12.9 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪

নেতারা একসময় গুরুত্ব দেবে এ আশাতেই তৈরি হয়েছিল ‘প্রলয় গ্যাং’

নেতারা একসময় গুরুত্ব দেবে এ আশাতেই তৈরি হয়েছিল ‘প্রলয় গ্যাং’

একসময় ছাত্রলীগের নেতারা গুরুত্ব দেবেন, ডাকবেন এবং বিভিন্ন পদ দেবেন—এ আশায় নিজেদের শক্তিশালী প্রমাণ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২০২০-২১ সেশনের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রলয় গ্যাং গড়ে তুলেছিলেন। এমনটিই জানিয়েছেন প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যদের একাধিক বন্ধু ৷

- Advertisement -

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা জানান, গ্যাংয়ের সদস্যরা নিজেদের অপকর্ম, ছিনতাই, মাদক গ্রহণ ও চাঁদাবাজি করার পরে নিজেদের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, নেতারা জানবেন—পরে তাঁদের গুরুত্ব দেবেন, সামনে নির্বাচন তাঁদের লাগবে—এমনটিই বলতেন। এ ছাড়া এই গ্যাংয়ের সদস্যরা ছাত্রলীগের হল ও অনুষদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা যায়।

গ্যাংয়ের সদস্য নাজমুল হোসাইন, তৌসিফ তাহমিদ অর্পণ ও আরিফ মাহিন মনোয়ার ছাত্রলীগের হল শাখার পদে রয়েছেন। নাজমুল ও তৌসিফ মাস্টারদা সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। আর মাহিন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সদস্য। এদিকে তবারক মিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি উপসম্পাদক এবং প্রত্যয় সাহা ত্রাণ ও দুর্যোগ উপসম্পাদক পদে রয়েছেন।

তবে ছাত্রলীগের দাবি—তাঁরা কেউ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত নন। প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসনকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে জানান ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত। তিনি বলেন, ‘গ্যাংয়ে থাকা সদস্যরা ছাত্রলীগের কেউ না। নিরাপদ ক্যাম্পাস ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ছাত্রলীগ সব সময় কাজ করে যাচ্ছে।’

গ্যাংয়ে থাকা সদস্যদের পদ থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে সৈকত বলেন, ‘আগে তারা কীভাবে পদ পেয়েছে জানি না, বর্তমানে আমরা এ রকম কাউকে রাজনীতির সুযোগ দেব না।’

গত শনিবার রাতে বিজয় একাত্তর হলের (হল চত্বরে) সামনে অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়ের ইবনে হুমায়ুনকে ‘তুচ্ছ কারণে’ মারধরের ঘটনার পর অনুসন্ধানে ‘প্রলয় গ্যাং’ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারের তৃতীয় তলায় গ্যাংয়ের কার্যালয় রয়েছে, এদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে শিশু পার্কের (সাবেক) পার্শ্বে রয়েছে তাঁদের আস্তানা। যার নাম গ্যাংয়ের সদস্যরা দিয়েছে ‘নিকুম্ভিলা’।

মারধরের শিকার হওয়া জোবায়ের ইবনে হুমায়ুনের মা সাদিয়া আফরোজ খান বাদী হয়ে ১৯ জনের নামে ও ছয়-সাতজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা দায়ের করলে পুলিশ নাইমুর রহমান দুর্জয় ও সাকিব ফেরদৌসকে গ্রেপ্তার করে কোর্টে পাঠালে শুনানি শেষে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়। জামিনের জন্য দুর্জয় আবেদন করলেও জামিন মেলেনি। এদিকে কারাগারে থাকা দুই সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার ও গ্যাংয়ের সদস্যদের চিহ্নিত করতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ইকবাল রউফ মামুনকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বিপরীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট দিয়ে প্রবেশ করে ভাঙা গাড়ি রাখার জায়গা পার হয়ে শিশু চত্বরের (সাবেক) পার্শ্বে বটগাছসহ উঁচু টিলার জায়গায় গ্যাংয়ের সদস্যদের আস্তানা রয়েছে। উদ্যানের ভেতরের প্রকল্পের কাজ করার জন্য বানানো টিনশেডের একটি ঘরও দখল করে থাকতেন গ্যাংয়ের সদস্যরা। টিনশেড ওই ঘরের দরজার সামনে লেখা রয়েছে ‘প্রলয়’।

এদিকে শাহবাগ, টিএসসি, পলাশী, মেডিকেল মোড়, চানখাঁরপুলের বিভিন্ন জায়গায় আইল্যান্ড পানি বিক্রি করতেন জোর করে গ্যাংয়ের সদস্যরা। দোকানদের সঙ্গে কথা বলে তার সত্যতা পাওয়া যায়। এ ছাড়া অন্য পানি কোম্পানিকে ক্যাম্পাস এরিয়ায় পানি বিক্রি করতে পারবে না বলে হুমকি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকা ওয়াসার জিমখানা পানির পাম্পের একটি কক্ষে জোর করে আইল্যান্ড পানি রাখত গ্যাংয়ের সদস্যরা।

গত বছরের আগস্ট মাসের ৮ তারিখ রাতে শহীদ মিনারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. সাজ্জাদ হোসাইনকে মারধরের ঘটনায় প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। মারধরের ঘটনায় শাহবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও সেটার কোনো অগ্রগতি হয়নি। সে সময় বিচারের দাবিতে কর্মবিরতি ও মানববন্ধন করেছিলেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। ডা. সাজ্জাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে গ্যাংয়ে থাকা তবারক মিয়াকে চিহ্নিত করেন তিনি। গ্যাংয়ের সদস্যরা ডা. সাজ্জাদকে মারধরের ঘটনা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত গল্প করতেন এবং বলতেন ইন্টার্ন চিকিৎসককে মেরেছি, কী হয়েছে, কিছুই হবে না—এমনটি বলে গর্ব করতেন বলে জানান গ্যাংয়ের সদস্যদের একাধিক বন্ধু।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বন্ধু বলেন, ‘তারা (গ্যাং) ডা. সাজ্জাদকে মারধরের বিষয়ে গর্ব করত। তারা নিজের ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াবে কেউ কিছু করতে পারবে না ইত্যাদি বলত। গ্যাংয়ের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের ফয়সাল আহমেদ সাকিব ঢামেকের ইন্টার্ন ডা. সাজ্জাদের মুখে লাথি মারেন। উপর্যুপরি চড়-থাপ্পড়, কিলঘুষি মারেন শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের তবারক মিয়া। এরপর এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে কবি জসীমউদ্‌দীন হল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাদ ও একই হলের রহমান জিয়া, ফিন্যান্স বিভাগের মোশারফ হোসেন, বঙ্গবন্ধু হলের মুরসালীন আহমেদ ফাইয়াজ। সবাই তখন মদ্যপ অবস্থায় ছিল।’

বর্তমানে গ্যাংয়ের সদস্যদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) আইডি ডিঅ্যাক্টিভেট এবং মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ রয়েছে। সার্বিক বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘দুজন কারাগারে রয়েছে। বাকিরা পলাতক রয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে।’

ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. সাজ্জাদকে মারধরের ঘটনায় প্রলয় গ্যাং জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘একটি জিডি ছিল, সেটি বন্ধ ছিল। ভুক্তভোগী যোগাযোগ করলে আমরা তদন্ত করব এবং প্রমাণ সাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয় গ্যাং রয়েছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এত দিন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি—এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘যখনই বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ সম্পর্কে গণমাধ্যমের সাহায্যে জানতে পারি, তখনই তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রলয় গ্যাং সম্পর্কে জানার সঙ্গে সঙ্গে প্রক্রিয়া অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘প্রলয় গ্যাংয়ের নাম গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এই গ্যাং কীভাবে গড়ে উঠেছে তা জানার চেষ্টা চলছে। গ্যাংয়ের সদস্যদের চিহ্নিত করতে আন্তহল তদন্ত কমিটি হয়েছে। কমিটিকে তদন্তের স্বার্থে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানাচ্ছি।’

সূত্র : আজকের পত্রিকা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles