট টরন্টো। গল্পের মতো সবকিছ ঘটল। স্বপ্ন ও কল্পনার মিশেলে এক যাত্রা শুরু হলো আমার। তারপর দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর পার করে এসেছি। এখন আবার ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা। একবার কিছু মাথায় ঢুকলে সহজে বের হতে চায় না। কেউ আমার সঙ্গী হোক বা না হোক এটাই আমার ইচ্ছা। যেভাবে এসেছিলাম সেভাবেই আবার ফিরে যাব…

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles